শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

মানুষ কোনছার (Poem)

গরমে হাসফাঁস জীবন মানুষ কোনছার কাকেরাও খাবার খোঁজে

বাঁধানো বিস্তার (short story)



বাঁধানো বিস্তার


-প্যান্টিটা কেচে রাখিস্

-আচ্ছা।

-জুতো পালিশ করিয়ে রাখিস্

-আচ্ছা।

-মা-র মাথা ব্যথার ওষুধটা দোকান থেকে আনবি

-আচ্ছা।

-না ফেরা পর্যন্ত খাবি না

-আচ্ছা।

দুইবার আওয়াজ করে রিক্সাটা চলে গেল। এখানকার রিক্সাগুলো কেমন বাক্স বাক্স দেখতে। আমাদের দেশেরগুলো ঢের বেশি সুন্দর। রিক্সাটার পিছনে একটা টিনের ফুল আঁকা। রিক্সাওয়ালার রোগা চেহারা, কালো, আমার জেঠুর মত। জেঠু ছিলুম টানে, খুক খুক করে কাশে; রিক্সাওয়ালা বিড়ি টানে, খুক খুক করে কাশে। বাড়ি থাকলে জেঠুর যেন তামাক খাওয়া ছাড়া কোন কাজ নাই। সামনে পেলেই বলবে-ও জেঠি, এক ছিলুম তামাক দে। 
জেঠু আমাকে খুব ভালবাসে। কোলের কাছে বসায়ে মাথার চুলে বিলি কাটে, পিঠে হাত বোলায়, আস্তে আস্তে হাতের আঙ্গুল টিপে দেয় আর গল্প বলে। বেশির ভাগই জেঠিমার গল্প। জেঠিমার চুলের কথা, টিয়া পাখির মত নাকের কথা। জেঠুর তো একটাও মেয়ে নেই, পাঁচটাই ছেলে। দুইজন টলারে করে মাছ ধরতে যায় সমুদ্রে। পনের কুড়িদিন পর ফেরে। একজন ফিটবাবু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জেঠু রাগারাগি করে। সে কিছুই শোনে না। আর দুইজন স্কুলে যায়।

রিক্সাটা প্রতিদিন এই লজে আসে। এটাকে লজও বলে আবার হোটেলও বলে। কত লোক আসে। একদিন, দুইদিন বা আরো দু'চারদিন থাকে। আবার চলে যায়। আমাদের মত কেউ থাকে না। কতদিন আমরা এখানে এসেছি! ৪০-৫০দিন তো হবেই। মামনির তো শরীর ভাল নেই। কলেজের হোস্টেলে থাকতে কষ্ট হবে বলে আমরা এখানে এসেছি। মামনি হোস্টেলে না থেকে হোটেলে থাকে। ভাল হলে আবার হোস্টেলে যাবে। যতদিন না ভাল হবে আমরা হোটেলেই থাকব। উঠানের বাঁধানো চত্বর থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি। তারপরই লম্বা বারান্দা।

সিড়ির পাশের থাম থেকে উনিশ পা হাঁটলেই আমাদের ঘরের দরজা। ব্যস্ত থাকলে উনিশ পা কমে যায় , না হলে মেপে মেপে উনিশ। মামনি, আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়, চলে যাবার পর আমার কোন ব্যস্ততা নেই। আমি উনিশ পা দূরত্ব অতিক্রম করতে থাকি। এর পরের ঘটনা আমি জানি। উনিশ শেষে আমি দরজার পাশে দাঁড়াবো, ঘরের মধ্যে নরম বিছানায় বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বই পড়বে মামনির মা। আমি দরজার পাশে দাঁড়ালে একবার তাকাবে তারপর আবার বইয়ের দিকে।
 আমার চোখ এখন বাঁধানো চত্বরের দিকে। আমি জানি ঐ চাতালের উপর এক্ষুনি একখানা সাইকেল এসে দাঁড়াবে। সিনেমার হিরোর মত চুল ছাঁটা একটা ছেলে আমাদের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে সাইকেল থেকে নামবে। একটা ইংরেজী পেপার এগিয়ে দেবে আমার দিকে। হাত বাড়াবো আমি।

সাইকেলের শব্দে মনে মনে প্রস্তুত হই। না দেখার মত গাছের দিকে তাকাই। একটা ডালের তিনটে ভাগ। উপরের দিক উঠে আরো ভাগ। ক্রমে সরু। তারপরে পাতা। সরু সরু পাতা।

 সাইকেল থেকে নামে। 

ডালে একটা কাক। নিচের দিকে তাকাচ্ছে।

 পেপারটা নিয়ে দরজার দিকে আসে।

 কাকটা হঠাৎ উড়ে যায়। কাকটা কি ভয় পেল?

 পেপারটা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি হাত বাড়াই ।মামনির মাকে পেপারটা দিই। আবার ডালের দিকে তাকাই। ডালটা কেমন ফাঁকা।

 সাইকেলটা একা দাঁড়িয়ে আছে। হিরো ছাঁট এখন পাঁচনম্বর ঘরের সামনে। সেখান থেকে দোতলায়, দোতলা থেকে তিনতলায়। তিনতলার কোনের ঘরটার কাছে গিয়ে সে কিছুটা সময় রেলিঙের কাছে দাঁড়াবে। গাছের দিকে তাকাবে। প্রতিদিন একবার গাছের দিকে তাকাবেই। গাছে তো কোন বাসা নেই, অথচ এমন ভাবে তাকাবে যেন কোন বাসা খুঁজছে। গাছের ফাঁক দিয়ে তিনতলার ঐ কোনের রেলিঙটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। বাসা খুঁজে না পেয়ে ওর চোখটা যখন আমার চোখে পড়ে তখনই ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে যায়। আর একটুও দাঁড়ায় না। আলতো করে শিস্ দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। পায়ের চপ্পলের চটর-পটর শব্দ দ্রুত নেমে আসে। বাহাদুরি ঢঙে সাইকেলে লাফিয়ে ওঠে। চত্বরে এক চক্কর খায়, তারপরে গেট দিয়ে হুস-

আমি দরজা একটু খোলা রেখে দাঁড়াই। এমনভাবে দাঁড়াই যাতে মামনির মা কিছু বললেই শুনতে পাই। তিনি তো প্রায় সারাক্ষণই বই নিয়ে থাকেন। এতদিন থাকতে থাকতে যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে-তাদের মাধ্যমেই বই আনেন । আমার বই পড়া নেই। হাতে কাজ নেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের পৃথিবীটা দেখি। হোটেলের বাঁধানো চত্বর এই মুহূর্তে কেমন একা পড়ে আছে। আমার মত একা। ওকে কেমন দুঃখী দুঃখী লাগে। যখন সাইকেল আসে, গাড়ি আসে, মানুষজন আসে-চত্বরটা কেমন গমগমে হয়ে ওঠে। আমার মনটাও চনমনে হয়ে ওঠে। আমি তো কাউকে চিনি না, কথা বলতে পারিনা। চত্বরটাও কথা বলতে পারে না। তবু জানি তার আনন্দ হয়। নির্জনতা ভাল কিন্তু একঘেয়ে নির্জনতা কতক্ষণ ভাল লাগে? তবু সেই নির্জনতাকে সঙ্গী করে আমাকে থাকতে হয়। চত্বরটাকেও থাকতে হয়।

চত্বরের তিন দিকে বাড়ি একদিকে খোলা। আমার সামনের বাড়িটা উত্তরদিকের। ওটার অর্ধেক দুই তলের, বাকি অর্ধেক তিন তল। দোতলার নিচে রান্না-বান্না- খাবারের জায়গা ও অফিস ঘর। দোতলায় অন্য অফিস। সেখানে প্রতিদিন যেমন নির্দিষ্ট মানুষজন আসে আবার সপ্তাহে সপ্তাহে নতুন মানুষ আসে। নতুন মানুষেরা আসে দল বেঁধে। মামনি যেমন কলেজে ক্লাস করে এইসব নতুন মানুষেরাও ক্লাশ করে , ন'টা থেকে পাঁচটা ক্লাশ। সবাই কেমন বড় বড়। এইসব বুড়ো মানুষেরা কি পড়ে কে জানে!

আমার ডানদিক-পুবদিক। উত্তরদিকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিন তলা। প্রত্যেক তলায় চারটে ঘর। চারটে দরজা। চারটে জানালা। জানালায় পরদা। প্রতি সপ্তাহে যে সব নতুন মানুষেরা আসে, এইসব ঘরে তারা থাকে। কেউ কেউ রেলিঙের ধারে দাঁড়ায় সকাল সন্ধ্যে। নিচের দিকে তাকায়। গাছের ফাঁকা দিয়ে আমাদের দরজার দিকে তাকায়। ঘুরে ফিরে তাদের চোখ আমাদের দরজার দিকেই বেশি পড়ে। গাছের পাতাদের সাথে আমি লুকোচুরি খেলি।

সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা একজন এসে দাঁড়ালো। রেলিঙের সেই ধারটায় যেখান থেকে গাছের ফাঁকে আমাদের দরজা দেখা যায়। ফর্সা, রোগা, মুখে দাড়ি। মাথায় একটাও চুল নেই। আমার হাসি পায়। সারা মুখে দাড়ি অথচ মাথার সবটাই টাক। কেমন চকচক করছে। একবার তাকালো। পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করলো। ঠোঁটে নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। বিড়িটা এবার হাতে নিল। যা বাবা-হঠাৎই একটা হাঁক পাড়ল-বুড়ো....। তিন তলা থেকে হঠাৎ বুড়োকে ডাকল কেন? প্রত্যেক ঘরে তো টেলিফোন আছে। টেলিফোনে ডাকলেই যা দরকার, যাকে দরকার পেয়ে যাবে। তবে অমন ভ্যা করে ডাকল কেন? লোকটা কি আমাদের দরজা দেখতে পাচ্ছে না? পাবে কি করে-আমি তো এখন গাছের পাতাদের সাথে লুকোচুরি খেলছি। মামনির মা বাথরুমে। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে খেলছি আমি।

আমরা যে ঘরে আছি এটা দক্ষিণ দিক। পূবদিকের তিনতলার সাথে লাগানো হলেও মানিকজোড় বলা যাবে না। কারণ জোড়ের মাঝখানে সিঁড়ি, ডাইনে-বায়ে ডাইনে-বায়ে করে চারতলার ছাদে উঠে গেছে। হ্যাঁ-এটা চারতলা, সবার থেকে বড়। নিচের তলায় ছয়টা ঘর। ছয়টা দরজা। ছয়টা জানালা। প্রত্যেক জানালায় পর্দা। নিচের তলার মত প্রত্যেক তলায় ছয়টা ঘর। ছয়টা দরজা, ছয়টা জানালা। অন্য তলার ঘরগুলো আমি ভাল দেখতে পাই না। এখন তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি-সবটাই আমার মাথার উপর। নিচের বারান্দা লম্বা। থামের ছায়া পড়েছে চক্চকে বারান্দার উপর। ছ'টা ঘরের সামনে ছ'টা পাপোষ। বারান্দার একধারে একটা কুকুর শুয়ে আছে। কুকুরটার লেজটা সাদা আর একটা কান সাদা। মনে হয় শ্বেতী হয়েছে লেজে আর কানে। সাদা কানটা হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠল-তার মানে কেউ আসছে।

চত্বরের পূবদিকে একটা বকুল গাছ। সাদা কিছু ফুল পড়ে আছে চত্বরে। সেখানে আরেকটা কুকুর। গোল হয়ে শুয়ে আছে। একেবারে কালো। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। মুখটা পশ্চিমদিকে। পশ্চিম দিকে কোন ঘর নেই। দেয়াল। দেয়ালে এগারটা চৌকোনা পিলার। প্রত্যেক পিলারে একটা করে টিউব লাইট। রঙিন কাচ দেওয়া। রাতে খুব সুন্দর লাগে। দেয়াল ঘেঁষে দেবদারু গাছ লাগানো। বাইশটা গাছ। গাছগুলি সব সমান লম্বা। দেয়ালের উত্তরদিকে গেট। লোহার গেট। নক্সা করা গেট। আড়া-আড়ি করে দুই সারি গোল নক্সা। এক এক সারিতে সাতটা গোল। যখন গেট খোলা হয়-মাঝখানের গোল দুটো দুই ভাগ হয়ে যায়, দুই পাল্লায়। একেবারে সমান সমান।


-মা, দিদিকে লেজ দিয়েছো আমাকে দাওনি।

-তুই তো মুড়ো ভাল খাস্ তাই তোকে মুড়ো দিয়েছি।

-না-আমাকেও লেজ দিতে হবে।

-মা, ভাইকে আলুসেদ্ধ বেশি দিয়েছো।

-মা, দিদি পোড়া লংকা খাচ্ছে-

-মা, ভাইয়ের দুটো জামা-

-মা, দিদির মত আমার একটাও লালজামা নেই-

-মা, ভাইয়ের মত আমিও ইস্কুলে যাব-

-মা.........।


মামনির মা ডাকে ঘরের থেকে। ঝাপসা হয়ে যাওয়া লোহার গেটের থেকে চোখ ফিরাই। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পাপোষটা দেখি। অনেক বালি জমে আছে পাপোষে।

একটা মোটর সাইকেলের শব্দ। তার মানে দশটা। আমাদের ঘড়িতে এখন নটা পঞ্চান্ন মিনিট। মেমসাহেব অফিসে এল। মেমসাহেব মোটর সাইকেলেই আসে। মাথায় একটা লোহার টুপি। শাড়ি পরা। মেমসাহেবের লম্বা চুল, বিনুনী করা। মেমসাহেব কালো, আমার থেকেও কালো। চোখ দুটো সাদা, দাঁতগুলি' সাদা। মোটর সাইকেল বকুল তলায় আসতে কালো কুকুরটা উঠে দাঁড়ালো। মেমসাহেব গাড়িটা দাঁড় করালেন। চাবি দিলেন। দোতলার সিঁড়ির দিকে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মত আমার দিকে তাকালেন। একটু হাসলেন। আমিও একটু হাসলাম। দোতলার সিঁড়িতে পা রাখলেন। কি ভেবে একটু দাঁড়লেন। আবার চলতে শুরু করলেন। দোতলার বাঁদিকে গেলেন। অফিসে ঢুকে গেলেন।

একটা ছাগল এসেছে। ছাগলটা চত্বরে পড়ে থাকা পাতা খাচ্ছে। বকুল ফুলও খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ম্যাঁ-ম্যাঁ শব্দ করছে। ছাগলটার পেটটা মোটা। বলের মত। আরেকটা ছাগল আসে ওর সঙ্গে তারও পেট মোটা। একেবারে ভাইয়ের ছোটবেলার পেটের মত। সকাল বেলা পান্তাভাত খেয়ে ভাই প্যান্টের নাতা ঢিলা করতো। তখন ওর পেটটাকে বাবুইপাখির বাসার তৈরি বলের মত লাগত। চত্বরের উত্তরদিকে দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা তক্তা। একটার উপর একটা, ঠিক গোনা যাচ্ছে না। দুটো শুকনো লম্বা বাঁশ। তার পাশেই ছয়টা টব। একটা টব কাত হয়ে পড়ে আছে। টবগুলো একটা লতানো গাছের গোড়ায় সাজানো। লতানো গাছটা দেয়াল বেয়ে দোতলায় উঠে গেছে।

কালোকুকুরটা উঠে শুকনো বাঁশের কাছে গেল। একটু গন্ধ শুকল। একপা তুলে বাঁশের উপর পেচ্ছাব করে দিল। ছেলে কুকুর। ভারি অসভ্য। এখন অবশ্য ভোলানাথের মত, কিছুই জানে না। পেচ্ছাব শেষ করে গেটের দিকে দৌড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে একটা সাদা গাড়ি ঢোকে চত্বরে। দক্ষিণ দিকের বারান্দা ঘেঁষা রাধা-চূড়ার নিচে এসে দাঁড়ায়। রাধা-চূড়ার হলদে ফুল চাপা পড়ে সাদা গাড়ির চাকার তলে। গাড়ি থেকে একজন নাদুস-নুদুস লোক নামে। অন্যগেট দিয়ে নামে একটা মেয়ে। প্রায় আমার বয়সী। চুড়িদার পরা। একটা বেনী। মাথার চুল কিছুটা এলোমেলো। আমার দিকে একবার তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়। চোখ দুটি কেমন সাদাসিধে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতোর তলায় রাধাচূড়ার ঝরা পাতা পিষতে থাকে। নাদুস-নুদুস লোকটা হোটেলের রিসেপশান থেকে ফিরে আসে। নিচের দিকে তাকাতে তাকাতে তার পিছু নেয় মেয়েটি। ওরা আমার মাথার উপরের দোতলার বা তিনতলার বা চারতলার কোন ঘরে যায়।

বারান্দার পূবদিকে দশ পা যাই। গুণে গুণে দশ পা ফিরে আসি। বাঁ দিকে লম্বা বারান্দা, পূব দিকের ঘরের বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চের উপর একটা জগ। জলের জগ। বেঞ্চের উপর এখন আর কেউ বসে নেই। একটু আগে ছেলেটা বসে ছিল। লম্বা, বচ্চনের মত চুল আর কার্তিকের মত সরু গোঁফ। ফাঁক পেলেই অন্য কেউ এসে বসবে। কখনো কখনো দু'তিনজন একসঙ্গে বসে থাকে। আমরা যখন প্রথম আসি তখন এখানে কোন বেঞ্চ ছিল না। কোন এক দুপুরে এসেছে। বারান্দার ঐ কোন থেকে চত্বরটা সুন্দর দেখা যায়। মানুষজন এলে দেখা যায়। বকুল ফুলের গাছ, রাধাচূড়ার ফুল দেখা যায়। দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখার থেকে বসে দেখা ভাল। তাই বেঞ্চ এসেছে। বেঞ্চ থেকে দক্ষিণের বারান্দা আর আমাদের ঘরের দরজাও দেখা যায়।

দশ পা ফিরে আসি। বাঁধানো চত্বর এখন ফাঁকা। বারান্দা থেকে চত্বরে নামি। রবার গাছের পাতাগুলি বেশ বড় বড়, মসৃণ। ডগা লাল। গাছের কান্ড থেকে শিকড় বেরিয়েছে। বটগাছের মত। গাছ তলায় একটাও রবার গাছের পাতা নেই। পোড়া সিগারেটের টুকরো একটা। মেমসাহেবের মোটর সাইকেলটি দাঁড়িয়ে আছে। একা একা। হ্যান্ডেলের কাছে আয়নাটার সামনে দাঁড়াই। আয়নায় নিজের মুখটা দেখি। নাকে একটা ফুটো। ফুটোয় কাঠি লাগানো। দুই কানে ফুটো। দুই কানে কাঠি লাগানো।


-ঠাম্মা, ভয় করছে

-কিসের ভয় রে ছুঁড়ি, সবাই তো ফোটায়

-ওরে বাবারে, কি মোটা সুঁই-ব্যথা করবে না?

-ব্যথা কোথায়, পিঁপড়ের কামড়ের মত

-যদি ঘা হয়?

-প্রত্যেক দিন চন্দন ঘষে লাগাবি

-ফুটো করে কি হবে?

-সোনার গয়না পরবি, নাকে নোলক, কানে দুল..


কার্নিসের কাকটা ডেকে ওঠে কা-কা করে। চারতলার ছাদে আরো দুটো কাক।

কার্নিশের কা-কা শুনে তারা একটু সতর্ক হয়। কিন্তু ওড়ে না। ইতি-উতি তাকায়। এক বালতি ভিজে কাপড় নিয়ে আমি সিঁড়ি ভাঙ্গি। এক. দুই. তিন.........চার............পাঁচ... ছয়. .সাত. চৌকোনা চাতালের মত। ডাইনে বাঁক। এক.. .আট. ..নয়.......দশ। এবার দুই.........পাঁচ.. ছয়......নয়.... দশ। দোতলা। বাঁ দিকে দক্ষিণ দিকের বারান্দা, ডানদিক সামনে পূব দিকের বারান্দা। ডাইনে বাঁক। দশ ধাপ সিঁড়ি এক চাতাল, আবার দশ ধাপ তিনতলা। পূব দিকের বারান্দা। বায়ে রেলিঙ ডাইনে দরজা, বন্ধ। জানলা, বন্ধ। একটা পা- পোষ। বায়ে রেলিঙ-রেলিঙের উপর একটা গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি। ডাইনে দরজা সামান্য ফাঁক। ভিতরে কথা। পাপোষ উল্টানো। জানালা বন্ধ। বাঁয়ে রেলিঙ মেঝেতে ওষুধের খালি খোেল। বিড়ির টুকরো। ভিতরের দিকে ঢোকা পা-পোষ। দরজা অর্ধেক খোলা। সাদা বিছানার চাদর। একজন কালো মানুষ। চিৎ হয়ে শোয়া। অসুস্থ! আবার দরজা, আবার দরজা। বাঁয়ে বাঁক। দুটো ঘর। বারান্দার শেষ। লোহার গেট, টানলে একদিকে গুটিয়ে থাকে। কালো রং। এখন গোটানো আছে ডানদিকে। পা বাড়ালেই ছাদ।

ভর দুপুর। ঝকমকে রোদ। ছেঁড়া ন্যাতার মত মেঘ। সাদা সাদা। কোন বাঁধা নেই। কাউকে তোয়াক্কা করে না। সূর্যকেও না। নিজের মত উড়ে বেড়ায়। কেউ কাজ করতে বলে না। ঘরের বাইরে একা থাকতে কেউ বারণ করে না। সময় কাটাবার সাথী খুঁজতে হয় না। চারিদিকে ঘেরা, বাঁধানো চত্বরের সামনে থাকতে হয় না। আমি যদি মেঘ হতাম- এক দৌড়ে চলে যেতাম মায়ের কাছে। মায়ের চোখ মুখ নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতাম। মাকে জড়িয়ে ধরতাম।

-তুমি আমায় কেন ছেড়ে এলে মা?

-তোমার মত কেউ তো আমার মাথায় বিলি কেটে দেয় না।

-আমার তো তোমার কাছে শুতে ইচ্ছা করে মা। মামনির মত তোমাকে জড়িয়ে তোমার বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে....


ভিজে কাপড় রাখি তারের উপর। টিভি অ্যান্টেনার উপর বসে থাকা ঘুঘু উড়ে যায়। অ্যান্টেনায় ছোট ছোট সাদা রড আড়াআড়ি, মোট সতেরটা।

ছাদের মাঝখানে চারটে পিলার সামান্য উঁচু হয়ে সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় ওরা খেলবে-হাত ধরাধরি করে কিছু একটা খেলবে। কিন্তু ওদের বড় কষ্ট কেউ কারো কাছে যেতে পারে না-দূরেও যেতে পারে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। বুড়ি দিদিমার মত। ঘাট থেকে উঠতে গিয়ে ধপাস্-পড়ে গেল। কোমর ভাঙ্গল। হাসপাতালে ছিল কয়দিন। তারপর থেকে বাড়ি। বাড়ির বাইরে আর যেতে পারে না। বুড়ির ছাগল দুটো বাইরে যায় আবার ফিরে আসে।



ছাদে অনেক টব-অনেক গাছ। আমি তো নাম জানিনা সবার। খুব চেনা ফুল-কল্কে ফুল। রাস্তার ধারে হয়। এখানে টবে। টব থেকে ছাদের রেলিঙ বেয়ে গাছ উঠেছে। আজ তেরটা ফুল। কালকের থেকে চারটে বেশি। সিমেন্টের তৈরি চারটে বড় টব। একটা টবে বট গাছ। ঝুরি নামানো বটগাছ। আমাদের শীতলা মন্দিরের বিশাল বটগাছটা কেউ যেন মন্ত্র দিয়ে ছোট করে দিয়েছে। আরেকটা গাছের নাম জানি। মামনির মার কাছ থেকে শুনেছি। অ্যাডেনিয়াম। বাকি নাম জানিনা। সিমেন্টের টবে ভাঙ্গা প্লেটের টুকরো লাগিয়ে সাদা সাদা ছোপ তৈরি করা হয়েছে। মাঝারি টব-উনআশি। ছোট টব-সাতাশ। ফাঁকা টব-তেইশটা। তিনটে টব উল্টানো, একটা গাছসহ আর দুটো ফাঁকা।

ছাদের উত্তর পশ্চিম কোনে একটা চৌবাচ্চার মত টব। লম্বা চারকোনা। টব ভর্তি অনেক গাছ, ছোট ছোট। সবগুলো গাছে ফুল। গোলাপী, সাদা, নীল। কড়া রোদে পাতাগুলি একটু মিইয়ে পড়েছে। ফুলগুলি খুব উজ্জ্বল। দক্ষিণ-পশ্চিম কোনেও আরেকটা চৌবাচ্চা টব। একই রকম ছোট ছোট গাছ, ফুল। টবের পিছনেই লতানো গাছের ঝোপ। বাঁধানো চত্বর থেকে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে এসেছে। ছাদের কোনায়, ঝোপের আড়ালে তিনটে বোতল। খালি বোতল। দুটো চ্যাপ্টা। কালো লেবেল লাগানো। কি সব লেখা। তৃতীয় বোতলটা গোল, চ্যাপ্টাদের থেকে বড়। ছিপি নেই। তলার দিকে ভাঙ্গা। চৌবাচ্চার এক পাশে একটা চেয়ার। হাতল ভাঙ্গা।

এখান থেকে গেট ভাল দেখা যায়। গেট খোলা। গেট থেকে বেরিয়ে একরাস্তা ডানদিকে, আরেক রাস্তা বাঁ দিকে। বাঁ দিকের রাস্তা একটু এগিয়ে দুইভাগ। একটা আবার ডানদিকে। আরেকটা বাঁদিকে। লাল মাটির রাস্তা। ছোট বড় বাড়ির মাঝে হারিয়ে গেছে।

কয়েকটা বাড়ি পরে একটা লাল রঙের বড় বাড়ি। বাড়ির ছাদে উল্টানো ছাতার মত দুটো অ্যান্টেনা। ছাদের এক অংশ টালির মত। পাশে দুটো নারকেল গাছ-ভাইবোনের মত দাঁড়িয়ে আছে। আরো দূরে গ্রাম, গাছে ঢাকা গ্রাম।

কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটা এখনো ছাদে আসেনি। এবার আসবে। গাছের দেখাশুনা ছেলেটা করে। সব কাজ ফেলে বা করে এই দুপুর বেলা ও গাছের যত্ন নেবে। টবগুলোর কাছে যাবে। মরা পাতা থাকলে ফেলে দেবে। যত রোদই হোক সে কাজ করবে। আমার কাজ শেষ হয়ে গেলেও সে সব গাছের যত্ন না নিয়ে যাবেনা। আমার আগে কোনদিনই তার কাজ শেষ হয় না। গুণ গুণ করে
গান করে। আমার দিকে কখনোই পিছন ফিরে কাজ করে না। গাছগুলোতো তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। আমি জানি এক্ষুণি সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ শোনা যাবে।
#

বাঁধানো চত্বর থেকে আকাশ ছুঁতে চলেছে রাধাচূড়া। দোতলার ছাদ ছাড়িয়ে তিনতলার ছাদের সমান। ছাদের উপর থেকে রাধাচূড়াকে অন্যরকম লাগে। নিচের থেকে যেমন বিশাল মনে হয়-ছাদ থেকে তেমন মনে হয় না। থোকা থোকা হলুদ ফুল। অনেক মৌমাছি। একটা কালো ভোমরা। ফুল ফুটলে ওরা যে কি করে টের পায়!

তিনতলার ঘরগুলি অনেকটা গাছের আড়ালে। একটা ঘরের সামনে, নাদুস- নুদুস লোকটা। দরজা ভেজানো। লোকটা ছাদের টবগুলো দেখছে। ফুলগুলো দেখছে। তারের উপরের কাপড়-চোপড় দেখছে, বড্ড বিশ্রীভাবে দেখছে। যেন গিলছে। হোটেলের লাল ছেলেটা, যে সবার থেকে ছোট আর সবার থেকে বেশি সেজেগুজে থাকে- সে খাবার নিয়ে নাদুস-নুদুস-এর ঘরে যায়।
 তার মানে ওরা ঘরেই খাবে। নিচে যাবে না। ইস্-যদি নিচে যেত, আমরা মানে মেয়েটা আর আমি গল্প করতে পারতাম।

অ্যাডেনিয়াম। কোন কালে এমন নাম শুনিনি। গাঁদা, জবা, হাসনাহেনা, পাথরকুচি, পাতাবাহার। এমন সব নাম জানতাম। অনেক গাছেরই নাম জানিনা। এটারও জানতাম না। এখন জানি। কারণ তো একটু আছেই। 
কোঁকড়া চুল এখনো আসছে না। কেন আসছে না! খুব কাজে পড়েছে? হবে হয়তো। অ্যাডেনিয়ামের কাছে দাঁড়াই। কান্ডে হাত বোলাই। তেল তেলে গা। মামনির বইয়ের ছবির মত দেখতে। মেয়েদের ছবি আঁকা, ছেলেদের ছবি আঁকা। নানাভাবে। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে। নানাভাবে বসে, নানাভাবে শুয়ে, নানাভাবে দাঁড়িয়ে। কারো গায়ে পোষাক নেই। পোষাক আঁকতে বেশি কষ্ট? হবে। অ্যাডেনিয়ামের গোড়া একদম এক ছবির মত। একটা মেয়ে বসে আছে হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে। আবার আরেক দিক থেকে দেখলে মনে হয় বাচ্চা হবার যন্ত্রণা নিয়ে কোন মেয়ে আধশোয়া।

-মাগো! 
মার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভাই আর আমি মেঝেতে শুয়ে। বাবা-মা চৌকির উপর। টালির ঘর। বাঁশের বেড়া কেটে জানালা। জানালা দিয়ে আবছা আলো। সেই আলোতে দেখি আধশোয়া মা কাতরাচ্ছে। মায়ের পেটটা উপুড় করা গামলার মত। বাবা হাত বোলাচ্ছে পেটে। 
আমি উঠি। ঠাম্মাকে ডাকি।


ঠাম্মা পাড়ার ঠাম্মাকে ডাকে। অনেক পরে মায়ের চিৎকারের মধ্যে আমাদের সবার ছোট ভাইটা চিৎকার করে ওঠে।

হাঁটু গেড়ে বসি। অ্যাডেনিয়ামের কোমরে হাত বোলাই। আমার মা, হোক না সৎ মা, যেমন কষ্ট পেয়েছে-অ্যাডেনিয়াম কি তেমনি কষ্ট পাচ্ছে!

অ্যাডোনিয়ামের কোমর ঘেঁষে দূরের ঘরটা চোখে পড়ে। দরজাটা খোলা। মশারি ঝুলছে। একটা জামা হ্যাঙারে। টেবিলের অর্ধেক দেখা যায়। এলোমেলো বই ছড়ানো। লোকটা শুয়ে আছে। কোন বন্ধু পাশে নেই। ও কি একা? ওর আর কে আছে? যদি জ্বর বাড়ে? যদি মাথা ব্যথা বাড়ে? যদি পেটে ব্যথা বাড়ে?

-ওঃ মাগো......

- কষ্ট হচ্ছে সোনা? 
- অসহ্য ব্যথা......... মাথায় গায়ে...
-মাথা টিপে দিচ্ছি, চুপ করে শুয়ে থাক...

 ডাইনে রেলিঙ। মেঝেতে ওষুধের খালি খাপ।

 -আমি আর বাঁচবো না জেঠু......
 -"ধূর পাগলি, অমন করে না.......

দরজা খোলা, বালিশের বাইরে মাথা। 

-মা কেন চলে গেল? আমায় কেন নিয়ে গেল না...

পরের দরজা বন্ধ, জানালা দিয়ে ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে।

 -লক্ষ্মী সোনা, এই দেখ........ আমি তো আছি..

 পিছনের দরজা খোলা, আমার পা থেমে যেতে চায়। কিন্তু আমি তো জেঠু নই। আমাকে নামতেই হয় । দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার...এক। একতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে সেই বেঞ্চ। বেঞ্চের উপর একটা জলের জগ। জগের পাশে একটা ছেলে। কোঁকড়ানো চুল। বুড়ো আঙ্গুলে ন্যাকড়া বাঁধা। একলব্য হয়ে তাকিয়ে আছে তিনতলা থেকে নেমে আসা সিঁড়ির দিকে।

মেমসাহেব নামছে। বাঁ-কাধে ব্যাগ। ডান হাতে লোহার টুপি। মোটর সাইকেলের কাছে। টুপি মাথায় পরলেন। গাড়ি ঘোরালেন। এবার বাড়ি। অফিস শেষ। অফিসের অন্যরাও বাড়ি চলে যাচ্ছে। চার চাকার সুন্দর একটা গাড়িতে যে ভদ্রলোক আসে, সে যাবে অনেক পরে। মেমসাহেব গাড়িতে উঠলেন। আমার দিকে তাকালেন, মুখে হাসি। 
গাড়ি চলতে শুরু হতেই চত্বরের মধ্যে আরেকটা গাড়ি ঢুকল। লালপানা ফিট্-ফাট ছেলেটা তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে এলো। গাড়ির দরজা টেনে খুলল। সামনের থেকে নামলেন টাই পরা একজন। পিছন থেকে একদিক দিয়ে নামল ফুটবলের মত গোল একটা ছেলে। কোমরের প্যান্টটা একটু টেনে তুলল। আরেকদিকের থেকে নামল একটা মেয়ে। জিনসের প্যান্ট পরা। চোখে কলো চশমা। মাথায় ছোট চুল। ছিপ ছিপে। মোটামতন একটা বউ। তার চোখেও কালো চশমা। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। সব শেষে নামল একটা মেয়ে। আমার থেকে ছোট। সবার থেকে অন্যরকম। পোষাকে, চেহারায়। কাজের মেয়ে কাজের মেয়ে। আমার মত। ওরা যদি কয়েকদিন থাকে তবে বেশ মজা হবে। ওর সাথে লুডো খেলব। আমার লুডোটা ব্যাগেই পড়ে আছে। মামনির পরীক্ষা, খেলার সময় নেই। মামনির মা পড়ে, সেলাই করে নাহলে হোটেলের কারো সাথে গল্প করে। লুডো খেলার সময় কারো নেই। আমার দিকে তাকালেই ওকে ডাকবো।

মামনির সাথে হাঁটতে হাঁটতে দেবদারু গাছের কাছে যাই। গেট দিয়ে লম্বা পা ফেলে ঢোকে একটা ছেলে। মুখে দাড়ি। এলোমেলো চুল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। বাঁ হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সটান এসে দাঁড়ায় আমাদের কাছে। মামনিকে প্রশ্ন করে-এটা হোটেল?

মামনি অফিস ঘরের দরজা দেখিয়ে বলে-ঐদিকে।

-সরি। উদাস চোখ দুটো আমাদের উপর থেকে টেনে নিয়ে যায় দরজার দিকে।

-আঁতেল......। মামনি মন্তব্য করে।

ডাইনিং রুমে দুটো ভাগ। একভাগে পড়তে আসা লোকগুলো খায়। অন্যদিকে অন্যরা। আমরা তো অন্যদের দলে। আমরা কোনের টেবিলটায় বসি। আমাদের সারিতে পাঁচটা টেবিল। মাঝের সারিতে তিনটে। ওপাশের সারিতে চারটে। প্রত্যেকটা টেবিলে চারটে চেয়ার। মোট দশটা সিলিং ফ্যান। যেদিক থেকে খাবার আসে, সেখানে একজন বসে থাকে। ছোট একটা টেবিল। একটা চেয়ার। টেবিলে হিসাবের খাতা, মৌরি। আমি ফুটবলের মত ছেলেটাকে খুঁজি। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল অথচ ওরা এলো না। ওরা কি খাবে না? ছোট্ট বাটি থেকে মৌরি নিই। মৌরি চিবোতে চিবোতে অফিস ঘরে ঢুকি। চারটে সোফা। দুটো ছোট, নিচু টেবিল। ঘরের এক কোনায় দেয়ালে চাবি রাখার জায়গা। টেলিফোন। একটা চেয়ার। অফিসের দিদি বসে আছে। সামনে দুটো মোটা খাতা। আরেক কোনায় 
টি.ভি.। রঙিন টিভি। টিভির কাছের সোফায় মামনি বসে। আমি পাশে বসি। নেচে নেচে গান হচ্ছে। হিন্দি গান। আগে একদম বুঝতাম না, এখন কিছু কিছু বুঝতে পারি।

ডাইনিং রুমের দরজায় ফিটফাট ছেলেটা এসে দাঁড়ায়। টিভির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পিছন থেকে ডাক পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। দরজার কাছে আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ কোঁকড়ানো চুল ছেলেটা এসে দাঁড়ায়। টিভির দিকে তাকায় না। সোফার দিকে তাকায়। আবার মেঝের দিকেও। ঝকঝকে মেঝে। চোখ বেশিক্ষণ সেখানে আটকে থাকে না পিছলে যায়। সোফার দিকে। বুড়ো আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ, তার মানে কয়েকদিন টবের মাটিতে হাত দিতে পারবে না।
দুপুর বেলায় ছাদের গাছগুলো কষ্ট পাবে ওর জন্যে।

শুক্লপক্ষ এখন। চারিদিকে উঁচু বাড়ি, চত্বরে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে মত চাঁদ দেখা যায় না। ছাদে গেলে দেখা যায়। কিন্তু রাতের বেলায় ছাদে যাবার স্বাধীনতা আমার নেই। ইচ্ছে করলেই কাঠের পুলে দৌড়ে যাওয়া যায় না। মাছ ধরার ট্রলার থেকে জারি গানের সুর বা বাঁশের বাঁশীর সুর ভেসে আসে না। ঠুন-ঠান শব্দ ভেসে আসে রান্না ঘরের দিক থেকে। ডাইনিং রুমের ভিড় কমছে। হোটেলের ঘরগুলোর আলো নিভছে। তিন তলার ঘরটার জানালা খোলা। ভিতরে আলো জ্বলছে।

আলো-আঁধারের বাঁধানো চত্বরের পশ্চিম দিক থেকে পূব দিকে যাই। আমাদের মধ্যে বলার মত কোন শব্দই আমরা খুঁজে পাই না। দু'জনে তবু পাশাপাশি হাঁটি। পূব দিক থেকে পশ্চিম দিকে যাই। কালো কুকুরটা কান সাদা লেজ ধলো কুকুরটার পিছনে পিছনে গেটের বাইরে যায়। মামনি হাতের ঘড়ি দেখে। আমরা ঘরে ফেরার জন্যে বারান্দায় উঠি।

-...কোন্ শুয়োরের বাচ্চা.............

......................বাপের খাই..............

................................উপড়ে ফেলব.........

চিৎকার গমগমিয়ে ওঠে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। তিনতলার বারান্দা থেকে একজন চিৎকার করছে। কথা স্পষ্ট নয়। জড়ানো। একজন তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে কিছু একটা। লোকটা কোন আমলই দেয় না। এক কথা বার বার বলতে থাকে। দুম দাম করে নিচে নামে। পাজামা-পাঞ্জাবী পরা কার্তিকের মত চেহারার লোকটা। একতলায় সিঁড়ির পাশের দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। সঙ্গে গালি গালাজ। ইংরেজী শব্দও বলছে। মানে বুঝি না। তিনতলা থেকে আরো তিনজন নেমে আসে। সবাই মিলে জোর করে উপরের দিকে নিয়ে যায়।

বাঁধানো চত্বরটা ভিজে। অনেকগুলি বকুল ফুল পড়ে আছে। শুকনো পাতা, হলদে ফুল চত্বরের প্রায় সবখানে। সাদা গাড়ি একটা দাঁড়িয়ে আছে। পুবের বারান্দার শেষের বেঞ্চটার উপর জলের জগটা নেই। একটা সাঁওতাল বউ এলো সাইকেল চেপে। বউটার কাজ ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা। রাবার গাছতলায় সাইকেল রাখল। চাবি দিল। চাবিটা আঁচলে গিঁট দিতে দিতে রান্না ঘরের দিকে গেল। নাদুস-নুদুস লোকটা নেমে এল। মেয়েটি এল পিছে পিছে। কোন দিক না তাকিয়ে সাদা গাড়িটার কাছে গেল। দাঁড়াল। লোকটি অফিস ঘরে গেল। মেয়েটি ভিজে ভিজে চোখে তাকাল আমার দিকে। চোখ নামিয়ে নিল বাঁধানো চত্বরের দিকে। লোকটা এল। মেয়েটিকে গাড়িতে উঠতে বলল। মেয়েটি উঠল।


- গাড়িতে উঠে বস।

আমি গাড়িতে উঠলাম। মার মুখে আঁচল।

- একি কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে। তোমাকে কি দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি নাকি............
.........এই তো কাছেই........

ভাইয়ের চোখে জল। জেঠু চুপচাপ।

- আরে বাবা ইচ্ছে করলেই তো বাড়ি চলে আসতে পারবে। গাড়িতে উঠলেই বাড়ি, মাত্র ঘন্টা তিনেক সময়......

মা আমায় কেন যেতে দিচ্ছে? সৎমা বলেই কি আমায় বারণ করছে না? জেঠু কেন আমায় জোর করে নামিয়ে নিচ্ছে না?

- বাড়ির মতই থাকবে। কাজ বলতে প্রায় কিছুই নেই, কাজের লোক তো আছেই। মামনির সাথে গল্প করা আর টিভি দেখা। ইচ্ছে করলে লেখা-পড়াও শিখতে পারবে।

গাড়ি চলতে শুরু করে। মা পিছনে থাকে, ভাই পিছনে থাকে, জেঠু পিছনে থাকে, ঘর পিছনে থাকে।
গাড়ি চলতে থাকে।


গাড়িটা চলে যায়। বাঁধানো চত্বর সামনে রেখে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

- নাইটিটা কেচে রাখিস্

- আচ্ছা।

- শাড়িটা ইস্ত্রি করতে দিস্

- চুলের কাঁটাটা খুঁজে রাখিস

- আচ্ছা।

- দরজা বন্ধ করে থাকবি

- আচ্ছা।

মামনির সঙ্গে মামনির মা-ও রিক্সায় ওঠে। আমি টা-টা করি, মামনি হাত নাড়ে। ভিজে চত্বরে তিনটে চাকার দাগ। দাগগুলি গেটের দিকে মিলিয়ে যায়।

মামনির মা না ফেরা পর্যন্ত ঘরে আমি একা। অনেক কাজ। .....গেটের কাছ থেকে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ ভেসে আসছে.... আমি দরজার কাছে দাঁড়াই। বাঁধানো চত্বর থেকে পিঁপড়েরা সারি বেঁধে উঠে আসছে। একটা কালো পিঁপড়ের মুখে সাদা ডিম, অন্যদের থেকে গতি বেশি। ...বাঁধানো চত্বরে ঢুকছে সাইকেলের চাকা, প্যাডেলে চাপ পড়ছে বাঁ পায়ের.....পা-পোষকে ডাইনে রেখে পিঁপড়ের সারি ঢুকছে আমাদের ঘরে। মা বলত-পিঁপড়ের সারি মানে ঝড়-বৃষ্টির লক্ষণ। পৃথিবীর খবর সবার আগে টের পায় তারা। পিঁপড়ের ব্যস্ততার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। তবে কি ঝড় আসছে? অথবা বৃষ্টি?

সাইকেলের চাকা থামে। দুটো পা এগিয়ে আসছে দরজার দিকে।

বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

বুড়ো হলে (Poem)

বুড়ো হলে হাটতে হয়। হাটতে হাটতে বুড়ো হতে হয়। তারপর বুড়োদের ভিড়ে থাকতে থাকতে শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। বাঁকা হাড়ে বোঝা বোয়া যায় না, তাই সচল পৃথিবী বাঁকা হাসে।সে হাসিতে কী যে থাকে তা কেবল বুড়ো হাড় বুঝতে পারে, নির্মোহ পৃথিবী সে সব দেখে না। এসব ভাবনা যখন তিনি উগরাচ্ছিলেন চোখের কোনে জলের মত কি যেন চিকচিক করছিল, সেখানে কোন স্বপ্ন ছিল না। 24/04/24

পিছুটান ( Poem)

আজ সকালে কোন সূর্য ওঠে নাই তবু সে হামাগুড়ি উঠছিল মেঘের আড়ালে। ঠিক মধ্যি বেলায় ফিক করে হেসে ছিল। তারপর টাল সামলাতে না পেরে ঢলে পড়লো আর গড়াতে গড়াতে, গড়াতে গড়াতে চললো খাদের বিকালে। আমিও গড়াচ্ছি বহুকাল, হাসি দুঃখ লালসার সমুদ্র পেরিয়ে থমকে আছি খাদের বিকালে। অনন্ত অন্ধকার সামনে। ঝুপ করে ঝরে যাব সংকেত বিহীন। তবু পিছনের মায়াবী কন্ঠস্বর বড় ভাল লাগে।। 23/04/24

সকালে চোখ মেলে( Poem)

ফুসফুসকে খাদ্য জোগালাম। ফুসফুস রক্তকে নির্দেশ দিল, ঘরে ঘরে পৌঁছে দাও আজকের খবর। কোষেরা তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে নিশ্চিন্ত হল, যাক আজ আর চিন্তা নেই। দুয়ারে দুয়ারে এখন চিন্তাহীন খোরাক। আমার ভবিষ্যত নিয়ে এখন চলছে প্রতিযোগিতা। পাঁচ বছর পর পর এমন প্রতিযোগিতা আবার হবে, আবার দুয়ারে দুয়ারে হাসি খেলে যাবে হামাগুড়ি দিয়ে। পাখা ঘুরবে অহরহ, আমার জগত চোখ মেলার অবকাশ হীন।। ২৩/০৪/২৪

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

কথোপকথন

(আজ পয়লা বৈশাখ,১৪৩১। কিছুদিন ধরে একটা গল্পের ছক তৈরি করতে চেষ্টা করছি। এখনো বাগে আনতে পারিনি।কবে শেষ হবে জানিনা। বছরের প্রথম দিন ঐ লেখা আপনাদের সামনে রাখলাম, যদি কেউ কিছু পরামর্শ দেন...)
 দাদু নাতির কথোপকথন।/ মাটি 
 টেলিগ্রাম সদৃশ হোয়াটস অ্যাপ খবর পেলাম গিন্নির কাছ থেকে: দেশ থেকে নাতি এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, তাড়াতাড়ি চলে এসো। সব প্রোগ্রাম বাতিল করে রেলের জরুরী টিকিট কেটে ফিরে এলাম বাড়ি। নৈনিতাল থেকে কলকাতা। সাতসকালে কলিংবেল বেজে উঠতেই দরজা খুলল আমাদের বংশের বাংলাদেশী সলতে, নাতি। তরতাজা যুবক। মন - বাটা দুশ্চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম : কি হয়েছে দাদাভাই, কি খবর ? চিন্তিত স্বরে বলল : বলবো বলেই এসেছি আর সাতদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি। আগে বিশ্রাম নাও, পরে বলছি। বিশ্রামের কথা বলে মনটাকে অবিশ্রান্ত করে তুলল। এ যেন ঝড়ের আগের ঝিমমারা অবস্থা। আশঙ্কা মনে রেখেই চুপ রইলাম। মুখোমুখি হলাম দুইজনে। : কেমন আছেন ছোট ঠাকুর্দা ? : ভাল আছে। আট একর জমিতে ফসল ফলে, ধানের ক্ষেতে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন দেশেই আছি। শুধু বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা নেই, মা - বাবা - দাদা - বৌদি নেই। কিন্তু ছোটভাই ভাল আছে। এক ছেলে ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে এক পাঞ্জাবী ছেলেকে বিয়ে করেছে, তাদের ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। একটাই সমস্যা তারা বাংলা বোঝেনা, বলতেও পারে না। : ভাল আছে ? খুউব ভাল খবর। দাদাভাই আমি সাতদিন ধরে ঠাম্মারে পাহারা দিচ্ছি। তবে লাঠি হাতে নিয়ে নয়, তোমার লাইব্রেরির বই হাতে নিয়ে। এই যে নীতিশ বিশ্বাসের লেখা "নৈনতালের পথে পথে" । ভারত স্বাধীন হয়েছে পাঞ্জাব এবং বঙ্গভূমি ভাগ করে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী আর বাঙ্গালী - দুজনেই তো উদ্বাস্তু, কিন্তু দুজনেই কি একরকম সুবিধা পেয়েছে ? লেখক লিখেছেন -
 " কংগ্রেস সরকার গণপরিষদে সিদ্ধান্ত করলো - পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুরা পাবে পরিবার প্রতি পনের একর জমি আর বাঙালিরা পাবে আট একর জমি। সঙ্গে আনুপাতিক হারে খয়রাতি ও কৃষি সরঞ্জাম। " তবে সবাই মানে বাঙ্গালী সব উদ্বাস্তুরা কি আট একর জমি পেলো? 
- "এরপর ১৯৭১ পর্যন্ত যে সব উদ্বাস্তু ভারতের অন্যান্য ক্যাম্প থেকে বা অন্যত্র পুনর্বসতী না পেয়ে এখানে এসেছেন তাঁদেরকে ৩ একর জমি ও বাসস্থান দেয়া হয়েছে। আরো পরে যাঁরা এসেছেন তাঁদের আড়াই একর জমি ও হাফ কোয়ার্টার দেওয়া হল। অর্থাৎ একটা আবাসনের ছোট বড় চারখানা ঘর কে দুভাগ করা হল। এরপর যাঁরা এলেন তাঁরা পেলেন দেড় একর জমি ও একখানা ঘর বা একটি বারান্দা। এমনকি কোথাও কেবল এক কাঠা, দেড় কাঠা ঘরের জায়গা মাত্র দেওয়া হল। এঁরাই ' উইদাউট ' নামে পরিচিত। ... যাঁদের অনেকেই বাঁচার তাগিদে আজও পাঞ্জাবীদের... বাঁধা মজুর। " 
এমন আক্রমণের মুখে পড়বো ভাবতে পারিনি। প্রতিআক্রমনের ভাবনায় বলতে চেষ্টা করলাম - : দাদাভাই, তবু তো স্বস্তির জীবন... তেতে উঠলো নাতি: কিসের স্বস্তি ভাই ? তথ্য বলতিছে, ১৯৫২ সালের উদ্বাস্তু নিহারেন্দু বিশ্বাস প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দৌড়ঝাঁপ, হা হুতাশ করেছে পুনর্বাসনের জন্য, অবশেষে ২০০০ সালে পেয়েছে। তাঁর জীবনটাই অতিবাহিত হল ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে! শুধু কি নীহারেন্দু বিশ্বাস? হাজার হাজার মানুষ আজও অসহায়, নাগরিকত্বহীন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা ঘুষপেটিয়া জীবন কাটাচ্ছে। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে তাঁর অস্তিত্ব হারিয়েছে, তোমার নাতনী আজ বাংলা জানেনা, বাংলা পড়ার অধিকার নেই। কোথাও কোথাও ' বাঙালি ' গালি হিসাবে ব্যবহার হয়। এই তোমার স্বস্তির জীবন ! আক্রমণ - প্রতি আক্রমণে বেলা বাড়তে থাকে। নতুন প্রজন্ম যেন খড়্গ হস্ত, দেয়াল থেকে আমার পিঠের দুরত্ব কমতে থাকে। আলোচনা চলতে থাকে... ###
 "কেন, দেশ ছাড়বো কেন? এটা আমার দেশ, আমার মাতৃভূমি।" বাংলাদেশ থেকে আমার বাড়িতে এসেছে আমার সম্পর্কিত এক নাতি। তারুণ্যে ভরপুর। ওর বাবা একদা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিল, জগন্নাথ হলের আবাসিক। মুক্তিযোদ্ধা। বাবার মানসিক কাঠিন্য তার মধ্যে বিদ্যমান। খোঁজ নিচ্ছিলাম ঢাকার, গ্রামের বাড়ির তথা দেশের। সেই দেশ যে দেশ আমি পঞ্চাশ বছর আগে ছেড়ে এসেছি, যাকে ভুলবার জন্যে মাতৃভাষার আজন্ম লালিত টান পাল্টাতে চেষ্টা করেছি, যথার্থ গাঙ্গেয় ভাষা রপ্ত করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের সাথে আলাপচারিতায় সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ভুলে থাকা ভাষা বিনা বাঁধায় বেরিয়ে আসে, শৈশবের পথ ঘাট নদী নালা হাজির হয়, আমি ডুবে যেতে থাকি। - সবাই যে আসে। সাতচল্লিশের পরে এসেছে, একাত্তরের পরে এসেছে, এদেশের আইনের কড়াকড়ি হওয়া সত্ত্বেও এখনো আসছে। তোমার গ্রামের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, প্রায় প্রতি ঘরের ছোটরা সীমানা পেরিয়েছে। আলোচনা চলতে থাকে। ### বারো ভূঞার বাংলা কবে বঙ্গভূমি হলো ? বহিরাগত হানাদার তথা শাসকেরা বারবার এসেছে এই ভারত উপমহাদেশে। কিন্তু বহু বিভক্ত গাঙ্গেয় বঙ্গভূমি তাদের অধরা থেকেছে। স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছে বাংলার শাসকগণ। অবশেষে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ( ১৩৪২ - ১৪১৪) সমগ্র বাংলার ক্ষমতায় এসে বাংলার বিভিন্ন বিভাগকে একত্রিত করেন এবং সমগ্র প্রদেশকে " বাঙলা" নামে অভিহিত করেন ও সমগ্র অধিবাসীদের "বাঙ্গালী" নামে ভূষিত করেন। অতঃপর তিনি সমগ্র বাঙলা প্রদেশের সেনাবল ও জনবল দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে স্বাধীন রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হলেন। ১৭৫৭ সালে বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরজউদ্দৌলা পরাজিত হন ইংরেজ বণিকদের কাছে। বাঙলা তার স্বাধীন সত্ত্বা হারায়। তখনো, কয়েকশো বছরের মুসলিম শাসনের পরও বাঙালি জাতি বাঙালি ই ছিল, হিন্দু বা মুসলমান পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। এবং ইংরেজ শাসকদের দুশো বছরেও বাংলা ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ ছিল না।ইংরেজ শাসকরা ১৯৪৭ সালে বাঙলাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। শুধু পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ হয় না, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। বাঙলার মানুষের বাঙ্গালী নাম বিপন্ন হয়ে ওঠে, তাদের পরিচয়ের কাঠামোয় ধর্ম ঢুকে পড়ে। বাঙালিত্ব ছেড়ে তারা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান পরিচয়ে আত্মতুষ্টি বোধ করে। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া সময়েও বাঙলা ছিল, বাঙ্গালী ছিল। মহাস্থান গড়, কোটালীপাড়া দুর্গের/রাজ বাড়ির উপস্থিতি তার নমুনা দেখায়। গঙ্গারীডি - তত্ব এবং তথ্যসহ বিস্তৃত ধারণা দেয়। সুদূর অতীত থেকে এই যে লড়াকু মানুষের অবস্থান তা একটা বিষয় জানান দেয়, রাজা, রাজ্যপাট সব কিছু হারিয়ে গেলেও মানুষ তাদের ভূমি ছেড়ে কখনো চলে যায়নি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বারবার হেরে গিয়েও ভূমির অধিকার হারায়নি। সেই ভূমির অধিকার আমরা স্বেচ্ছায় হারালাম, পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকার আমরা রাখতে পারলাম না। কেন রাখতে পারলাম না? বাঙ্গালী থেকে আমাদের ধর্মীয় পরিচয় যখন প্রাধান্য পেলো আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করলাম, খুনোখুনি করলাম এবং মাটির অধিকার ছেড়ে ভাসা কচুরিপানার জীবন বেছে নিলাম। কি সেই ধর্ম? বাঙলার অধিবাসীরা ছিল অনার্য। উত্তরবঙ্গে ছিল পৌন্দ্রদের আধিক্য, দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে চন্ডাল তথা নমঃশূদ্রদের। প্রাক বৌদ্ধ যুগে কোন ধর্মের খোঁজ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ বাঙলার অধিবাসীরা ছিল বৌদ্ধ বা জৈন। আর্যবাদী হিন্দুদের উৎপীড়ন এবং মুসলমান ধর্মের জাতপাতহীন উদারতা অনার্যদের ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে নিয়ে যায়। বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম তাদের বাঁচাতে পারে না তাই অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যায়। বাকিরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ফলে বল্লাল সেন ও তার পরবর্তী রাজাদের সিদ্ধান্তে তারা চন্ডাল বা নিচু জাতের মানুষ হয়ে যায়। আমাদের অবস্থান - প্রাকৃতিক ধর্ম থেকে বৌদ্ধ বা জৈন। শাসক বদলের সাথে ধর্ম বদলায়, একদল মুসলিম অন্যেরা নিচুজাত - চন্ডাল বা পৌন্দ্র তার সঙ্গে শাসক/ব্রাহ্মণ বিভাজিত অনেক ছোট ছোট জাতি। জীবনের প্রয়োজনে বাঙ্গালী ধর্ম পাল্টালো কিন্তু জন্মভূমি পাল্টালো না। স্বাধীনতার নামে বাঙলা ভাগ হোল। সংখ্যা গরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিরা বাংলা ভাগ না চাইলেও ইংরেজ ভাগ করলো। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভদ্রলোক তথা বর্ণহিন্দুরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে জীবনপণ করেছিল। কারণ তারা দেখেছিল দেশভাগের আগে তপশিলি ফেডারেশান ও মুসলমানের জোট, যে জোট তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে দেয়নি। তাই জনমতে হেরেও ইংরেজ শাসকদের প্রভাবিত করে বাংলা ভাগ করতে সফল হয়। আর বাংলার তপশিলিরা দুই বাংলা থেকেই ক্ষমতার অধিকার হারায়। হরি চাঁদ ও গুরুচাঁদ এর শিক্ষা আন্দোলন তার বংশধরের ভুল নেতৃত্বে পথ হারায়। বাঙলায় জমিদার - জোতদার যারা ছিল তারা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ হওয়ার পর ধীরে ধীরে সরে পড়েছে বাঙলার পশ্চিম অংশে। তারা তো পরের ধনে পোদ্দারী করতো। কিন্তু কী ছিল বাঙলার ছিন্নমূল মানুষের ? সাধারণ মানুষ যাঁরা মূলত কৃষিজীবী তপশিলী সম্প্রদায়ের। তাঁদের ছিল কিছু জমি, কারো ছিল শুধু বাস্তুভিটা। সেই মাটির ভর ছেড়ে কোথায় যাবে তাঁরা ? দেশভাগ তাঁদের ভাসমান কচুরিপানা করে দেবে, একথা বুঝতে পেরেছিলেন তপশিলী সমাজের পরমহিতৈষী গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবশিষ্য যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দেশভাগ রুখতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু সঙ্গী পেলেন কাকে ? " ভারত সহ বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মনে প্রাণে মানতে পারলেন না যোগেন্দ্রনাথ। অবহেলিত মানবগোষ্ঠীর মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত যোগেন্দ্রনাথ প্রমাদ গোনেন। তাঁর আশৈশবের স্বপ্ন ও সাধনা বুঝি বিফলে যায়। তিনি ভাবেন, এদের মুক্তি তো সুদুর পরাহত। ষড়যন্ত্রকারীদের দেশ বিভাগের সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার ফল, তফসিলীদের বেঁচে থাকার পথ চিরতরে অবলুপ্ত। না, কিছুতেই এ ষরযন্ত্র মেনে নেওয়া যায় না। একে ব্যর্থ করতেই হবে। উদারচেতা ও নির্ভীক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্রোহের দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠেন। দেশজোড়া দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত দাবী করেন "অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা”। সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, সভা-সমিতি, সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারপত্রের মাধ্যমে আন্দোলনকে জনমুখী করে তোলার জন্য ব্যপক ও সর্বাত্মক প্রয়াস চালান। উল্কার মত ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একমাত্র নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া আর কোন নেতা যোগেন্দ্রনাথের আন্দোলনের সমর্থন বা সহযোগিতা জানালেন না। " - (মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, পৃষ্ঠা ১১৬) 

 দেশ ভাগ হোল আর আমরা তপশিলি মানুষেরা হঠাৎ হিন্দু হয়ে গেলাম। আমরা ভুলে গেলাম হরি - গুরু চাঁদের বেদ বিরোধী মতবাদের কথা, ভুলে গেলাম গুরু চাঁদের এই স্বাধীনতা তথা ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতার কথা। ভুলে গেলাম চৌদ্দ পুরুষের জন্মভূমিতে টিকে থাকার লড়ইয়ের ইতিহাস। অভিজাতদের প্ররোচনায় হিন্দুত্বের টগ বগ মোহে ভিটে মাটি ছেড়ে দিকশুন্যপুরে চললাম। ##

 খণ্ডিত বাংলা স্বাগত জানাল। তবে চালুনির ব্যবস্থা চালু রেখে। বর্ণহিন্দু দের জায়গা হলো বাংলায় আর তপশিলিরা ছাগল মুরগির মতো বস্তা বন্দি হয়ে পাচার হলো দন্দকারণ্য, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। বাংলার বাইরে গিয়ে তারা বাঙালিত্ব হারিয়েছে। মাতৃভাষা শেখার সুযোগ আজ তাদের নেই। অনেক বছর পর, বাংলা ভূমিতে ফেরার বাসনা নিয়ে একদল মানুষ ফিরে এসেছিল, আশ্রয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল সুন্দবনসংলগ্ন মরিচ ঝাঁপি দ্বীপে। বাংলার বর্ণবাদী তথাকথিত হিন্দু শাসকরা সেই দ্বীপ চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে নৃশংস ভাবে খুন করেছে । পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় উদ্বাস্তুদের থামানো হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশকে বেশ সফলভাবে ফিরিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সেই রকম একটি দলকে আমি হাসনাবাদ স্টেশনে দেখি, যারা ফেরৎ ট্রেনে ওঠার জন্য সরকারী অফিসে লাইন দিয়েছে স্বেচ্ছায়। তারা প্রায় প্রত্যেকেই তিন-চার দিন খায়নি। তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া গেছে স্রেফ ক্ষুধার অস্ত্রে। তারা গোটা পশ্চিমবাংলাকে অভিসম্পাত দিতে দিতে ফিরে গেল।” -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: মরিচঝাঁপি সম্পর্কে জরুরী কথা। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, নিরঞ্জন হালদার সম্পাদিত "মরিচঝাঁপি”। পূঃ ১৭)। 
 যে সমস্ত পরিবার আজ ওখানে (দণ্ডকারণ্যে) ফিরে আসছে, তাদের প্রায় সকল পরিবার থেকে শিশু অথবা বৃদ্ধ অথবা দুই-ই তাঁরা পথে পথে চিরদিনের মতো হারিয়ে এসেছেন। তাঁদের শোেক, দুঃখ বোধও এই প্রচণ্ড আঘাতে ও প্রতারণায় বিবশ। ফেরৎগামী ট্রেনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ২/৩ জন করে অফিসার পাঠানো হচ্ছে শরণার্থীদের তদারকি করার জন্য। তাঁদেরই মুখে শুনলাম, ফিরবার পথে মৃত শিশুদের ও বৃদ্ধদের তাঁরা ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছেন, পরবর্তী কোনো স্টেশনে তাদের সদগতি করার অপেক্ষা রাখেনি।” -পান্নালাল দাশগুপ্ত, যুগান্তর, ২৫ জুলাই, ১৯৭৮।। ##
যে কয়জন বেচেছিল তাদের আবার ফেরত যেতে হয়েছে সেই দণ্ডক অরণ্য। ##
 আজ দেশ ভাগের ছেয়াত্তর বছর পেরিয়ে দেশভাগের কুশীলবরা অমৃত মহোৎসব পালন করছে, দেশভাগ- দিবস পালনের দিন ক্ষণ নিয়ে মহাউল্লাশে কাড়াকাড় করছে তখন কেমন আছেন সেই হিন্দুত্বের মোহময় তপশিলিগন?
 Quote from CAA 
 নাগরিত্ব নিয়ে হাহাকার করছেন, জমির অধিকার পাচ্ছেন না, আসামে বেনাগরিক হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পচে মরছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (!) বর্ডারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঘেঁটে চলেছে রাজনৈতিক ভোলবদল। দেশভাগের প্রতিশ্রুতি ছিল - যতদিন একজন হিন্দু/মুসলমান দেশান্তরিত হতে চাইবে, চুক্তি বলবৎ থাকবে।

 ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নতুন চুক্তি হলো ইন্দিরা - মুজিবের মধ্যে। আগের চুক্তি উবে গেল, একাত্তরে আটকে গেল দেশান্তর। বাংলাদেশের পটপরিবর্তন হোল কিন্তু চুক্তির পরিবর্তন হোল না। তাতে অবশ্য বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে আসার স্রোত কমলোনা, বয়েই চললো। শাসক কিন্তু থেমে থাকল না। আরো কড়া আইন করলো ২০০৩ সালে। সেই আইন আরো শক্ত পোক্ত হয়ে সময়সীমা বেঁধে দিল ২০১৪ সাল। এরপরে কোন কেউ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্থান থেকে এলে নাগরিক হবার অধিকার পাবেনা। একটু স্বস্তি পাওয়া গেল , ২০১৪সাল! এটা একটা ললিপপ। শুনতে ভাল, কাজে নয়। ১৯৪৮ থেকে ২০১৪ এই সময়কালের মধ্যে যিনি আসবেন তিনি হিন্দুত্বের রসময়তায় ভারতে স্বাগত তবে ছোট্ট একটা শর্ত আছে, বৈধ কাগজ পত্র দেখাতে হবে। বৈধ কাগজ দেখাতে পারেনি বলে আসামে চৌদ্দ লক্ষ অবৈধ নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত। কী হবে বাকিদের যদি সরকারের কাছে বৈধ কাগপত্রগুলো দেখাতে না পারে ?
 : আচ্ছা দাদু, ধরে নিলাম এই কয়েক কোটি মানুষ অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু এরা সবাই তো হিন্দু, হিন্দুত্ব কি এদের কিছুই দেয়নি ?
 : হিন্দুত্ব মনোবল যুগিয়েছে। কারণ এদেশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। পথে ঘাটে কেউ গালাগালি দেয় না, সংখ্যালঘুর হিন্যমন্যতা নিয়ে চলতে হয়না। : কিন্তু তুমি তো হিন্দু নও। তুমি তো তপশিলিভুক্ত শুদ্র তথা নমঃশূদ্র তথা অন্তজশ্রেণী অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম বহির্ভূত মানুষ যাদের মনুস্মৃতি কীট বা পোকামাকড়ের মত ঘৃন্য বলে উল্লেখ করেছেন।
 : গভীরভাবে ভাবতে গেলে তাই। কিন্তু ধর্মীয় পোষাক বা পরিচয় তো পেয়েছি। : দাদু, এই মেকি পরিচয় তোমাকে, তোমাদেরকে কতটা আত্মবিশ্বাস দেয় জানিনা। তবে সত্যি এই, তুমি হিন্দু নও, তুমি ঘৃণিত শুদ্র, তুমি দেশহীন। হিন্দুত্বের মোহে তোমরা নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছো।##
 : দেখ দাদু ভাই, একটা সত্য তো মানবে তোমরা ওখানে ভাল নেই, ক্রমাগত ভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হচ্ছে? : আচ্ছা দাদু, মাতৃভূমি ত্যাগ করে তোমরা ভাল আছো তো ? তোমরা কোনভাবে অত্যাচারিত হচ্ছো না তো? : মানে কী বলতে চাইছো? : বাংলা ভাগ বাংলা সাহিত্যে বিষাদ সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের ' অন্য ইহুদি ' গল্পের বিষ্টুচরণ ফেরু মিয়ার কাছে অত্যাচারিত মেয়েকে বাঁচাতে দেশ ছাড়ে, রেল লাইনের পাশে বস্তিতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বাঁচাতে পারলো?
 " ... চারজন যুবক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর পথরোধ করে দাঁড়াল। খবরদার, এক পাও নড়বি না। গলাটা চেনা। চুল্লুর ঠেকের পাশ দিয়ে আসতে যেতে অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু গলাটা আজ যেন ফেরু মিয়ার মতো শোনাল? ... কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, - কারা তোমরা ? কী চাও ? ... একজন এগিয়ে এসে পাইগান ঠেসে ধরলো বিষ্টুচরণের বুকে।... সেই উন্মত্ত মাতাল ' ভদ্র সন্তানেরা ' কুঁড়ের মধ্যে ঢুকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল রুনু, শিউলি আর চেন্নোর বয়সি সব মেয়েদের। দানবীয় শক্তিতে তুলে নিয়ে গেল লাইনের ওপাশের অন্ধকারে। ... ফ্যাল ফ্যাল করে এর - ওর মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকালেন বিষ্টুচরন। তারপর হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। - ওরে বেজো, বেজোরে... তোরা কিসীর জন্নী দ্যাশ ছাড়িছিলি? ... বল, বল তোরা... কোথায় আমাদের সত্যিকারের দ্যাশ ? "
 আবার কবি বিষ্ণু দে লেখেন - " এখানে ওখানে দেখা দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায়/ পার্কের ধারে শানে পথে - পথে গাড়ী বারান্দায়/ভাবে ওরা কী যে ভাবে! ফেরে খোঁজে দেশ/এইখানে কেউ বরিশালে, কেউ কেউ - বা ঢাকায় "
 শরণার্থী বা উদ্বাস্তু জীবনের দু টুকরো চিত্র। এমন হা - হুতাশ, কান্নার বিষাদ সিন্ধু গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সিনেমায়। : আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে ও ধরা পড়েছে স্বজন হারানোর যন্ত্রনা। যে ধর্মের ভয়ে, মুছলমানদের দোষারোপ করে তোমরা চলে এলে তাঁরাও তোমাদের জন্য চোখের জল ফেলেছে। সৈয়দ শামসুল হক ভারাক্রান্ত মনে লেখেন : 
 " ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো। কুড়িগ্রামে আমার সকল বন্ধুই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাদের প্রায় সবাই রাতারাতি ভারতে চলে গেলো। ১৯৪৮ সালে বালক আমি আক্ষরিক অর্থে একা এলাম ঢাকায়। ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারে তখনো হিন্দু সম্প্রদায়েরই বাস, তাদের সঙ্গে আমার একটা স্নেহবন্ধন গড়ে উঠছিলো, কিন্তু হঠাৎ ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো ঢাকায়। তারপর- হিন্দুদের দেশত্যাগ; সীমান্তের ওপার থেকে আসা নতুন অচেনা মুখের প্রতিদিন দেখা; ব্যক্তিগত জীবনে আমি ভীষণ একা; ইশকুল শেষে আমি পথে পথে হাঁটি, নদীতীরে বসি, নৌকোয় দূর দূর গাঁয়ে চলে যাই; ...." (মার্জিনে মন্তব্য)। 
 : ছোট ঠায়ুর্দা দ্যাশ ভাগের সাথে সাথে বর্ডার পেরোল। চলে গেলেন কোন দণ্ডক অরণ্যে। বাঘ ভাল্লুকের খাবার বানায়ে জঙ্গলে ছেড়ে দেলো বাঙালিদের। " লড়িতে করে গুচ্ছ গুচ্ছ লোক এনে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হল। না ঘর , না খাবার , না কোন সুস্থ ব্যবস্থা। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসহ দিন অতিক্রম করে এখানের বনজঙ্গল কেটে অনাবাদী জমিকে বাসযোগ্য করেছি আমরা।.... যেখানে এনে ফেলা হল সেখানে ১০০ বছরের অশ্বথ, বট, অর্জুন গাছের ভীষণ জঙ্গল। হিংসাত্মক জন্তুজানোয়ার, বাঘ,ভাল্লুক, দাঁতাল শুয়োর, বুনোহাতি আর ভয়ানক ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী দুর্দান্ত মশা। কত মানুষ অনাহার অর্ধাহারে আর ম্যালেরিয়াসহ দুঃস্থ অসুখে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল তার লেখা জোখা নেই। " ( নৈনিতালের পথে পথে, নীতিশ বিশ্বাস )। 
 তারপর তুমি ছেড়ে এলে দ্যাশ। আস্তানা গড়ে তুললে রেল লাইনের পাশে। বনগা থেকে ট্রেনে আসবার সময় দেখলাম রেলের দুপাশে গিজগিজ করছে টালি টিনের ঘর। এমন কোন ঘরে হয়তো তোমরা ছিলে । তোমাদের সব খবর পেত বড় ঠাম্মা। মা মরা দুই দেওর ছিল তাঁর সন্তানের মত। তোমরা নেই বলে ঠাম্মা তাল পিঠা খায় না, আম দুধে খায়না, পৌষের পিঠে খায়না। এখনও তোমাদের জন্য চোখের জল মোছে। এখন আর ভাল দেখতে পারে না। তবু তোমাদের দেখার জন্য পথ চেয়ে আছে। ফের বলে - তোমরা যে চোখে আমাদের দেখ আমরা সে ভাবে ভাবিনা, অন্তত আমি ভাবিনা। আচ্ছা দাদু তোমার দেশে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই কি ভাল আছে ? এরা কি সংখ্যালঘু হবার জন্য কোনভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে না? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে, তারা কি সংখ্যাগুরুর সমান অধিকার পায়? আর সেই কারণে সবাই কি মাতৃভূমি/ পিতৃভূমি ছেড়ে পালায়? না, পালায় না। লড়াই করে, লড়াই করে বেচেঁ থাকে। আমাদের পূর্বপরুষরা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ থাকা সত্বেও বেচেঁ ছিল। বাংলার লাঠিয়ালরা যুগ যুগ ধরে বাংলা শাসনের মধ্যে সমাজকে সুস্থির রেখেছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর তারা হতোদ্যম হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে তোমাদের দেশত্যাগ। যদি কেউ দেশত্যাগ না করতো আমরা আমাদের অধিকারের লড়াইয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হতাম। তোমরা জন্মভূমি ছেড়ে ভাসমান কচুরির মত বেনাগরিক হয়েছো, আমাদের দুর্বল করেছো। দাদু, ধর্মের জন্যে মানুষ বাঁচে না, জীবনের প্রয়োজনে ধর্ম আসে ধর্ম যায়। তাই ধর্মের জন্যে দেশ ত্যাগ করবো না, প্রয়োজনে ধর্ম ত্যাগ করবো। বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার ধর্ম। 

 আমি থ' হয়ে থাকি। ভাবতে থাকি।

শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৪

আমি লিখতে চাই

আমি লিখতে চাই ( সামনে নির্বাচন, ঘটনা - অঘটনার ছড়াছড়ি। সখের লেখক, কিনতু কিছু লিখছিনা, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ভাবলাম - একটা note লিখে রাখি, পরে লেখার চেষ্টা করবো। কিনতু note আমাকে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে যেখানে গিয়ে থামলো, তারমধ্যে কেমন একটা কাব্যি কাব্যি গন্ধ। সময় পেলে একটু পড়ুন, আর পারলে একটা মন্তব্য..) আমার কবিতা লিখতে খুব ইচ্ছে করে, ভালবাসার কবিতা। লিখি, লিখতে চেষ্টা করি কিন্তু আমার ভালবাসা প্রকাশ করতে পারি না। আমি আমাকে ভালবাসি, পরিবারের প্রতিজনকে ভালবাসি, সমাজের মানুষকে ভালবাসি, দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ এবং পৃথিবীর সব প্রাণকে ভালবাসি। আমার ভালবাসার কথা প্রাণ উজাড় করে বলতে চাই, লিখতে চাই। আমি তোমাকে বলতে চাই, তাঁকে বলতে চাই, সে কে বলতে চাই কবিতার ভাষায়, সুন্দরের ভাষায়। আমার তোমার সে র ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখার মন্ত্র জানিনা কিনতু চাই শান্ত সকালের মত বেঁচে থাকি আমি তুমি সে, বেঁচে থাকুক গাছ নদী আকাশের পৃথিবী। আমি লিখতে চাই আগুণ ঝরা কলম দিয়ে আমার জ্বালা তোমার জ্বালা সে র জ্বালা পৃথিবীর জ্বালা। তারপর জ্বলে যেতে চাই জ্বালানো মশাল কেউ ধরবে বলে। ১২/০৪/২০২৪

বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৪

short story সন্ধিক্ষণ


সন্ধিক্ষণ ( #shortstory)
এক, দুই, তিন, চার। বন্ধু ওরা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে। নদীর জোয়ার ভাটার সাথে বড় হয়েছে। নদীর চড়ায় কাঁকড়া ধরা, অন্যের বাগানের ফল চুরি করা অথবা মেয়ে দেখে কৃষ্ণ সাজায় ওরা একে অপরের পরিপূরক। নোনামাটির আজন্ম স্বাদে ওদের বন্ধুত্ব বড় খাঁটি।
#shortstory 
ভাই ফোটার দিনে এক-এর দিদি ফুল-দুব্বা নিয়ে চারটে পিঁড়ির সামনে অপেক্ষা করে। দুই এর বোন চারটে পিঁড়ি পেতে রাখে। তিন সারাদিন বাড়ি ঢোকে না। ওর বাড়ি পুজোর বালাই নেই। চার এর মায়ের স্বস্তি নেই। অবদারের ঝামেলা পোয়াতে না পেরে ফোঁটা দেয় মা-ই। পাড়ার-বেপাড়ার সব রাধাই সেদিন ওদের বোন হয়ে যায়। 
#writingblog 

গাঁয়ের মানুষ ওরা। শহর ওদের ছায়া থেকে শতেক মাইল দূরে। নোনা মাটির দেশ। দক্ষিণা হাওয়া সমুদ্রের ঠাণ্ডা। যেমন করে আনে তেমনি জঙ্গলের মধ্য থেকে দুসংবাদও বয়ে আনে কখনো কখনো। বাঁচার তাগিদেই জঙ্গলে যেতে হয় তাদের। জীবিকার জন্যে সুন্দরী, গেঁয়ো, গড়ান তাদের ডাকে। জঙ্গলের মধু যেমন তেমনি জঙ্গল ঘেঁষা নদীর চড়ায় মাছ ধরার লোভ। কুমীর বা বাঘের টানে দু'এক জন হারিয়ে গেলেও ওরা আবার যায়। যেতে হয় বলেই বার বার যায়।

তিনের শাদি ঠিক হয়। এক, দুই, চার কিছু পরামর্শ করে। তিনের শাদিতে কিছু উপহার দেওয়া চাই তাদের। কিন্তু টাকার টানাটানি তো চিরকালীন। বাঁধের মাটি কাটার কাজ নেয় কয়দিন। প্রত্যাশার বহু দূরে পড়ে থাকে তাদের আয়। হঠাৎ করে জঙ্গল থেকে কাঠ চুরির কথা ভাবে তিন জন। তিনকে এ অলোচনায় নেয় না তারা। জঙ্গলে যাবে। দু'চারটে গাছ কাটতে পারলেই কাজ ফতে তাদের। তিন-এর বিবিকে চমকে দেবে তারা। সেই মত একদিন ভোরে নির্দিষ্ট নৌকার ঘাটে চলে আসে তিন জন। দা-কুড়ুল নিয়ে ভটভটিতে উঠে আবিষ্কার করে তিনকে। সঙ্গে যাবে বলে আগে ভাগেই এসে বসে আছে সে। কচি হবু বিবির স্বপ্নে বিভোর হয়ে বন্ধুদের দল ছাড়তে নারাজ সে। তাকে অনেক করে বোঝায় ওরা। একটা বিপদ হয়ে গেলে মেয়েটার করুণ, অসহায় অবস্থার কথা বলে। কিন্তু কাজ হয় না। অনড় থাকে তিন। এর জন্যে বন্ধুদের বিপদের থেকে দূরে সে থাকতে পারে না। সুখের সময়ের সাথী যদি হতে পারে, সাথী হবে দুঃখেরও।
: তুই বাড়ি ফিরে যা, চোখে সুরমা নিতে নিতে হবু বিবির স্বপ্ন দেখ...
: তাহলে তোরাও ফিরে চল..
: আমাদের যদি বিপদ হয় তোর বিবির কি হবে..
: যদি সপ্তমুখিতে ঝড় উঠে....
: যদি বন পাহারাদারদের কাছে ধরা পরি...
: যদি দক্ষিণরায় কৃপা করে....


অগত্যা নৌকা ভাসায় চারজনেই।

ভাল কাঠের সন্ধানে একটু গভীর জঙ্গলে ঢুকতে হয় তাদের। আঁকা-বাঁকা নদী হয়ে খাড়ির মধ্যে নৌকা ঢোকায় তারা। সহজে আয় করতে গিয়ে জীবনটাকে সহজ করে তোলে। সরকারী বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে ঢোকে তারা। তাই ভয় তাদের তাড়া করে সব সময়। একদিকে যেমন সরকারী নজরদার বনকর্মীদের এড়াতে হয়, তেমনি এড়াতে হয় বনের রাজা দক্ষিণ রায়ের রক্ত চক্ষু। একান্তই জীবনটাকে মুঠোয় করে জঙ্গল হাসিল করতে যায়।

চার জনেই জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। কুড়ুল নিয়ে একজন কাটতে থাকে গাছ। বাকি তিনজন লাঠি দা হাতে নজর রাখে চারিদিকে। পাহারা দেয় বন্ধুকে। পালা করে কুড়ুল নেয়, তারা। কাটা গাছের ডালপালা ছোট নৌকায় তোলবার ব্যবস্থা করতে থাকে। কিন্তু বাঘের চোখ এড়াতে পারলেও বনকর্মীদের নজর এড়াতে পারে না। তাদের প্রয়োজনীয় বখরা পাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরে তারা। বাঘের থাবা থেকেও এদের থাবা এড়ানো বড় মুশকিল। গাছ কাটার শব্দ শূন্যে মিলাতে মিলাতে এদের কানে পৌঁছায়। হাওয়াই আবার বনকর্মীদের আগমন বার্তা বয়ে আনে। তাড়াতাড়ি সব ফেলে চম্পট দেয়। যেহেতু জঙ্গল ঘিরে বেড়ে ওঠা মানুষ এরা, তাই বনকর্মীদের ফাঁকি দিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। 
কিন্তু কাটা গাছ তাদের ঘুমাতে দেয় না। তাই আবার একদিন বেরিয়ে পড়ে চারজনে। চুপিসারে জঙ্গলে ঢোকে। ফেলে আসা গাছের গুঁড়ি নৌকায় তোলে। ফিরে আসে নিরাপদে। তারপর ধূমধাম করে উপভোগ করে তিনের শাদি।

ভরা কোটালে জল বাড়ে নদীর। গর্ভবর্তী মায়ের মত নিজের পরিধি ভুলে যেতে চায়  জলরাশি। আকাশে মেঘ জমে। উত্তুরে মেঘ দক্ষিণে যায়। জলের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়তে থাকে বাঁধের উপর। প্রকৃতি মেতে ওঠে বাঁধন মুক্তির খেলায়। পশ্চিম থেকে খবর আসে বাঁধ ভাঙ্গার। দক্ষিণ থেকে খবর আসে বাঁধ ভাঙ্গার। খবর আসতে থাকে চারিদিক থেকেই। চার বন্ধুর ব্যস্ততা বাড়ে। খবরের আগে যেন ছুটে চলে তারা। গ্রামবাসীকে সজাগ করে। কোদাল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় বাঁধের উপর। যেখানে ফাটল, যেখানেই উপচে পড়ে জল, সেখানেই বাঁধ মেরামতিতে লেগে যায়। ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি ফেলে উপচে পড়া জল অটকায়। কিন্তু পারে না। প্রকৃতির তান্ডবের কাছে হার মানে এক সময়। বাঁধ ছেড়ে তখন তারা মাঠে নামে। নোনা জলে ভেসে যাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। গরু-ছাগলগুলোকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়। অসহায় মানুষদের সহায় হয়ে ওঠে। এক এর বৃদ্ধ বাপকে পাঁজা কোলে করে জল ভেঙ্গে ডাঙার দিকে যায় তিন। দুই এর ঠাকুমাকে পাঁজা কোলে করে জল ভেঙ্গে ডাঙ্গার দিকে যায় চার। সব প্রতিবেশী একাকার হয়ে আশ্রয় নেয় স্কুল ঘরে বা পঞ্চায়েতে। বড় কড়াই ভর্তি খিচুড়ি তৈরী করে বন্ধুরা। পরিবেশন করে বন্ধুরা। তাদের বাপেরা মায়েরা, ভাইয়েরা, বোনেরা পাশাপাশি বসে খায়। শোয়। আকাশের দিকে তাকায়, নোনা জলে ডুবে যাওয়া মাঠের দিকে তাকায়। সবার আশা নোনা জলে একাকার। সবার জীবিকা খিচুড়িতে একাকার।
বামুন ঠাকুর পৈতায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেন: ও চাচি, আর কতক্ষণ নাকবেনে খিচুড়ি হতি ?
চাচি পান চিবোতে চিবোতে কয় : এই তো হইয়া গেলো প্রায়...

খেটে খাওয়া মানুষ সব। দিনভর তাই খাটতে হয়। কেউ জন-খাটে। কেউ মাছ ধরে। কেউ মাটি কাটে। কেউ ঘর বানাতে ব্যস্ত। কিন্তু সারা দিনের শেষে গ্রামের একমাত্র বাজারে হাজির সবাই। বাজার তাদের নিত্যদিনের মিলন-মেলা। বটতলা বা চায়ের দোকানে আড্ডা বসে তাদের। অনেকের সাথে এক থালাতে মুড়ি খায়। হাত বদল হয় বিড়ি-সিগারেটের। রাত বাড়ে, নেশার পরিধিও বাড়ে। দেশী মদের গন্ধে কখনো কখনো বাড়ি ফেরে তারা।

এমনি করেই দিন কাটে তাদের। চার বন্ধুর এক সত্তা হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ ভাল কাজেও তাদের পায়, খারাপ কাজেও তাদের এক সঙ্গে পায়। কোন বিভেদই ঠাঁই পায় না তাদের কাছে।

দুই-এর বাবা মারা যায় একদিন। অনভ্যস্ত সংসারের দায় চেপে বসে মাথার উপর। এক, তিন, চার ভরসা যোগায় দুইকে। শ্মশান থেকে শ্রাদ্ধ-সব কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তিন বন্ধু। ব্রাহ্মণ ডাকে, কলাপাতা সংগ্রহ করে এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে, কাঠ চেরে, চাল, ডাল কেনে বাজার করে। আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়। সামিয়ানা টাঙায়, রান্না করে। খেতে দেয়।

এক দল খায়। আরেক দল খায়। নিমন্ত্রিত মানুষেরা আসে, খায়-দায়, এবং চলে যায়। একসময় মানুষজন হালকা হয়। যারা বাকি থাকে, যারা অতি কাছের মানুষ তাদের সঙ্গে খেতে বসে ওরা তিনজন। ওরা বসে পাশাপাশি। একের পাশে চার চারের পাশে তিন। সামনে সাদা কাপড় পরে নেড়া মাথায় দাঁড়ায় দুই। তার বাবার পারলৌকিক মুক্তিদাতাদের সামনে বিনীত হয়।

গুঞ্জনটা শুরু হয় হঠাৎই। 
এক-এর বাবার অস্থিরতা বাড়ে। এদিক-ওদিক তাকায়। এদিক-ওদিক যায়। সমাজের কর্তা যাঁরা তাদের সাথে কথা বলে। ক্রমশ মুখটা গম্ভীর হ'তে থাকে। গলার পৈতায় হাত বোলাতে থাকে বামুন ঠাকুর। সমাজ সেবকদের সমাজ চেতনা বাড়ে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা মরিয়া হয়ে ওঠে। এক-এর অত্মীয়দের গুঞ্জন দুই-এর অত্মীয়দের দিকে যায়। দুই-এর আত্মীয়দের গুঞ্জন এক- এর আত্মীয়দের দিকে যায়। অবশেষে গুঞ্জন আর গুঞ্জনে সীমাবদ্ধ থাকে না। পৈতাকে অনেক বেশী প্রকাশ্যে নিয়ে আসে এক-এর বাবা। এক, তিন ও চার খেতে ব'সে পাশাপাশি। খেতে বসা এক-এর সামনে এসে দাঁড়ায় তার বাবা। কঠিন স্বরে বলে : এখান থেকে উঠে আয়। 
হকচকিয়ে যায় সবাই। হকচকিয়ে যায় চার বন্ধু। বিহ্বলতা কাটিয়ে সামান্য প্রতিবাদের সুরে জানতে চায় এক : কেন বাবা?

: এদের সাথে এক সঙ্গে বসে খাওয়া চলবে না তোমার।
 নির্দেশ দেন তিনি। 
: কিন্তু ...

কারণ আঁচ করে কিছু একটা বলতে চায় দুই। দুইয়ের কথা শেষ হয় না। 
বৃদ্ধ মানুষ এক-এর বাবা। উত্তেজনায় কাঁপছিলেন তিনি। দুইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে ওঠেন : তোমার বাপের শ্রাদ্ধ, তাই বলে তো সমাজের নিয়ম ভাঙতে পারিনা। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে শূদ্রের সাথে, মোসলমানের সাথে এক পাতে, এক পঙ্ক্তিতে খেতে পারিনা। নিচু জাতের সাথে, বেজাতের সাথে খাওয়া তো ধর্মচ্যুত হওয়া, সমাজচ্যুত হওয়া। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হবে না, জাত খোয়াতে পারব না কোনমতেই।

কলাপাতার উপরে ভাত ঠান্ডা হ'তে থাকে, মাথা নিচু করে বসে থাকে চার। চুপচাপ বসে থাকে তিন। নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে দুই। লৌকিকতার আড়ালে চাপা পড়ে তার বাবার পারলৌকিকতার চিন্তা। বাবার আজ্ঞায় সম্মোহিতের মত উঠে পড়ে এক। কিছুটা দূরে অনেকের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পৈতাধারী আরো কিছু মানুষের পাশে বসে পড়ে এক। 
কলার পাতা সামনে পড়ে, আলাদা। ভাত পড়ে, আলাদা। সে ভাতও ঠান্ডা হ'তে থাকে ক্রমশ।

Keywords: story, short story, writingblog, castsystem, hinduism, socialcancer, senior, goutamaalee.in , writings of goutamaalee 

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...