রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

কথোপকথন

(আজ পয়লা বৈশাখ,১৪৩১। কিছুদিন ধরে একটা গল্পের ছক তৈরি করতে চেষ্টা করছি। এখনো বাগে আনতে পারিনি।কবে শেষ হবে জানিনা। বছরের প্রথম দিন ঐ লেখা আপনাদের সামনে রাখলাম, যদি কেউ কিছু পরামর্শ দেন...)
 দাদু নাতির কথোপকথন।/ মাটি 
 টেলিগ্রাম সদৃশ হোয়াটস অ্যাপ খবর পেলাম গিন্নির কাছ থেকে: দেশ থেকে নাতি এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, তাড়াতাড়ি চলে এসো। সব প্রোগ্রাম বাতিল করে রেলের জরুরী টিকিট কেটে ফিরে এলাম বাড়ি। নৈনিতাল থেকে কলকাতা। সাতসকালে কলিংবেল বেজে উঠতেই দরজা খুলল আমাদের বংশের বাংলাদেশী সলতে, নাতি। তরতাজা যুবক। মন - বাটা দুশ্চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম : কি হয়েছে দাদাভাই, কি খবর ? চিন্তিত স্বরে বলল : বলবো বলেই এসেছি আর সাতদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি। আগে বিশ্রাম নাও, পরে বলছি। বিশ্রামের কথা বলে মনটাকে অবিশ্রান্ত করে তুলল। এ যেন ঝড়ের আগের ঝিমমারা অবস্থা। আশঙ্কা মনে রেখেই চুপ রইলাম। মুখোমুখি হলাম দুইজনে। : কেমন আছেন ছোট ঠাকুর্দা ? : ভাল আছে। আট একর জমিতে ফসল ফলে, ধানের ক্ষেতে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় যেন দেশেই আছি। শুধু বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা নেই, মা - বাবা - দাদা - বৌদি নেই। কিন্তু ছোটভাই ভাল আছে। এক ছেলে ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে এক পাঞ্জাবী ছেলেকে বিয়ে করেছে, তাদের ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। একটাই সমস্যা তারা বাংলা বোঝেনা, বলতেও পারে না। : ভাল আছে ? খুউব ভাল খবর। দাদাভাই আমি সাতদিন ধরে ঠাম্মারে পাহারা দিচ্ছি। তবে লাঠি হাতে নিয়ে নয়, তোমার লাইব্রেরির বই হাতে নিয়ে। এই যে নীতিশ বিশ্বাসের লেখা "নৈনতালের পথে পথে" । ভারত স্বাধীন হয়েছে পাঞ্জাব এবং বঙ্গভূমি ভাগ করে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী আর বাঙ্গালী - দুজনেই তো উদ্বাস্তু, কিন্তু দুজনেই কি একরকম সুবিধা পেয়েছে ? লেখক লিখেছেন -
 " কংগ্রেস সরকার গণপরিষদে সিদ্ধান্ত করলো - পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুরা পাবে পরিবার প্রতি পনের একর জমি আর বাঙালিরা পাবে আট একর জমি। সঙ্গে আনুপাতিক হারে খয়রাতি ও কৃষি সরঞ্জাম। " তবে সবাই মানে বাঙ্গালী সব উদ্বাস্তুরা কি আট একর জমি পেলো? 
- "এরপর ১৯৭১ পর্যন্ত যে সব উদ্বাস্তু ভারতের অন্যান্য ক্যাম্প থেকে বা অন্যত্র পুনর্বসতী না পেয়ে এখানে এসেছেন তাঁদেরকে ৩ একর জমি ও বাসস্থান দেয়া হয়েছে। আরো পরে যাঁরা এসেছেন তাঁদের আড়াই একর জমি ও হাফ কোয়ার্টার দেওয়া হল। অর্থাৎ একটা আবাসনের ছোট বড় চারখানা ঘর কে দুভাগ করা হল। এরপর যাঁরা এলেন তাঁরা পেলেন দেড় একর জমি ও একখানা ঘর বা একটি বারান্দা। এমনকি কোথাও কেবল এক কাঠা, দেড় কাঠা ঘরের জায়গা মাত্র দেওয়া হল। এঁরাই ' উইদাউট ' নামে পরিচিত। ... যাঁদের অনেকেই বাঁচার তাগিদে আজও পাঞ্জাবীদের... বাঁধা মজুর। " 
এমন আক্রমণের মুখে পড়বো ভাবতে পারিনি। প্রতিআক্রমনের ভাবনায় বলতে চেষ্টা করলাম - : দাদাভাই, তবু তো স্বস্তির জীবন... তেতে উঠলো নাতি: কিসের স্বস্তি ভাই ? তথ্য বলতিছে, ১৯৫২ সালের উদ্বাস্তু নিহারেন্দু বিশ্বাস প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দৌড়ঝাঁপ, হা হুতাশ করেছে পুনর্বাসনের জন্য, অবশেষে ২০০০ সালে পেয়েছে। তাঁর জীবনটাই অতিবাহিত হল ছিন্নমূল মানুষ হিসেবে! শুধু কি নীহারেন্দু বিশ্বাস? হাজার হাজার মানুষ আজও অসহায়, নাগরিকত্বহীন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা ঘুষপেটিয়া জীবন কাটাচ্ছে। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে তাঁর অস্তিত্ব হারিয়েছে, তোমার নাতনী আজ বাংলা জানেনা, বাংলা পড়ার অধিকার নেই। কোথাও কোথাও ' বাঙালি ' গালি হিসাবে ব্যবহার হয়। এই তোমার স্বস্তির জীবন ! আক্রমণ - প্রতি আক্রমণে বেলা বাড়তে থাকে। নতুন প্রজন্ম যেন খড়্গ হস্ত, দেয়াল থেকে আমার পিঠের দুরত্ব কমতে থাকে। আলোচনা চলতে থাকে... ###
 "কেন, দেশ ছাড়বো কেন? এটা আমার দেশ, আমার মাতৃভূমি।" বাংলাদেশ থেকে আমার বাড়িতে এসেছে আমার সম্পর্কিত এক নাতি। তারুণ্যে ভরপুর। ওর বাবা একদা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিল, জগন্নাথ হলের আবাসিক। মুক্তিযোদ্ধা। বাবার মানসিক কাঠিন্য তার মধ্যে বিদ্যমান। খোঁজ নিচ্ছিলাম ঢাকার, গ্রামের বাড়ির তথা দেশের। সেই দেশ যে দেশ আমি পঞ্চাশ বছর আগে ছেড়ে এসেছি, যাকে ভুলবার জন্যে মাতৃভাষার আজন্ম লালিত টান পাল্টাতে চেষ্টা করেছি, যথার্থ গাঙ্গেয় ভাষা রপ্ত করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের সাথে আলাপচারিতায় সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ভুলে থাকা ভাষা বিনা বাঁধায় বেরিয়ে আসে, শৈশবের পথ ঘাট নদী নালা হাজির হয়, আমি ডুবে যেতে থাকি। - সবাই যে আসে। সাতচল্লিশের পরে এসেছে, একাত্তরের পরে এসেছে, এদেশের আইনের কড়াকড়ি হওয়া সত্ত্বেও এখনো আসছে। তোমার গ্রামের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, প্রায় প্রতি ঘরের ছোটরা সীমানা পেরিয়েছে। আলোচনা চলতে থাকে। ### বারো ভূঞার বাংলা কবে বঙ্গভূমি হলো ? বহিরাগত হানাদার তথা শাসকেরা বারবার এসেছে এই ভারত উপমহাদেশে। কিন্তু বহু বিভক্ত গাঙ্গেয় বঙ্গভূমি তাদের অধরা থেকেছে। স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছে বাংলার শাসকগণ। অবশেষে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ ( ১৩৪২ - ১৪১৪) সমগ্র বাংলার ক্ষমতায় এসে বাংলার বিভিন্ন বিভাগকে একত্রিত করেন এবং সমগ্র প্রদেশকে " বাঙলা" নামে অভিহিত করেন ও সমগ্র অধিবাসীদের "বাঙ্গালী" নামে ভূষিত করেন। অতঃপর তিনি সমগ্র বাঙলা প্রদেশের সেনাবল ও জনবল দিল্লির সুলতানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে স্বাধীন রাজ্য গঠনে প্রয়াসী হলেন। ১৭৫৭ সালে বাঙলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরজউদ্দৌলা পরাজিত হন ইংরেজ বণিকদের কাছে। বাঙলা তার স্বাধীন সত্ত্বা হারায়। তখনো, কয়েকশো বছরের মুসলিম শাসনের পরও বাঙালি জাতি বাঙালি ই ছিল, হিন্দু বা মুসলমান পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। এবং ইংরেজ শাসকদের দুশো বছরেও বাংলা ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ ছিল না।ইংরেজ শাসকরা ১৯৪৭ সালে বাঙলাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়। শুধু পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ হয় না, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। বাঙলার মানুষের বাঙ্গালী নাম বিপন্ন হয়ে ওঠে, তাদের পরিচয়ের কাঠামোয় ধর্ম ঢুকে পড়ে। বাঙালিত্ব ছেড়ে তারা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান পরিচয়ে আত্মতুষ্টি বোধ করে। ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া সময়েও বাঙলা ছিল, বাঙ্গালী ছিল। মহাস্থান গড়, কোটালীপাড়া দুর্গের/রাজ বাড়ির উপস্থিতি তার নমুনা দেখায়। গঙ্গারীডি - তত্ব এবং তথ্যসহ বিস্তৃত ধারণা দেয়। সুদূর অতীত থেকে এই যে লড়াকু মানুষের অবস্থান তা একটা বিষয় জানান দেয়, রাজা, রাজ্যপাট সব কিছু হারিয়ে গেলেও মানুষ তাদের ভূমি ছেড়ে কখনো চলে যায়নি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বারবার হেরে গিয়েও ভূমির অধিকার হারায়নি। সেই ভূমির অধিকার আমরা স্বেচ্ছায় হারালাম, পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকার আমরা রাখতে পারলাম না। কেন রাখতে পারলাম না? বাঙ্গালী থেকে আমাদের ধর্মীয় পরিচয় যখন প্রাধান্য পেলো আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করলাম, খুনোখুনি করলাম এবং মাটির অধিকার ছেড়ে ভাসা কচুরিপানার জীবন বেছে নিলাম। কি সেই ধর্ম? বাঙলার অধিবাসীরা ছিল অনার্য। উত্তরবঙ্গে ছিল পৌন্দ্রদের আধিক্য, দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে চন্ডাল তথা নমঃশূদ্রদের। প্রাক বৌদ্ধ যুগে কোন ধর্মের খোঁজ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ বাঙলার অধিবাসীরা ছিল বৌদ্ধ বা জৈন। আর্যবাদী হিন্দুদের উৎপীড়ন এবং মুসলমান ধর্মের জাতপাতহীন উদারতা অনার্যদের ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে নিয়ে যায়। বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম তাদের বাঁচাতে পারে না তাই অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যায়। বাকিরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ফলে বল্লাল সেন ও তার পরবর্তী রাজাদের সিদ্ধান্তে তারা চন্ডাল বা নিচু জাতের মানুষ হয়ে যায়। আমাদের অবস্থান - প্রাকৃতিক ধর্ম থেকে বৌদ্ধ বা জৈন। শাসক বদলের সাথে ধর্ম বদলায়, একদল মুসলিম অন্যেরা নিচুজাত - চন্ডাল বা পৌন্দ্র তার সঙ্গে শাসক/ব্রাহ্মণ বিভাজিত অনেক ছোট ছোট জাতি। জীবনের প্রয়োজনে বাঙ্গালী ধর্ম পাল্টালো কিন্তু জন্মভূমি পাল্টালো না। স্বাধীনতার নামে বাঙলা ভাগ হোল। সংখ্যা গরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিরা বাংলা ভাগ না চাইলেও ইংরেজ ভাগ করলো। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভদ্রলোক তথা বর্ণহিন্দুরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে জীবনপণ করেছিল। কারণ তারা দেখেছিল দেশভাগের আগে তপশিলি ফেডারেশান ও মুসলমানের জোট, যে জোট তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে দেয়নি। তাই জনমতে হেরেও ইংরেজ শাসকদের প্রভাবিত করে বাংলা ভাগ করতে সফল হয়। আর বাংলার তপশিলিরা দুই বাংলা থেকেই ক্ষমতার অধিকার হারায়। হরি চাঁদ ও গুরুচাঁদ এর শিক্ষা আন্দোলন তার বংশধরের ভুল নেতৃত্বে পথ হারায়। বাঙলায় জমিদার - জোতদার যারা ছিল তারা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ হওয়ার পর ধীরে ধীরে সরে পড়েছে বাঙলার পশ্চিম অংশে। তারা তো পরের ধনে পোদ্দারী করতো। কিন্তু কী ছিল বাঙলার ছিন্নমূল মানুষের ? সাধারণ মানুষ যাঁরা মূলত কৃষিজীবী তপশিলী সম্প্রদায়ের। তাঁদের ছিল কিছু জমি, কারো ছিল শুধু বাস্তুভিটা। সেই মাটির ভর ছেড়ে কোথায় যাবে তাঁরা ? দেশভাগ তাঁদের ভাসমান কচুরিপানা করে দেবে, একথা বুঝতে পেরেছিলেন তপশিলী সমাজের পরমহিতৈষী গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবশিষ্য যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দেশভাগ রুখতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু সঙ্গী পেলেন কাকে ? " ভারত সহ বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত কিছুতেই মনে প্রাণে মানতে পারলেন না যোগেন্দ্রনাথ। অবহেলিত মানবগোষ্ঠীর মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত যোগেন্দ্রনাথ প্রমাদ গোনেন। তাঁর আশৈশবের স্বপ্ন ও সাধনা বুঝি বিফলে যায়। তিনি ভাবেন, এদের মুক্তি তো সুদুর পরাহত। ষড়যন্ত্রকারীদের দেশ বিভাগের সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার ফল, তফসিলীদের বেঁচে থাকার পথ চিরতরে অবলুপ্ত। না, কিছুতেই এ ষরযন্ত্র মেনে নেওয়া যায় না। একে ব্যর্থ করতেই হবে। উদারচেতা ও নির্ভীক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্রোহের দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠেন। দেশজোড়া দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত দাবী করেন "অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা”। সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, সভা-সমিতি, সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারপত্রের মাধ্যমে আন্দোলনকে জনমুখী করে তোলার জন্য ব্যপক ও সর্বাত্মক প্রয়াস চালান। উল্কার মত ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একমাত্র নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া আর কোন নেতা যোগেন্দ্রনাথের আন্দোলনের সমর্থন বা সহযোগিতা জানালেন না। " - (মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর, জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল, পৃষ্ঠা ১১৬) 

 দেশ ভাগ হোল আর আমরা তপশিলি মানুষেরা হঠাৎ হিন্দু হয়ে গেলাম। আমরা ভুলে গেলাম হরি - গুরু চাঁদের বেদ বিরোধী মতবাদের কথা, ভুলে গেলাম গুরু চাঁদের এই স্বাধীনতা তথা ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতার কথা। ভুলে গেলাম চৌদ্দ পুরুষের জন্মভূমিতে টিকে থাকার লড়ইয়ের ইতিহাস। অভিজাতদের প্ররোচনায় হিন্দুত্বের টগ বগ মোহে ভিটে মাটি ছেড়ে দিকশুন্যপুরে চললাম। ##

 খণ্ডিত বাংলা স্বাগত জানাল। তবে চালুনির ব্যবস্থা চালু রেখে। বর্ণহিন্দু দের জায়গা হলো বাংলায় আর তপশিলিরা ছাগল মুরগির মতো বস্তা বন্দি হয়ে পাচার হলো দন্দকারণ্য, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। বাংলার বাইরে গিয়ে তারা বাঙালিত্ব হারিয়েছে। মাতৃভাষা শেখার সুযোগ আজ তাদের নেই। অনেক বছর পর, বাংলা ভূমিতে ফেরার বাসনা নিয়ে একদল মানুষ ফিরে এসেছিল, আশ্রয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল সুন্দবনসংলগ্ন মরিচ ঝাঁপি দ্বীপে। বাংলার বর্ণবাদী তথাকথিত হিন্দু শাসকরা সেই দ্বীপ চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ করে নৃশংস ভাবে খুন করেছে । পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় উদ্বাস্তুদের থামানো হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশকে বেশ সফলভাবে ফিরিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সেই রকম একটি দলকে আমি হাসনাবাদ স্টেশনে দেখি, যারা ফেরৎ ট্রেনে ওঠার জন্য সরকারী অফিসে লাইন দিয়েছে স্বেচ্ছায়। তারা প্রায় প্রত্যেকেই তিন-চার দিন খায়নি। তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া গেছে স্রেফ ক্ষুধার অস্ত্রে। তারা গোটা পশ্চিমবাংলাকে অভিসম্পাত দিতে দিতে ফিরে গেল।” -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: মরিচঝাঁপি সম্পর্কে জরুরী কথা। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮, নিরঞ্জন হালদার সম্পাদিত "মরিচঝাঁপি”। পূঃ ১৭)। 
 যে সমস্ত পরিবার আজ ওখানে (দণ্ডকারণ্যে) ফিরে আসছে, তাদের প্রায় সকল পরিবার থেকে শিশু অথবা বৃদ্ধ অথবা দুই-ই তাঁরা পথে পথে চিরদিনের মতো হারিয়ে এসেছেন। তাঁদের শোেক, দুঃখ বোধও এই প্রচণ্ড আঘাতে ও প্রতারণায় বিবশ। ফেরৎগামী ট্রেনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ২/৩ জন করে অফিসার পাঠানো হচ্ছে শরণার্থীদের তদারকি করার জন্য। তাঁদেরই মুখে শুনলাম, ফিরবার পথে মৃত শিশুদের ও বৃদ্ধদের তাঁরা ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছেন, পরবর্তী কোনো স্টেশনে তাদের সদগতি করার অপেক্ষা রাখেনি।” -পান্নালাল দাশগুপ্ত, যুগান্তর, ২৫ জুলাই, ১৯৭৮।। ##
যে কয়জন বেচেছিল তাদের আবার ফেরত যেতে হয়েছে সেই দণ্ডক অরণ্য। ##
 আজ দেশ ভাগের ছেয়াত্তর বছর পেরিয়ে দেশভাগের কুশীলবরা অমৃত মহোৎসব পালন করছে, দেশভাগ- দিবস পালনের দিন ক্ষণ নিয়ে মহাউল্লাশে কাড়াকাড় করছে তখন কেমন আছেন সেই হিন্দুত্বের মোহময় তপশিলিগন?
 Quote from CAA 
 নাগরিত্ব নিয়ে হাহাকার করছেন, জমির অধিকার পাচ্ছেন না, আসামে বেনাগরিক হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পচে মরছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (!) বর্ডারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঘেঁটে চলেছে রাজনৈতিক ভোলবদল। দেশভাগের প্রতিশ্রুতি ছিল - যতদিন একজন হিন্দু/মুসলমান দেশান্তরিত হতে চাইবে, চুক্তি বলবৎ থাকবে।

 ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নতুন চুক্তি হলো ইন্দিরা - মুজিবের মধ্যে। আগের চুক্তি উবে গেল, একাত্তরে আটকে গেল দেশান্তর। বাংলাদেশের পটপরিবর্তন হোল কিন্তু চুক্তির পরিবর্তন হোল না। তাতে অবশ্য বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে আসার স্রোত কমলোনা, বয়েই চললো। শাসক কিন্তু থেমে থাকল না। আরো কড়া আইন করলো ২০০৩ সালে। সেই আইন আরো শক্ত পোক্ত হয়ে সময়সীমা বেঁধে দিল ২০১৪ সাল। এরপরে কোন কেউ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্থান থেকে এলে নাগরিক হবার অধিকার পাবেনা। একটু স্বস্তি পাওয়া গেল , ২০১৪সাল! এটা একটা ললিপপ। শুনতে ভাল, কাজে নয়। ১৯৪৮ থেকে ২০১৪ এই সময়কালের মধ্যে যিনি আসবেন তিনি হিন্দুত্বের রসময়তায় ভারতে স্বাগত তবে ছোট্ট একটা শর্ত আছে, বৈধ কাগজ পত্র দেখাতে হবে। বৈধ কাগজ দেখাতে পারেনি বলে আসামে চৌদ্দ লক্ষ অবৈধ নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত। কী হবে বাকিদের যদি সরকারের কাছে বৈধ কাগপত্রগুলো দেখাতে না পারে ?
 : আচ্ছা দাদু, ধরে নিলাম এই কয়েক কোটি মানুষ অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু এরা সবাই তো হিন্দু, হিন্দুত্ব কি এদের কিছুই দেয়নি ?
 : হিন্দুত্ব মনোবল যুগিয়েছে। কারণ এদেশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। পথে ঘাটে কেউ গালাগালি দেয় না, সংখ্যালঘুর হিন্যমন্যতা নিয়ে চলতে হয়না। : কিন্তু তুমি তো হিন্দু নও। তুমি তো তপশিলিভুক্ত শুদ্র তথা নমঃশূদ্র তথা অন্তজশ্রেণী অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম বহির্ভূত মানুষ যাদের মনুস্মৃতি কীট বা পোকামাকড়ের মত ঘৃন্য বলে উল্লেখ করেছেন।
 : গভীরভাবে ভাবতে গেলে তাই। কিন্তু ধর্মীয় পোষাক বা পরিচয় তো পেয়েছি। : দাদু, এই মেকি পরিচয় তোমাকে, তোমাদেরকে কতটা আত্মবিশ্বাস দেয় জানিনা। তবে সত্যি এই, তুমি হিন্দু নও, তুমি ঘৃণিত শুদ্র, তুমি দেশহীন। হিন্দুত্বের মোহে তোমরা নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছো।##
 : দেখ দাদু ভাই, একটা সত্য তো মানবে তোমরা ওখানে ভাল নেই, ক্রমাগত ভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হচ্ছে? : আচ্ছা দাদু, মাতৃভূমি ত্যাগ করে তোমরা ভাল আছো তো ? তোমরা কোনভাবে অত্যাচারিত হচ্ছো না তো? : মানে কী বলতে চাইছো? : বাংলা ভাগ বাংলা সাহিত্যে বিষাদ সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের ' অন্য ইহুদি ' গল্পের বিষ্টুচরণ ফেরু মিয়ার কাছে অত্যাচারিত মেয়েকে বাঁচাতে দেশ ছাড়ে, রেল লাইনের পাশে বস্তিতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বাঁচাতে পারলো?
 " ... চারজন যুবক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর পথরোধ করে দাঁড়াল। খবরদার, এক পাও নড়বি না। গলাটা চেনা। চুল্লুর ঠেকের পাশ দিয়ে আসতে যেতে অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু গলাটা আজ যেন ফেরু মিয়ার মতো শোনাল? ... কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, - কারা তোমরা ? কী চাও ? ... একজন এগিয়ে এসে পাইগান ঠেসে ধরলো বিষ্টুচরণের বুকে।... সেই উন্মত্ত মাতাল ' ভদ্র সন্তানেরা ' কুঁড়ের মধ্যে ঢুকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল রুনু, শিউলি আর চেন্নোর বয়সি সব মেয়েদের। দানবীয় শক্তিতে তুলে নিয়ে গেল লাইনের ওপাশের অন্ধকারে। ... ফ্যাল ফ্যাল করে এর - ওর মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকালেন বিষ্টুচরন। তারপর হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। - ওরে বেজো, বেজোরে... তোরা কিসীর জন্নী দ্যাশ ছাড়িছিলি? ... বল, বল তোরা... কোথায় আমাদের সত্যিকারের দ্যাশ ? "
 আবার কবি বিষ্ণু দে লেখেন - " এখানে ওখানে দেখা দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায়/ পার্কের ধারে শানে পথে - পথে গাড়ী বারান্দায়/ভাবে ওরা কী যে ভাবে! ফেরে খোঁজে দেশ/এইখানে কেউ বরিশালে, কেউ কেউ - বা ঢাকায় "
 শরণার্থী বা উদ্বাস্তু জীবনের দু টুকরো চিত্র। এমন হা - হুতাশ, কান্নার বিষাদ সিন্ধু গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সিনেমায়। : আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে ও ধরা পড়েছে স্বজন হারানোর যন্ত্রনা। যে ধর্মের ভয়ে, মুছলমানদের দোষারোপ করে তোমরা চলে এলে তাঁরাও তোমাদের জন্য চোখের জল ফেলেছে। সৈয়দ শামসুল হক ভারাক্রান্ত মনে লেখেন : 
 " ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলো। কুড়িগ্রামে আমার সকল বন্ধুই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাদের প্রায় সবাই রাতারাতি ভারতে চলে গেলো। ১৯৪৮ সালে বালক আমি আক্ষরিক অর্থে একা এলাম ঢাকায়। ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারে তখনো হিন্দু সম্প্রদায়েরই বাস, তাদের সঙ্গে আমার একটা স্নেহবন্ধন গড়ে উঠছিলো, কিন্তু হঠাৎ ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো ঢাকায়। তারপর- হিন্দুদের দেশত্যাগ; সীমান্তের ওপার থেকে আসা নতুন অচেনা মুখের প্রতিদিন দেখা; ব্যক্তিগত জীবনে আমি ভীষণ একা; ইশকুল শেষে আমি পথে পথে হাঁটি, নদীতীরে বসি, নৌকোয় দূর দূর গাঁয়ে চলে যাই; ...." (মার্জিনে মন্তব্য)। 
 : ছোট ঠায়ুর্দা দ্যাশ ভাগের সাথে সাথে বর্ডার পেরোল। চলে গেলেন কোন দণ্ডক অরণ্যে। বাঘ ভাল্লুকের খাবার বানায়ে জঙ্গলে ছেড়ে দেলো বাঙালিদের। " লড়িতে করে গুচ্ছ গুচ্ছ লোক এনে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হল। না ঘর , না খাবার , না কোন সুস্থ ব্যবস্থা। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসহ দিন অতিক্রম করে এখানের বনজঙ্গল কেটে অনাবাদী জমিকে বাসযোগ্য করেছি আমরা।.... যেখানে এনে ফেলা হল সেখানে ১০০ বছরের অশ্বথ, বট, অর্জুন গাছের ভীষণ জঙ্গল। হিংসাত্মক জন্তুজানোয়ার, বাঘ,ভাল্লুক, দাঁতাল শুয়োর, বুনোহাতি আর ভয়ানক ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী দুর্দান্ত মশা। কত মানুষ অনাহার অর্ধাহারে আর ম্যালেরিয়াসহ দুঃস্থ অসুখে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল তার লেখা জোখা নেই। " ( নৈনিতালের পথে পথে, নীতিশ বিশ্বাস )। 
 তারপর তুমি ছেড়ে এলে দ্যাশ। আস্তানা গড়ে তুললে রেল লাইনের পাশে। বনগা থেকে ট্রেনে আসবার সময় দেখলাম রেলের দুপাশে গিজগিজ করছে টালি টিনের ঘর। এমন কোন ঘরে হয়তো তোমরা ছিলে । তোমাদের সব খবর পেত বড় ঠাম্মা। মা মরা দুই দেওর ছিল তাঁর সন্তানের মত। তোমরা নেই বলে ঠাম্মা তাল পিঠা খায় না, আম দুধে খায়না, পৌষের পিঠে খায়না। এখনও তোমাদের জন্য চোখের জল মোছে। এখন আর ভাল দেখতে পারে না। তবু তোমাদের দেখার জন্য পথ চেয়ে আছে। ফের বলে - তোমরা যে চোখে আমাদের দেখ আমরা সে ভাবে ভাবিনা, অন্তত আমি ভাবিনা। আচ্ছা দাদু তোমার দেশে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই কি ভাল আছে ? এরা কি সংখ্যালঘু হবার জন্য কোনভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে না? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে, তারা কি সংখ্যাগুরুর সমান অধিকার পায়? আর সেই কারণে সবাই কি মাতৃভূমি/ পিতৃভূমি ছেড়ে পালায়? না, পালায় না। লড়াই করে, লড়াই করে বেচেঁ থাকে। আমাদের পূর্বপরুষরা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ থাকা সত্বেও বেচেঁ ছিল। বাংলার লাঠিয়ালরা যুগ যুগ ধরে বাংলা শাসনের মধ্যে সমাজকে সুস্থির রেখেছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর তারা হতোদ্যম হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে তোমাদের দেশত্যাগ। যদি কেউ দেশত্যাগ না করতো আমরা আমাদের অধিকারের লড়াইয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হতাম। তোমরা জন্মভূমি ছেড়ে ভাসমান কচুরির মত বেনাগরিক হয়েছো, আমাদের দুর্বল করেছো। দাদু, ধর্মের জন্যে মানুষ বাঁচে না, জীবনের প্রয়োজনে ধর্ম আসে ধর্ম যায়। তাই ধর্মের জন্যে দেশ ত্যাগ করবো না, প্রয়োজনে ধর্ম ত্যাগ করবো। বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার ধর্ম। 

 আমি থ' হয়ে থাকি। ভাবতে থাকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...