শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

বাঁধানো বিস্তার (short story)



বাঁধানো বিস্তার


-প্যান্টিটা কেচে রাখিস্

-আচ্ছা।

-জুতো পালিশ করিয়ে রাখিস্

-আচ্ছা।

-মা-র মাথা ব্যথার ওষুধটা দোকান থেকে আনবি

-আচ্ছা।

-না ফেরা পর্যন্ত খাবি না

-আচ্ছা।

দুইবার আওয়াজ করে রিক্সাটা চলে গেল। এখানকার রিক্সাগুলো কেমন বাক্স বাক্স দেখতে। আমাদের দেশেরগুলো ঢের বেশি সুন্দর। রিক্সাটার পিছনে একটা টিনের ফুল আঁকা। রিক্সাওয়ালার রোগা চেহারা, কালো, আমার জেঠুর মত। জেঠু ছিলুম টানে, খুক খুক করে কাশে; রিক্সাওয়ালা বিড়ি টানে, খুক খুক করে কাশে। বাড়ি থাকলে জেঠুর যেন তামাক খাওয়া ছাড়া কোন কাজ নাই। সামনে পেলেই বলবে-ও জেঠি, এক ছিলুম তামাক দে। 
জেঠু আমাকে খুব ভালবাসে। কোলের কাছে বসায়ে মাথার চুলে বিলি কাটে, পিঠে হাত বোলায়, আস্তে আস্তে হাতের আঙ্গুল টিপে দেয় আর গল্প বলে। বেশির ভাগই জেঠিমার গল্প। জেঠিমার চুলের কথা, টিয়া পাখির মত নাকের কথা। জেঠুর তো একটাও মেয়ে নেই, পাঁচটাই ছেলে। দুইজন টলারে করে মাছ ধরতে যায় সমুদ্রে। পনের কুড়িদিন পর ফেরে। একজন ফিটবাবু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জেঠু রাগারাগি করে। সে কিছুই শোনে না। আর দুইজন স্কুলে যায়।

রিক্সাটা প্রতিদিন এই লজে আসে। এটাকে লজও বলে আবার হোটেলও বলে। কত লোক আসে। একদিন, দুইদিন বা আরো দু'চারদিন থাকে। আবার চলে যায়। আমাদের মত কেউ থাকে না। কতদিন আমরা এখানে এসেছি! ৪০-৫০দিন তো হবেই। মামনির তো শরীর ভাল নেই। কলেজের হোস্টেলে থাকতে কষ্ট হবে বলে আমরা এখানে এসেছি। মামনি হোস্টেলে না থেকে হোটেলে থাকে। ভাল হলে আবার হোস্টেলে যাবে। যতদিন না ভাল হবে আমরা হোটেলেই থাকব। উঠানের বাঁধানো চত্বর থেকে তিন ধাপ সিঁড়ি। তারপরই লম্বা বারান্দা।

সিড়ির পাশের থাম থেকে উনিশ পা হাঁটলেই আমাদের ঘরের দরজা। ব্যস্ত থাকলে উনিশ পা কমে যায় , না হলে মেপে মেপে উনিশ। মামনি, আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়, চলে যাবার পর আমার কোন ব্যস্ততা নেই। আমি উনিশ পা দূরত্ব অতিক্রম করতে থাকি। এর পরের ঘটনা আমি জানি। উনিশ শেষে আমি দরজার পাশে দাঁড়াবো, ঘরের মধ্যে নরম বিছানায় বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বই পড়বে মামনির মা। আমি দরজার পাশে দাঁড়ালে একবার তাকাবে তারপর আবার বইয়ের দিকে।
 আমার চোখ এখন বাঁধানো চত্বরের দিকে। আমি জানি ঐ চাতালের উপর এক্ষুনি একখানা সাইকেল এসে দাঁড়াবে। সিনেমার হিরোর মত চুল ছাঁটা একটা ছেলে আমাদের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে সাইকেল থেকে নামবে। একটা ইংরেজী পেপার এগিয়ে দেবে আমার দিকে। হাত বাড়াবো আমি।

সাইকেলের শব্দে মনে মনে প্রস্তুত হই। না দেখার মত গাছের দিকে তাকাই। একটা ডালের তিনটে ভাগ। উপরের দিক উঠে আরো ভাগ। ক্রমে সরু। তারপরে পাতা। সরু সরু পাতা।

 সাইকেল থেকে নামে। 

ডালে একটা কাক। নিচের দিকে তাকাচ্ছে।

 পেপারটা নিয়ে দরজার দিকে আসে।

 কাকটা হঠাৎ উড়ে যায়। কাকটা কি ভয় পেল?

 পেপারটা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি হাত বাড়াই ।মামনির মাকে পেপারটা দিই। আবার ডালের দিকে তাকাই। ডালটা কেমন ফাঁকা।

 সাইকেলটা একা দাঁড়িয়ে আছে। হিরো ছাঁট এখন পাঁচনম্বর ঘরের সামনে। সেখান থেকে দোতলায়, দোতলা থেকে তিনতলায়। তিনতলার কোনের ঘরটার কাছে গিয়ে সে কিছুটা সময় রেলিঙের কাছে দাঁড়াবে। গাছের দিকে তাকাবে। প্রতিদিন একবার গাছের দিকে তাকাবেই। গাছে তো কোন বাসা নেই, অথচ এমন ভাবে তাকাবে যেন কোন বাসা খুঁজছে। গাছের ফাঁক দিয়ে তিনতলার ঐ কোনের রেলিঙটা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। বাসা খুঁজে না পেয়ে ওর চোখটা যখন আমার চোখে পড়ে তখনই ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে যায়। আর একটুও দাঁড়ায় না। আলতো করে শিস্ দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। পায়ের চপ্পলের চটর-পটর শব্দ দ্রুত নেমে আসে। বাহাদুরি ঢঙে সাইকেলে লাফিয়ে ওঠে। চত্বরে এক চক্কর খায়, তারপরে গেট দিয়ে হুস-

আমি দরজা একটু খোলা রেখে দাঁড়াই। এমনভাবে দাঁড়াই যাতে মামনির মা কিছু বললেই শুনতে পাই। তিনি তো প্রায় সারাক্ষণই বই নিয়ে থাকেন। এতদিন থাকতে থাকতে যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে-তাদের মাধ্যমেই বই আনেন । আমার বই পড়া নেই। হাতে কাজ নেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের পৃথিবীটা দেখি। হোটেলের বাঁধানো চত্বর এই মুহূর্তে কেমন একা পড়ে আছে। আমার মত একা। ওকে কেমন দুঃখী দুঃখী লাগে। যখন সাইকেল আসে, গাড়ি আসে, মানুষজন আসে-চত্বরটা কেমন গমগমে হয়ে ওঠে। আমার মনটাও চনমনে হয়ে ওঠে। আমি তো কাউকে চিনি না, কথা বলতে পারিনা। চত্বরটাও কথা বলতে পারে না। তবু জানি তার আনন্দ হয়। নির্জনতা ভাল কিন্তু একঘেয়ে নির্জনতা কতক্ষণ ভাল লাগে? তবু সেই নির্জনতাকে সঙ্গী করে আমাকে থাকতে হয়। চত্বরটাকেও থাকতে হয়।

চত্বরের তিন দিকে বাড়ি একদিকে খোলা। আমার সামনের বাড়িটা উত্তরদিকের। ওটার অর্ধেক দুই তলের, বাকি অর্ধেক তিন তল। দোতলার নিচে রান্না-বান্না- খাবারের জায়গা ও অফিস ঘর। দোতলায় অন্য অফিস। সেখানে প্রতিদিন যেমন নির্দিষ্ট মানুষজন আসে আবার সপ্তাহে সপ্তাহে নতুন মানুষ আসে। নতুন মানুষেরা আসে দল বেঁধে। মামনি যেমন কলেজে ক্লাস করে এইসব নতুন মানুষেরাও ক্লাশ করে , ন'টা থেকে পাঁচটা ক্লাশ। সবাই কেমন বড় বড়। এইসব বুড়ো মানুষেরা কি পড়ে কে জানে!

আমার ডানদিক-পুবদিক। উত্তরদিকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিন তলা। প্রত্যেক তলায় চারটে ঘর। চারটে দরজা। চারটে জানালা। জানালায় পরদা। প্রতি সপ্তাহে যে সব নতুন মানুষেরা আসে, এইসব ঘরে তারা থাকে। কেউ কেউ রেলিঙের ধারে দাঁড়ায় সকাল সন্ধ্যে। নিচের দিকে তাকায়। গাছের ফাঁকা দিয়ে আমাদের দরজার দিকে তাকায়। ঘুরে ফিরে তাদের চোখ আমাদের দরজার দিকেই বেশি পড়ে। গাছের পাতাদের সাথে আমি লুকোচুরি খেলি।

সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা একজন এসে দাঁড়ালো। রেলিঙের সেই ধারটায় যেখান থেকে গাছের ফাঁকে আমাদের দরজা দেখা যায়। ফর্সা, রোগা, মুখে দাড়ি। মাথায় একটাও চুল নেই। আমার হাসি পায়। সারা মুখে দাড়ি অথচ মাথার সবটাই টাক। কেমন চকচক করছে। একবার তাকালো। পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করলো। ঠোঁটে নিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। বিড়িটা এবার হাতে নিল। যা বাবা-হঠাৎই একটা হাঁক পাড়ল-বুড়ো....। তিন তলা থেকে হঠাৎ বুড়োকে ডাকল কেন? প্রত্যেক ঘরে তো টেলিফোন আছে। টেলিফোনে ডাকলেই যা দরকার, যাকে দরকার পেয়ে যাবে। তবে অমন ভ্যা করে ডাকল কেন? লোকটা কি আমাদের দরজা দেখতে পাচ্ছে না? পাবে কি করে-আমি তো এখন গাছের পাতাদের সাথে লুকোচুরি খেলছি। মামনির মা বাথরুমে। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে খেলছি আমি।

আমরা যে ঘরে আছি এটা দক্ষিণ দিক। পূবদিকের তিনতলার সাথে লাগানো হলেও মানিকজোড় বলা যাবে না। কারণ জোড়ের মাঝখানে সিঁড়ি, ডাইনে-বায়ে ডাইনে-বায়ে করে চারতলার ছাদে উঠে গেছে। হ্যাঁ-এটা চারতলা, সবার থেকে বড়। নিচের তলায় ছয়টা ঘর। ছয়টা দরজা। ছয়টা জানালা। প্রত্যেক জানালায় পর্দা। নিচের তলার মত প্রত্যেক তলায় ছয়টা ঘর। ছয়টা দরজা, ছয়টা জানালা। অন্য তলার ঘরগুলো আমি ভাল দেখতে পাই না। এখন তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি-সবটাই আমার মাথার উপর। নিচের বারান্দা লম্বা। থামের ছায়া পড়েছে চক্চকে বারান্দার উপর। ছ'টা ঘরের সামনে ছ'টা পাপোষ। বারান্দার একধারে একটা কুকুর শুয়ে আছে। কুকুরটার লেজটা সাদা আর একটা কান সাদা। মনে হয় শ্বেতী হয়েছে লেজে আর কানে। সাদা কানটা হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠল-তার মানে কেউ আসছে।

চত্বরের পূবদিকে একটা বকুল গাছ। সাদা কিছু ফুল পড়ে আছে চত্বরে। সেখানে আরেকটা কুকুর। গোল হয়ে শুয়ে আছে। একেবারে কালো। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। মুখটা পশ্চিমদিকে। পশ্চিম দিকে কোন ঘর নেই। দেয়াল। দেয়ালে এগারটা চৌকোনা পিলার। প্রত্যেক পিলারে একটা করে টিউব লাইট। রঙিন কাচ দেওয়া। রাতে খুব সুন্দর লাগে। দেয়াল ঘেঁষে দেবদারু গাছ লাগানো। বাইশটা গাছ। গাছগুলি সব সমান লম্বা। দেয়ালের উত্তরদিকে গেট। লোহার গেট। নক্সা করা গেট। আড়া-আড়ি করে দুই সারি গোল নক্সা। এক এক সারিতে সাতটা গোল। যখন গেট খোলা হয়-মাঝখানের গোল দুটো দুই ভাগ হয়ে যায়, দুই পাল্লায়। একেবারে সমান সমান।


-মা, দিদিকে লেজ দিয়েছো আমাকে দাওনি।

-তুই তো মুড়ো ভাল খাস্ তাই তোকে মুড়ো দিয়েছি।

-না-আমাকেও লেজ দিতে হবে।

-মা, ভাইকে আলুসেদ্ধ বেশি দিয়েছো।

-মা, দিদি পোড়া লংকা খাচ্ছে-

-মা, ভাইয়ের দুটো জামা-

-মা, দিদির মত আমার একটাও লালজামা নেই-

-মা, ভাইয়ের মত আমিও ইস্কুলে যাব-

-মা.........।


মামনির মা ডাকে ঘরের থেকে। ঝাপসা হয়ে যাওয়া লোহার গেটের থেকে চোখ ফিরাই। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পাপোষটা দেখি। অনেক বালি জমে আছে পাপোষে।

একটা মোটর সাইকেলের শব্দ। তার মানে দশটা। আমাদের ঘড়িতে এখন নটা পঞ্চান্ন মিনিট। মেমসাহেব অফিসে এল। মেমসাহেব মোটর সাইকেলেই আসে। মাথায় একটা লোহার টুপি। শাড়ি পরা। মেমসাহেবের লম্বা চুল, বিনুনী করা। মেমসাহেব কালো, আমার থেকেও কালো। চোখ দুটো সাদা, দাঁতগুলি' সাদা। মোটর সাইকেল বকুল তলায় আসতে কালো কুকুরটা উঠে দাঁড়ালো। মেমসাহেব গাড়িটা দাঁড় করালেন। চাবি দিলেন। দোতলার সিঁড়ির দিকে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মত আমার দিকে তাকালেন। একটু হাসলেন। আমিও একটু হাসলাম। দোতলার সিঁড়িতে পা রাখলেন। কি ভেবে একটু দাঁড়লেন। আবার চলতে শুরু করলেন। দোতলার বাঁদিকে গেলেন। অফিসে ঢুকে গেলেন।

একটা ছাগল এসেছে। ছাগলটা চত্বরে পড়ে থাকা পাতা খাচ্ছে। বকুল ফুলও খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ম্যাঁ-ম্যাঁ শব্দ করছে। ছাগলটার পেটটা মোটা। বলের মত। আরেকটা ছাগল আসে ওর সঙ্গে তারও পেট মোটা। একেবারে ভাইয়ের ছোটবেলার পেটের মত। সকাল বেলা পান্তাভাত খেয়ে ভাই প্যান্টের নাতা ঢিলা করতো। তখন ওর পেটটাকে বাবুইপাখির বাসার তৈরি বলের মত লাগত। চত্বরের উত্তরদিকে দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা তক্তা। একটার উপর একটা, ঠিক গোনা যাচ্ছে না। দুটো শুকনো লম্বা বাঁশ। তার পাশেই ছয়টা টব। একটা টব কাত হয়ে পড়ে আছে। টবগুলো একটা লতানো গাছের গোড়ায় সাজানো। লতানো গাছটা দেয়াল বেয়ে দোতলায় উঠে গেছে।

কালোকুকুরটা উঠে শুকনো বাঁশের কাছে গেল। একটু গন্ধ শুকল। একপা তুলে বাঁশের উপর পেচ্ছাব করে দিল। ছেলে কুকুর। ভারি অসভ্য। এখন অবশ্য ভোলানাথের মত, কিছুই জানে না। পেচ্ছাব শেষ করে গেটের দিকে দৌড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে একটা সাদা গাড়ি ঢোকে চত্বরে। দক্ষিণ দিকের বারান্দা ঘেঁষা রাধা-চূড়ার নিচে এসে দাঁড়ায়। রাধা-চূড়ার হলদে ফুল চাপা পড়ে সাদা গাড়ির চাকার তলে। গাড়ি থেকে একজন নাদুস-নুদুস লোক নামে। অন্যগেট দিয়ে নামে একটা মেয়ে। প্রায় আমার বয়সী। চুড়িদার পরা। একটা বেনী। মাথার চুল কিছুটা এলোমেলো। আমার দিকে একবার তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়। চোখ দুটি কেমন সাদাসিধে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতোর তলায় রাধাচূড়ার ঝরা পাতা পিষতে থাকে। নাদুস-নুদুস লোকটা হোটেলের রিসেপশান থেকে ফিরে আসে। নিচের দিকে তাকাতে তাকাতে তার পিছু নেয় মেয়েটি। ওরা আমার মাথার উপরের দোতলার বা তিনতলার বা চারতলার কোন ঘরে যায়।

বারান্দার পূবদিকে দশ পা যাই। গুণে গুণে দশ পা ফিরে আসি। বাঁ দিকে লম্বা বারান্দা, পূব দিকের ঘরের বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চের উপর একটা জগ। জলের জগ। বেঞ্চের উপর এখন আর কেউ বসে নেই। একটু আগে ছেলেটা বসে ছিল। লম্বা, বচ্চনের মত চুল আর কার্তিকের মত সরু গোঁফ। ফাঁক পেলেই অন্য কেউ এসে বসবে। কখনো কখনো দু'তিনজন একসঙ্গে বসে থাকে। আমরা যখন প্রথম আসি তখন এখানে কোন বেঞ্চ ছিল না। কোন এক দুপুরে এসেছে। বারান্দার ঐ কোন থেকে চত্বরটা সুন্দর দেখা যায়। মানুষজন এলে দেখা যায়। বকুল ফুলের গাছ, রাধাচূড়ার ফুল দেখা যায়। দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখার থেকে বসে দেখা ভাল। তাই বেঞ্চ এসেছে। বেঞ্চ থেকে দক্ষিণের বারান্দা আর আমাদের ঘরের দরজাও দেখা যায়।

দশ পা ফিরে আসি। বাঁধানো চত্বর এখন ফাঁকা। বারান্দা থেকে চত্বরে নামি। রবার গাছের পাতাগুলি বেশ বড় বড়, মসৃণ। ডগা লাল। গাছের কান্ড থেকে শিকড় বেরিয়েছে। বটগাছের মত। গাছ তলায় একটাও রবার গাছের পাতা নেই। পোড়া সিগারেটের টুকরো একটা। মেমসাহেবের মোটর সাইকেলটি দাঁড়িয়ে আছে। একা একা। হ্যান্ডেলের কাছে আয়নাটার সামনে দাঁড়াই। আয়নায় নিজের মুখটা দেখি। নাকে একটা ফুটো। ফুটোয় কাঠি লাগানো। দুই কানে ফুটো। দুই কানে কাঠি লাগানো।


-ঠাম্মা, ভয় করছে

-কিসের ভয় রে ছুঁড়ি, সবাই তো ফোটায়

-ওরে বাবারে, কি মোটা সুঁই-ব্যথা করবে না?

-ব্যথা কোথায়, পিঁপড়ের কামড়ের মত

-যদি ঘা হয়?

-প্রত্যেক দিন চন্দন ঘষে লাগাবি

-ফুটো করে কি হবে?

-সোনার গয়না পরবি, নাকে নোলক, কানে দুল..


কার্নিসের কাকটা ডেকে ওঠে কা-কা করে। চারতলার ছাদে আরো দুটো কাক।

কার্নিশের কা-কা শুনে তারা একটু সতর্ক হয়। কিন্তু ওড়ে না। ইতি-উতি তাকায়। এক বালতি ভিজে কাপড় নিয়ে আমি সিঁড়ি ভাঙ্গি। এক. দুই. তিন.........চার............পাঁচ... ছয়. .সাত. চৌকোনা চাতালের মত। ডাইনে বাঁক। এক.. .আট. ..নয়.......দশ। এবার দুই.........পাঁচ.. ছয়......নয়.... দশ। দোতলা। বাঁ দিকে দক্ষিণ দিকের বারান্দা, ডানদিক সামনে পূব দিকের বারান্দা। ডাইনে বাঁক। দশ ধাপ সিঁড়ি এক চাতাল, আবার দশ ধাপ তিনতলা। পূব দিকের বারান্দা। বায়ে রেলিঙ ডাইনে দরজা, বন্ধ। জানলা, বন্ধ। একটা পা- পোষ। বায়ে রেলিঙ-রেলিঙের উপর একটা গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি। ডাইনে দরজা সামান্য ফাঁক। ভিতরে কথা। পাপোষ উল্টানো। জানালা বন্ধ। বাঁয়ে রেলিঙ মেঝেতে ওষুধের খালি খোেল। বিড়ির টুকরো। ভিতরের দিকে ঢোকা পা-পোষ। দরজা অর্ধেক খোলা। সাদা বিছানার চাদর। একজন কালো মানুষ। চিৎ হয়ে শোয়া। অসুস্থ! আবার দরজা, আবার দরজা। বাঁয়ে বাঁক। দুটো ঘর। বারান্দার শেষ। লোহার গেট, টানলে একদিকে গুটিয়ে থাকে। কালো রং। এখন গোটানো আছে ডানদিকে। পা বাড়ালেই ছাদ।

ভর দুপুর। ঝকমকে রোদ। ছেঁড়া ন্যাতার মত মেঘ। সাদা সাদা। কোন বাঁধা নেই। কাউকে তোয়াক্কা করে না। সূর্যকেও না। নিজের মত উড়ে বেড়ায়। কেউ কাজ করতে বলে না। ঘরের বাইরে একা থাকতে কেউ বারণ করে না। সময় কাটাবার সাথী খুঁজতে হয় না। চারিদিকে ঘেরা, বাঁধানো চত্বরের সামনে থাকতে হয় না। আমি যদি মেঘ হতাম- এক দৌড়ে চলে যেতাম মায়ের কাছে। মায়ের চোখ মুখ নখ দিয়ে আঁচড়ে দিতাম। মাকে জড়িয়ে ধরতাম।

-তুমি আমায় কেন ছেড়ে এলে মা?

-তোমার মত কেউ তো আমার মাথায় বিলি কেটে দেয় না।

-আমার তো তোমার কাছে শুতে ইচ্ছা করে মা। মামনির মত তোমাকে জড়িয়ে তোমার বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে....


ভিজে কাপড় রাখি তারের উপর। টিভি অ্যান্টেনার উপর বসে থাকা ঘুঘু উড়ে যায়। অ্যান্টেনায় ছোট ছোট সাদা রড আড়াআড়ি, মোট সতেরটা।

ছাদের মাঝখানে চারটে পিলার সামান্য উঁচু হয়ে সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় ওরা খেলবে-হাত ধরাধরি করে কিছু একটা খেলবে। কিন্তু ওদের বড় কষ্ট কেউ কারো কাছে যেতে পারে না-দূরেও যেতে পারে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। বুড়ি দিদিমার মত। ঘাট থেকে উঠতে গিয়ে ধপাস্-পড়ে গেল। কোমর ভাঙ্গল। হাসপাতালে ছিল কয়দিন। তারপর থেকে বাড়ি। বাড়ির বাইরে আর যেতে পারে না। বুড়ির ছাগল দুটো বাইরে যায় আবার ফিরে আসে।



ছাদে অনেক টব-অনেক গাছ। আমি তো নাম জানিনা সবার। খুব চেনা ফুল-কল্কে ফুল। রাস্তার ধারে হয়। এখানে টবে। টব থেকে ছাদের রেলিঙ বেয়ে গাছ উঠেছে। আজ তেরটা ফুল। কালকের থেকে চারটে বেশি। সিমেন্টের তৈরি চারটে বড় টব। একটা টবে বট গাছ। ঝুরি নামানো বটগাছ। আমাদের শীতলা মন্দিরের বিশাল বটগাছটা কেউ যেন মন্ত্র দিয়ে ছোট করে দিয়েছে। আরেকটা গাছের নাম জানি। মামনির মার কাছ থেকে শুনেছি। অ্যাডেনিয়াম। বাকি নাম জানিনা। সিমেন্টের টবে ভাঙ্গা প্লেটের টুকরো লাগিয়ে সাদা সাদা ছোপ তৈরি করা হয়েছে। মাঝারি টব-উনআশি। ছোট টব-সাতাশ। ফাঁকা টব-তেইশটা। তিনটে টব উল্টানো, একটা গাছসহ আর দুটো ফাঁকা।

ছাদের উত্তর পশ্চিম কোনে একটা চৌবাচ্চার মত টব। লম্বা চারকোনা। টব ভর্তি অনেক গাছ, ছোট ছোট। সবগুলো গাছে ফুল। গোলাপী, সাদা, নীল। কড়া রোদে পাতাগুলি একটু মিইয়ে পড়েছে। ফুলগুলি খুব উজ্জ্বল। দক্ষিণ-পশ্চিম কোনেও আরেকটা চৌবাচ্চা টব। একই রকম ছোট ছোট গাছ, ফুল। টবের পিছনেই লতানো গাছের ঝোপ। বাঁধানো চত্বর থেকে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে এসেছে। ছাদের কোনায়, ঝোপের আড়ালে তিনটে বোতল। খালি বোতল। দুটো চ্যাপ্টা। কালো লেবেল লাগানো। কি সব লেখা। তৃতীয় বোতলটা গোল, চ্যাপ্টাদের থেকে বড়। ছিপি নেই। তলার দিকে ভাঙ্গা। চৌবাচ্চার এক পাশে একটা চেয়ার। হাতল ভাঙ্গা।

এখান থেকে গেট ভাল দেখা যায়। গেট খোলা। গেট থেকে বেরিয়ে একরাস্তা ডানদিকে, আরেক রাস্তা বাঁ দিকে। বাঁ দিকের রাস্তা একটু এগিয়ে দুইভাগ। একটা আবার ডানদিকে। আরেকটা বাঁদিকে। লাল মাটির রাস্তা। ছোট বড় বাড়ির মাঝে হারিয়ে গেছে।

কয়েকটা বাড়ি পরে একটা লাল রঙের বড় বাড়ি। বাড়ির ছাদে উল্টানো ছাতার মত দুটো অ্যান্টেনা। ছাদের এক অংশ টালির মত। পাশে দুটো নারকেল গাছ-ভাইবোনের মত দাঁড়িয়ে আছে। আরো দূরে গ্রাম, গাছে ঢাকা গ্রাম।

কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটা এখনো ছাদে আসেনি। এবার আসবে। গাছের দেখাশুনা ছেলেটা করে। সব কাজ ফেলে বা করে এই দুপুর বেলা ও গাছের যত্ন নেবে। টবগুলোর কাছে যাবে। মরা পাতা থাকলে ফেলে দেবে। যত রোদই হোক সে কাজ করবে। আমার কাজ শেষ হয়ে গেলেও সে সব গাছের যত্ন না নিয়ে যাবেনা। আমার আগে কোনদিনই তার কাজ শেষ হয় না। গুণ গুণ করে
গান করে। আমার দিকে কখনোই পিছন ফিরে কাজ করে না। গাছগুলোতো তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। আমি জানি এক্ষুণি সিঁড়িতে তার পায়ের শব্দ শোনা যাবে।
#

বাঁধানো চত্বর থেকে আকাশ ছুঁতে চলেছে রাধাচূড়া। দোতলার ছাদ ছাড়িয়ে তিনতলার ছাদের সমান। ছাদের উপর থেকে রাধাচূড়াকে অন্যরকম লাগে। নিচের থেকে যেমন বিশাল মনে হয়-ছাদ থেকে তেমন মনে হয় না। থোকা থোকা হলুদ ফুল। অনেক মৌমাছি। একটা কালো ভোমরা। ফুল ফুটলে ওরা যে কি করে টের পায়!

তিনতলার ঘরগুলি অনেকটা গাছের আড়ালে। একটা ঘরের সামনে, নাদুস- নুদুস লোকটা। দরজা ভেজানো। লোকটা ছাদের টবগুলো দেখছে। ফুলগুলো দেখছে। তারের উপরের কাপড়-চোপড় দেখছে, বড্ড বিশ্রীভাবে দেখছে। যেন গিলছে। হোটেলের লাল ছেলেটা, যে সবার থেকে ছোট আর সবার থেকে বেশি সেজেগুজে থাকে- সে খাবার নিয়ে নাদুস-নুদুস-এর ঘরে যায়।
 তার মানে ওরা ঘরেই খাবে। নিচে যাবে না। ইস্-যদি নিচে যেত, আমরা মানে মেয়েটা আর আমি গল্প করতে পারতাম।

অ্যাডেনিয়াম। কোন কালে এমন নাম শুনিনি। গাঁদা, জবা, হাসনাহেনা, পাথরকুচি, পাতাবাহার। এমন সব নাম জানতাম। অনেক গাছেরই নাম জানিনা। এটারও জানতাম না। এখন জানি। কারণ তো একটু আছেই। 
কোঁকড়া চুল এখনো আসছে না। কেন আসছে না! খুব কাজে পড়েছে? হবে হয়তো। অ্যাডেনিয়ামের কাছে দাঁড়াই। কান্ডে হাত বোলাই। তেল তেলে গা। মামনির বইয়ের ছবির মত দেখতে। মেয়েদের ছবি আঁকা, ছেলেদের ছবি আঁকা। নানাভাবে। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে। নানাভাবে বসে, নানাভাবে শুয়ে, নানাভাবে দাঁড়িয়ে। কারো গায়ে পোষাক নেই। পোষাক আঁকতে বেশি কষ্ট? হবে। অ্যাডেনিয়ামের গোড়া একদম এক ছবির মত। একটা মেয়ে বসে আছে হাঁটুর উপর হাঁটু তুলে। আবার আরেক দিক থেকে দেখলে মনে হয় বাচ্চা হবার যন্ত্রণা নিয়ে কোন মেয়ে আধশোয়া।

-মাগো! 
মার চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভাই আর আমি মেঝেতে শুয়ে। বাবা-মা চৌকির উপর। টালির ঘর। বাঁশের বেড়া কেটে জানালা। জানালা দিয়ে আবছা আলো। সেই আলোতে দেখি আধশোয়া মা কাতরাচ্ছে। মায়ের পেটটা উপুড় করা গামলার মত। বাবা হাত বোলাচ্ছে পেটে। 
আমি উঠি। ঠাম্মাকে ডাকি।


ঠাম্মা পাড়ার ঠাম্মাকে ডাকে। অনেক পরে মায়ের চিৎকারের মধ্যে আমাদের সবার ছোট ভাইটা চিৎকার করে ওঠে।

হাঁটু গেড়ে বসি। অ্যাডেনিয়ামের কোমরে হাত বোলাই। আমার মা, হোক না সৎ মা, যেমন কষ্ট পেয়েছে-অ্যাডেনিয়াম কি তেমনি কষ্ট পাচ্ছে!

অ্যাডোনিয়ামের কোমর ঘেঁষে দূরের ঘরটা চোখে পড়ে। দরজাটা খোলা। মশারি ঝুলছে। একটা জামা হ্যাঙারে। টেবিলের অর্ধেক দেখা যায়। এলোমেলো বই ছড়ানো। লোকটা শুয়ে আছে। কোন বন্ধু পাশে নেই। ও কি একা? ওর আর কে আছে? যদি জ্বর বাড়ে? যদি মাথা ব্যথা বাড়ে? যদি পেটে ব্যথা বাড়ে?

-ওঃ মাগো......

- কষ্ট হচ্ছে সোনা? 
- অসহ্য ব্যথা......... মাথায় গায়ে...
-মাথা টিপে দিচ্ছি, চুপ করে শুয়ে থাক...

 ডাইনে রেলিঙ। মেঝেতে ওষুধের খালি খাপ।

 -আমি আর বাঁচবো না জেঠু......
 -"ধূর পাগলি, অমন করে না.......

দরজা খোলা, বালিশের বাইরে মাথা। 

-মা কেন চলে গেল? আমায় কেন নিয়ে গেল না...

পরের দরজা বন্ধ, জানালা দিয়ে ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে।

 -লক্ষ্মী সোনা, এই দেখ........ আমি তো আছি..

 পিছনের দরজা খোলা, আমার পা থেমে যেতে চায়। কিন্তু আমি তো জেঠু নই। আমাকে নামতেই হয় । দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার...এক। একতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে সেই বেঞ্চ। বেঞ্চের উপর একটা জলের জগ। জগের পাশে একটা ছেলে। কোঁকড়ানো চুল। বুড়ো আঙ্গুলে ন্যাকড়া বাঁধা। একলব্য হয়ে তাকিয়ে আছে তিনতলা থেকে নেমে আসা সিঁড়ির দিকে।

মেমসাহেব নামছে। বাঁ-কাধে ব্যাগ। ডান হাতে লোহার টুপি। মোটর সাইকেলের কাছে। টুপি মাথায় পরলেন। গাড়ি ঘোরালেন। এবার বাড়ি। অফিস শেষ। অফিসের অন্যরাও বাড়ি চলে যাচ্ছে। চার চাকার সুন্দর একটা গাড়িতে যে ভদ্রলোক আসে, সে যাবে অনেক পরে। মেমসাহেব গাড়িতে উঠলেন। আমার দিকে তাকালেন, মুখে হাসি। 
গাড়ি চলতে শুরু হতেই চত্বরের মধ্যে আরেকটা গাড়ি ঢুকল। লালপানা ফিট্-ফাট ছেলেটা তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে এলো। গাড়ির দরজা টেনে খুলল। সামনের থেকে নামলেন টাই পরা একজন। পিছন থেকে একদিক দিয়ে নামল ফুটবলের মত গোল একটা ছেলে। কোমরের প্যান্টটা একটু টেনে তুলল। আরেকদিকের থেকে নামল একটা মেয়ে। জিনসের প্যান্ট পরা। চোখে কলো চশমা। মাথায় ছোট চুল। ছিপ ছিপে। মোটামতন একটা বউ। তার চোখেও কালো চশমা। হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। সব শেষে নামল একটা মেয়ে। আমার থেকে ছোট। সবার থেকে অন্যরকম। পোষাকে, চেহারায়। কাজের মেয়ে কাজের মেয়ে। আমার মত। ওরা যদি কয়েকদিন থাকে তবে বেশ মজা হবে। ওর সাথে লুডো খেলব। আমার লুডোটা ব্যাগেই পড়ে আছে। মামনির পরীক্ষা, খেলার সময় নেই। মামনির মা পড়ে, সেলাই করে নাহলে হোটেলের কারো সাথে গল্প করে। লুডো খেলার সময় কারো নেই। আমার দিকে তাকালেই ওকে ডাকবো।

মামনির সাথে হাঁটতে হাঁটতে দেবদারু গাছের কাছে যাই। গেট দিয়ে লম্বা পা ফেলে ঢোকে একটা ছেলে। মুখে দাড়ি। এলোমেলো চুল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। বাঁ হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সটান এসে দাঁড়ায় আমাদের কাছে। মামনিকে প্রশ্ন করে-এটা হোটেল?

মামনি অফিস ঘরের দরজা দেখিয়ে বলে-ঐদিকে।

-সরি। উদাস চোখ দুটো আমাদের উপর থেকে টেনে নিয়ে যায় দরজার দিকে।

-আঁতেল......। মামনি মন্তব্য করে।

ডাইনিং রুমে দুটো ভাগ। একভাগে পড়তে আসা লোকগুলো খায়। অন্যদিকে অন্যরা। আমরা তো অন্যদের দলে। আমরা কোনের টেবিলটায় বসি। আমাদের সারিতে পাঁচটা টেবিল। মাঝের সারিতে তিনটে। ওপাশের সারিতে চারটে। প্রত্যেকটা টেবিলে চারটে চেয়ার। মোট দশটা সিলিং ফ্যান। যেদিক থেকে খাবার আসে, সেখানে একজন বসে থাকে। ছোট একটা টেবিল। একটা চেয়ার। টেবিলে হিসাবের খাতা, মৌরি। আমি ফুটবলের মত ছেলেটাকে খুঁজি। আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল অথচ ওরা এলো না। ওরা কি খাবে না? ছোট্ট বাটি থেকে মৌরি নিই। মৌরি চিবোতে চিবোতে অফিস ঘরে ঢুকি। চারটে সোফা। দুটো ছোট, নিচু টেবিল। ঘরের এক কোনায় দেয়ালে চাবি রাখার জায়গা। টেলিফোন। একটা চেয়ার। অফিসের দিদি বসে আছে। সামনে দুটো মোটা খাতা। আরেক কোনায় 
টি.ভি.। রঙিন টিভি। টিভির কাছের সোফায় মামনি বসে। আমি পাশে বসি। নেচে নেচে গান হচ্ছে। হিন্দি গান। আগে একদম বুঝতাম না, এখন কিছু কিছু বুঝতে পারি।

ডাইনিং রুমের দরজায় ফিটফাট ছেলেটা এসে দাঁড়ায়। টিভির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পিছন থেকে ডাক পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। দরজার কাছে আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ কোঁকড়ানো চুল ছেলেটা এসে দাঁড়ায়। টিভির দিকে তাকায় না। সোফার দিকে তাকায়। আবার মেঝের দিকেও। ঝকঝকে মেঝে। চোখ বেশিক্ষণ সেখানে আটকে থাকে না পিছলে যায়। সোফার দিকে। বুড়ো আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ, তার মানে কয়েকদিন টবের মাটিতে হাত দিতে পারবে না।
দুপুর বেলায় ছাদের গাছগুলো কষ্ট পাবে ওর জন্যে।

শুক্লপক্ষ এখন। চারিদিকে উঁচু বাড়ি, চত্বরে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে মত চাঁদ দেখা যায় না। ছাদে গেলে দেখা যায়। কিন্তু রাতের বেলায় ছাদে যাবার স্বাধীনতা আমার নেই। ইচ্ছে করলেই কাঠের পুলে দৌড়ে যাওয়া যায় না। মাছ ধরার ট্রলার থেকে জারি গানের সুর বা বাঁশের বাঁশীর সুর ভেসে আসে না। ঠুন-ঠান শব্দ ভেসে আসে রান্না ঘরের দিক থেকে। ডাইনিং রুমের ভিড় কমছে। হোটেলের ঘরগুলোর আলো নিভছে। তিন তলার ঘরটার জানালা খোলা। ভিতরে আলো জ্বলছে।

আলো-আঁধারের বাঁধানো চত্বরের পশ্চিম দিক থেকে পূব দিকে যাই। আমাদের মধ্যে বলার মত কোন শব্দই আমরা খুঁজে পাই না। দু'জনে তবু পাশাপাশি হাঁটি। পূব দিক থেকে পশ্চিম দিকে যাই। কালো কুকুরটা কান সাদা লেজ ধলো কুকুরটার পিছনে পিছনে গেটের বাইরে যায়। মামনি হাতের ঘড়ি দেখে। আমরা ঘরে ফেরার জন্যে বারান্দায় উঠি।

-...কোন্ শুয়োরের বাচ্চা.............

......................বাপের খাই..............

................................উপড়ে ফেলব.........

চিৎকার গমগমিয়ে ওঠে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। তিনতলার বারান্দা থেকে একজন চিৎকার করছে। কথা স্পষ্ট নয়। জড়ানো। একজন তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে কিছু একটা। লোকটা কোন আমলই দেয় না। এক কথা বার বার বলতে থাকে। দুম দাম করে নিচে নামে। পাজামা-পাঞ্জাবী পরা কার্তিকের মত চেহারার লোকটা। একতলায় সিঁড়ির পাশের দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। সঙ্গে গালি গালাজ। ইংরেজী শব্দও বলছে। মানে বুঝি না। তিনতলা থেকে আরো তিনজন নেমে আসে। সবাই মিলে জোর করে উপরের দিকে নিয়ে যায়।

বাঁধানো চত্বরটা ভিজে। অনেকগুলি বকুল ফুল পড়ে আছে। শুকনো পাতা, হলদে ফুল চত্বরের প্রায় সবখানে। সাদা গাড়ি একটা দাঁড়িয়ে আছে। পুবের বারান্দার শেষের বেঞ্চটার উপর জলের জগটা নেই। একটা সাঁওতাল বউ এলো সাইকেল চেপে। বউটার কাজ ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা। রাবার গাছতলায় সাইকেল রাখল। চাবি দিল। চাবিটা আঁচলে গিঁট দিতে দিতে রান্না ঘরের দিকে গেল। নাদুস-নুদুস লোকটা নেমে এল। মেয়েটি এল পিছে পিছে। কোন দিক না তাকিয়ে সাদা গাড়িটার কাছে গেল। দাঁড়াল। লোকটি অফিস ঘরে গেল। মেয়েটি ভিজে ভিজে চোখে তাকাল আমার দিকে। চোখ নামিয়ে নিল বাঁধানো চত্বরের দিকে। লোকটা এল। মেয়েটিকে গাড়িতে উঠতে বলল। মেয়েটি উঠল।


- গাড়িতে উঠে বস।

আমি গাড়িতে উঠলাম। মার মুখে আঁচল।

- একি কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে। তোমাকে কি দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি নাকি............
.........এই তো কাছেই........

ভাইয়ের চোখে জল। জেঠু চুপচাপ।

- আরে বাবা ইচ্ছে করলেই তো বাড়ি চলে আসতে পারবে। গাড়িতে উঠলেই বাড়ি, মাত্র ঘন্টা তিনেক সময়......

মা আমায় কেন যেতে দিচ্ছে? সৎমা বলেই কি আমায় বারণ করছে না? জেঠু কেন আমায় জোর করে নামিয়ে নিচ্ছে না?

- বাড়ির মতই থাকবে। কাজ বলতে প্রায় কিছুই নেই, কাজের লোক তো আছেই। মামনির সাথে গল্প করা আর টিভি দেখা। ইচ্ছে করলে লেখা-পড়াও শিখতে পারবে।

গাড়ি চলতে শুরু করে। মা পিছনে থাকে, ভাই পিছনে থাকে, জেঠু পিছনে থাকে, ঘর পিছনে থাকে।
গাড়ি চলতে থাকে।


গাড়িটা চলে যায়। বাঁধানো চত্বর সামনে রেখে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

- নাইটিটা কেচে রাখিস্

- আচ্ছা।

- শাড়িটা ইস্ত্রি করতে দিস্

- চুলের কাঁটাটা খুঁজে রাখিস

- আচ্ছা।

- দরজা বন্ধ করে থাকবি

- আচ্ছা।

মামনির সঙ্গে মামনির মা-ও রিক্সায় ওঠে। আমি টা-টা করি, মামনি হাত নাড়ে। ভিজে চত্বরে তিনটে চাকার দাগ। দাগগুলি গেটের দিকে মিলিয়ে যায়।

মামনির মা না ফেরা পর্যন্ত ঘরে আমি একা। অনেক কাজ। .....গেটের কাছ থেকে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ ভেসে আসছে.... আমি দরজার কাছে দাঁড়াই। বাঁধানো চত্বর থেকে পিঁপড়েরা সারি বেঁধে উঠে আসছে। একটা কালো পিঁপড়ের মুখে সাদা ডিম, অন্যদের থেকে গতি বেশি। ...বাঁধানো চত্বরে ঢুকছে সাইকেলের চাকা, প্যাডেলে চাপ পড়ছে বাঁ পায়ের.....পা-পোষকে ডাইনে রেখে পিঁপড়ের সারি ঢুকছে আমাদের ঘরে। মা বলত-পিঁপড়ের সারি মানে ঝড়-বৃষ্টির লক্ষণ। পৃথিবীর খবর সবার আগে টের পায় তারা। পিঁপড়ের ব্যস্ততার দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। তবে কি ঝড় আসছে? অথবা বৃষ্টি?

সাইকেলের চাকা থামে। দুটো পা এগিয়ে আসছে দরজার দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...