বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৪

short story সন্ধিক্ষণ


সন্ধিক্ষণ ( #shortstory)
এক, দুই, তিন, চার। বন্ধু ওরা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে। নদীর জোয়ার ভাটার সাথে বড় হয়েছে। নদীর চড়ায় কাঁকড়া ধরা, অন্যের বাগানের ফল চুরি করা অথবা মেয়ে দেখে কৃষ্ণ সাজায় ওরা একে অপরের পরিপূরক। নোনামাটির আজন্ম স্বাদে ওদের বন্ধুত্ব বড় খাঁটি।
#shortstory 
ভাই ফোটার দিনে এক-এর দিদি ফুল-দুব্বা নিয়ে চারটে পিঁড়ির সামনে অপেক্ষা করে। দুই এর বোন চারটে পিঁড়ি পেতে রাখে। তিন সারাদিন বাড়ি ঢোকে না। ওর বাড়ি পুজোর বালাই নেই। চার এর মায়ের স্বস্তি নেই। অবদারের ঝামেলা পোয়াতে না পেরে ফোঁটা দেয় মা-ই। পাড়ার-বেপাড়ার সব রাধাই সেদিন ওদের বোন হয়ে যায়। 
#writingblog 

গাঁয়ের মানুষ ওরা। শহর ওদের ছায়া থেকে শতেক মাইল দূরে। নোনা মাটির দেশ। দক্ষিণা হাওয়া সমুদ্রের ঠাণ্ডা। যেমন করে আনে তেমনি জঙ্গলের মধ্য থেকে দুসংবাদও বয়ে আনে কখনো কখনো। বাঁচার তাগিদেই জঙ্গলে যেতে হয় তাদের। জীবিকার জন্যে সুন্দরী, গেঁয়ো, গড়ান তাদের ডাকে। জঙ্গলের মধু যেমন তেমনি জঙ্গল ঘেঁষা নদীর চড়ায় মাছ ধরার লোভ। কুমীর বা বাঘের টানে দু'এক জন হারিয়ে গেলেও ওরা আবার যায়। যেতে হয় বলেই বার বার যায়।

তিনের শাদি ঠিক হয়। এক, দুই, চার কিছু পরামর্শ করে। তিনের শাদিতে কিছু উপহার দেওয়া চাই তাদের। কিন্তু টাকার টানাটানি তো চিরকালীন। বাঁধের মাটি কাটার কাজ নেয় কয়দিন। প্রত্যাশার বহু দূরে পড়ে থাকে তাদের আয়। হঠাৎ করে জঙ্গল থেকে কাঠ চুরির কথা ভাবে তিন জন। তিনকে এ অলোচনায় নেয় না তারা। জঙ্গলে যাবে। দু'চারটে গাছ কাটতে পারলেই কাজ ফতে তাদের। তিন-এর বিবিকে চমকে দেবে তারা। সেই মত একদিন ভোরে নির্দিষ্ট নৌকার ঘাটে চলে আসে তিন জন। দা-কুড়ুল নিয়ে ভটভটিতে উঠে আবিষ্কার করে তিনকে। সঙ্গে যাবে বলে আগে ভাগেই এসে বসে আছে সে। কচি হবু বিবির স্বপ্নে বিভোর হয়ে বন্ধুদের দল ছাড়তে নারাজ সে। তাকে অনেক করে বোঝায় ওরা। একটা বিপদ হয়ে গেলে মেয়েটার করুণ, অসহায় অবস্থার কথা বলে। কিন্তু কাজ হয় না। অনড় থাকে তিন। এর জন্যে বন্ধুদের বিপদের থেকে দূরে সে থাকতে পারে না। সুখের সময়ের সাথী যদি হতে পারে, সাথী হবে দুঃখেরও।
: তুই বাড়ি ফিরে যা, চোখে সুরমা নিতে নিতে হবু বিবির স্বপ্ন দেখ...
: তাহলে তোরাও ফিরে চল..
: আমাদের যদি বিপদ হয় তোর বিবির কি হবে..
: যদি সপ্তমুখিতে ঝড় উঠে....
: যদি বন পাহারাদারদের কাছে ধরা পরি...
: যদি দক্ষিণরায় কৃপা করে....


অগত্যা নৌকা ভাসায় চারজনেই।

ভাল কাঠের সন্ধানে একটু গভীর জঙ্গলে ঢুকতে হয় তাদের। আঁকা-বাঁকা নদী হয়ে খাড়ির মধ্যে নৌকা ঢোকায় তারা। সহজে আয় করতে গিয়ে জীবনটাকে সহজ করে তোলে। সরকারী বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে ঢোকে তারা। তাই ভয় তাদের তাড়া করে সব সময়। একদিকে যেমন সরকারী নজরদার বনকর্মীদের এড়াতে হয়, তেমনি এড়াতে হয় বনের রাজা দক্ষিণ রায়ের রক্ত চক্ষু। একান্তই জীবনটাকে মুঠোয় করে জঙ্গল হাসিল করতে যায়।

চার জনেই জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। কুড়ুল নিয়ে একজন কাটতে থাকে গাছ। বাকি তিনজন লাঠি দা হাতে নজর রাখে চারিদিকে। পাহারা দেয় বন্ধুকে। পালা করে কুড়ুল নেয়, তারা। কাটা গাছের ডালপালা ছোট নৌকায় তোলবার ব্যবস্থা করতে থাকে। কিন্তু বাঘের চোখ এড়াতে পারলেও বনকর্মীদের নজর এড়াতে পারে না। তাদের প্রয়োজনীয় বখরা পাওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরে তারা। বাঘের থাবা থেকেও এদের থাবা এড়ানো বড় মুশকিল। গাছ কাটার শব্দ শূন্যে মিলাতে মিলাতে এদের কানে পৌঁছায়। হাওয়াই আবার বনকর্মীদের আগমন বার্তা বয়ে আনে। তাড়াতাড়ি সব ফেলে চম্পট দেয়। যেহেতু জঙ্গল ঘিরে বেড়ে ওঠা মানুষ এরা, তাই বনকর্মীদের ফাঁকি দিয়ে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। 
কিন্তু কাটা গাছ তাদের ঘুমাতে দেয় না। তাই আবার একদিন বেরিয়ে পড়ে চারজনে। চুপিসারে জঙ্গলে ঢোকে। ফেলে আসা গাছের গুঁড়ি নৌকায় তোলে। ফিরে আসে নিরাপদে। তারপর ধূমধাম করে উপভোগ করে তিনের শাদি।

ভরা কোটালে জল বাড়ে নদীর। গর্ভবর্তী মায়ের মত নিজের পরিধি ভুলে যেতে চায়  জলরাশি। আকাশে মেঘ জমে। উত্তুরে মেঘ দক্ষিণে যায়। জলের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়তে থাকে বাঁধের উপর। প্রকৃতি মেতে ওঠে বাঁধন মুক্তির খেলায়। পশ্চিম থেকে খবর আসে বাঁধ ভাঙ্গার। দক্ষিণ থেকে খবর আসে বাঁধ ভাঙ্গার। খবর আসতে থাকে চারিদিক থেকেই। চার বন্ধুর ব্যস্ততা বাড়ে। খবরের আগে যেন ছুটে চলে তারা। গ্রামবাসীকে সজাগ করে। কোদাল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় বাঁধের উপর। যেখানে ফাটল, যেখানেই উপচে পড়ে জল, সেখানেই বাঁধ মেরামতিতে লেগে যায়। ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি ফেলে উপচে পড়া জল অটকায়। কিন্তু পারে না। প্রকৃতির তান্ডবের কাছে হার মানে এক সময়। বাঁধ ছেড়ে তখন তারা মাঠে নামে। নোনা জলে ভেসে যাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ায়। গরু-ছাগলগুলোকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়। অসহায় মানুষদের সহায় হয়ে ওঠে। এক এর বৃদ্ধ বাপকে পাঁজা কোলে করে জল ভেঙ্গে ডাঙার দিকে যায় তিন। দুই এর ঠাকুমাকে পাঁজা কোলে করে জল ভেঙ্গে ডাঙ্গার দিকে যায় চার। সব প্রতিবেশী একাকার হয়ে আশ্রয় নেয় স্কুল ঘরে বা পঞ্চায়েতে। বড় কড়াই ভর্তি খিচুড়ি তৈরী করে বন্ধুরা। পরিবেশন করে বন্ধুরা। তাদের বাপেরা মায়েরা, ভাইয়েরা, বোনেরা পাশাপাশি বসে খায়। শোয়। আকাশের দিকে তাকায়, নোনা জলে ডুবে যাওয়া মাঠের দিকে তাকায়। সবার আশা নোনা জলে একাকার। সবার জীবিকা খিচুড়িতে একাকার।
বামুন ঠাকুর পৈতায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করেন: ও চাচি, আর কতক্ষণ নাকবেনে খিচুড়ি হতি ?
চাচি পান চিবোতে চিবোতে কয় : এই তো হইয়া গেলো প্রায়...

খেটে খাওয়া মানুষ সব। দিনভর তাই খাটতে হয়। কেউ জন-খাটে। কেউ মাছ ধরে। কেউ মাটি কাটে। কেউ ঘর বানাতে ব্যস্ত। কিন্তু সারা দিনের শেষে গ্রামের একমাত্র বাজারে হাজির সবাই। বাজার তাদের নিত্যদিনের মিলন-মেলা। বটতলা বা চায়ের দোকানে আড্ডা বসে তাদের। অনেকের সাথে এক থালাতে মুড়ি খায়। হাত বদল হয় বিড়ি-সিগারেটের। রাত বাড়ে, নেশার পরিধিও বাড়ে। দেশী মদের গন্ধে কখনো কখনো বাড়ি ফেরে তারা।

এমনি করেই দিন কাটে তাদের। চার বন্ধুর এক সত্তা হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ ভাল কাজেও তাদের পায়, খারাপ কাজেও তাদের এক সঙ্গে পায়। কোন বিভেদই ঠাঁই পায় না তাদের কাছে।

দুই-এর বাবা মারা যায় একদিন। অনভ্যস্ত সংসারের দায় চেপে বসে মাথার উপর। এক, তিন, চার ভরসা যোগায় দুইকে। শ্মশান থেকে শ্রাদ্ধ-সব কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তিন বন্ধু। ব্রাহ্মণ ডাকে, কলাপাতা সংগ্রহ করে এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে, কাঠ চেরে, চাল, ডাল কেনে বাজার করে। আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়। সামিয়ানা টাঙায়, রান্না করে। খেতে দেয়।

এক দল খায়। আরেক দল খায়। নিমন্ত্রিত মানুষেরা আসে, খায়-দায়, এবং চলে যায়। একসময় মানুষজন হালকা হয়। যারা বাকি থাকে, যারা অতি কাছের মানুষ তাদের সঙ্গে খেতে বসে ওরা তিনজন। ওরা বসে পাশাপাশি। একের পাশে চার চারের পাশে তিন। সামনে সাদা কাপড় পরে নেড়া মাথায় দাঁড়ায় দুই। তার বাবার পারলৌকিক মুক্তিদাতাদের সামনে বিনীত হয়।

গুঞ্জনটা শুরু হয় হঠাৎই। 
এক-এর বাবার অস্থিরতা বাড়ে। এদিক-ওদিক তাকায়। এদিক-ওদিক যায়। সমাজের কর্তা যাঁরা তাদের সাথে কথা বলে। ক্রমশ মুখটা গম্ভীর হ'তে থাকে। গলার পৈতায় হাত বোলাতে থাকে বামুন ঠাকুর। সমাজ সেবকদের সমাজ চেতনা বাড়ে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা মরিয়া হয়ে ওঠে। এক-এর অত্মীয়দের গুঞ্জন দুই-এর অত্মীয়দের দিকে যায়। দুই-এর আত্মীয়দের গুঞ্জন এক- এর আত্মীয়দের দিকে যায়। অবশেষে গুঞ্জন আর গুঞ্জনে সীমাবদ্ধ থাকে না। পৈতাকে অনেক বেশী প্রকাশ্যে নিয়ে আসে এক-এর বাবা। এক, তিন ও চার খেতে ব'সে পাশাপাশি। খেতে বসা এক-এর সামনে এসে দাঁড়ায় তার বাবা। কঠিন স্বরে বলে : এখান থেকে উঠে আয়। 
হকচকিয়ে যায় সবাই। হকচকিয়ে যায় চার বন্ধু। বিহ্বলতা কাটিয়ে সামান্য প্রতিবাদের সুরে জানতে চায় এক : কেন বাবা?

: এদের সাথে এক সঙ্গে বসে খাওয়া চলবে না তোমার।
 নির্দেশ দেন তিনি। 
: কিন্তু ...

কারণ আঁচ করে কিছু একটা বলতে চায় দুই। দুইয়ের কথা শেষ হয় না। 
বৃদ্ধ মানুষ এক-এর বাবা। উত্তেজনায় কাঁপছিলেন তিনি। দুইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে ওঠেন : তোমার বাপের শ্রাদ্ধ, তাই বলে তো সমাজের নিয়ম ভাঙতে পারিনা। ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে শূদ্রের সাথে, মোসলমানের সাথে এক পাতে, এক পঙ্ক্তিতে খেতে পারিনা। নিচু জাতের সাথে, বেজাতের সাথে খাওয়া তো ধর্মচ্যুত হওয়া, সমাজচ্যুত হওয়া। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হবে না, জাত খোয়াতে পারব না কোনমতেই।

কলাপাতার উপরে ভাত ঠান্ডা হ'তে থাকে, মাথা নিচু করে বসে থাকে চার। চুপচাপ বসে থাকে তিন। নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে দুই। লৌকিকতার আড়ালে চাপা পড়ে তার বাবার পারলৌকিকতার চিন্তা। বাবার আজ্ঞায় সম্মোহিতের মত উঠে পড়ে এক। কিছুটা দূরে অনেকের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পৈতাধারী আরো কিছু মানুষের পাশে বসে পড়ে এক। 
কলার পাতা সামনে পড়ে, আলাদা। ভাত পড়ে, আলাদা। সে ভাতও ঠান্ডা হ'তে থাকে ক্রমশ।

Keywords: story, short story, writingblog, castsystem, hinduism, socialcancer, senior, goutamaalee.in , writings of goutamaalee 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...