বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধূসর ডায়েরীর পাতা। Ashy Diary Page

(short story)

ধূসর ডায়েরীর পাতা

আজ সকালে যে সূর্যটা উঠেছিল সেটা অন্যদিনের মত ছিল না। আমি সকালবেলা যখন জানালার ধারে বসে থাকি ; সূর্য ওঠে। সিদ্ধ ডিমের কুসুমের মত ফ্যাকাসে সূর্য। জানালার বাইরের আকাশে দু-চারটে পাখি উড়ে যায় এদিক সেদিক। কাকের কা-কা, চড়ুইয়ের কিচির-মিচির। এ সবের অনেক আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও পাড়ার মোরগটার ডাক শুনলেই আমি বিছানা ছাড়ি। আজকেও মোরগটার ডাকে বিছানা ছেড়েছি। মা-বাবা শুয়ে আছে পাশের ঘরে।
 প্রতিদিনের মত জানালার ধারে বসে সকালের পাখির ডাক শুনছিলাম। ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছিল চারিদিক। তার মধ্যেই এক সময় সূর্য উঠল। একেবারে লাল। সেই-যে হাসপাতালে যখন সিস্টার আমার হাত থেকে রক্ত নিয়েছিল, সেই রক্তের মত লাল। আজকের সূর্য এত লাল কেন?

কতদিন আমি লালের গল্প শুনেছি। তোমার মুখে। লাল ফৌজের গল্প, লাল নিশানের গল্প। বলেছিলে, আমেরিকার মাটিতে শ্রমিকের রক্তে ভেজা কাপড়ে লাল নিশানের জন্ম। আরো বলেছিলে, লাল মন পাল্টায়, সমাজ পাল্টায়, দেশ পাল্টায়। লাল মুক্তির প্রতীক।

আজকের সূর্য এত লাল কেন? এ সূর্য কি আমার মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে? জানো, আমার জীবনেও লাল পরিবর্তনের প্রতীক। ঠিক তোমার কাছে শোনা গল্পের মত। আমার এই চৌদ্দ বছর বয়সে অনেকগুলি লালের মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিটি লাল আমার জীবনে একেকটা বাঁক তৈরি করেছে।

পাঁচ বছর আগে একদিন এক পড়শি বলল,
- ‘বা! তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস্।'
 আরও কিছুদিন পর ঠাকুমা বলল,
—মোটা না ছাই, খোকা ওকে ডাক্তার দেখা।’ ঠাকুমার কাছে ‘মোটা’র বদলে ‘ফোলা’ শব্দটা এল। বাবা নিয়ে গেল ডাক্তার কাকুর কাছে। হোমিওপ্যাথী ডাক্তার। ছোট ছোট অসংখ্য শিশি। তাতে সব জলের মত ওষুধ। আমায় দেখে শুনে ডাক্তারকাকু বলল,
- ‘ও কিচ্ছু না; ঔষধ দিলাম, সাইরা যাইবো।' কিছুদিন ওষুধ খেলাম। কমল না। বরং ফোলা আরেকটু বেশি হল। ডাক্তার কাকু এলেন আমাদের বাড়ি। চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। গায়ের নানা জায়গায় টিপে টিপে দেখলেন। অবশেষে বললেন, 
- ‘ফোলা যহন বাইড়ছে তহ’ন ঔষধে কাম হইতাছে। ঔষধে রোগ বৃদ্ধি ভাল লক্ষণ।' 
কিন্তু ভাল লক্ষণ আর বেশি দিন ভাল থাকল না। ফোলা বাড়ল। মাথা ব্যথা বাড়ল। মাঝে মাঝে জ্বর শুরু হল। অনিয়মিত প্রস্রাব হতে লাগল। একদিন প্রস্রাব করতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। প্রস্রাবের রঙ রক্তের মত! না রক্তই পড়ল। লাল রক্ত। ভয়ে মাকে বললাম। মা শুনল এবং বলল, 
- 'ও কিছু না।' 
কিন্তু আমার তো ভয় হচ্ছিল, কষ্টও হচ্ছিল। বাবার গলা জড়িয়ে আমার ভয়ের কথা বললাম, কষ্টের কথা বললাম। মা বাবাকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। কিছু বলল বাবাকে। কিন্তু বাবা সেটা মানতে চাইল না। অস্পষ্ট কথা, বুঝতে পারছিলাম না। বাবার একটা কথা কানে এল, বেশ জোরেই বলছিলো, 
- ‘কিন্তু খুকির তো সবে নয় বৎসর, এটা অস্বাভাবিক।'

অস্বাভাবিকতার আশঙ্কায় বাবা ব্যাকুল হয়ে উঠল। হোমিওপ্যাথী ছেড়ে এ্যালোপ্যাথী ধরল। ছোট শহর ছেড়ে বড় শহর, তারপর আরও বড় শহর। ইতিমধ্যে খাবারের পরিবর্তন ঘটতে লাগল। বিধি-নিষেধ জারি হ’ল। পরীক্ষা নিরীক্ষার পরিধি বাড়ল। দেহের রক্ত, লাল রক্ত, ছোট ছোট শিশিতে ভরে পরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে লাগল।

আমাকে নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা—সবই স’য়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। রোগটা যে কি—তাই জানতাম না আমি। পরে জেনেছি— নেফ্রাইটিসে ভুগছি আমি। কিন্তু রোগ তো কত জনেরই হয়, আমারও হয়েছে। তাই ভাবনা ছিল না তত। ভাবনা হ’ল মা-বাবার কথায়, তাদের আচরণে।

বড় শহরের বড় হাসপাতালে ছিলাম তিন মাস। হ্যাঁ, একটানা তিন মাস। তুমি তো জান সে সব। সেখানে ভাল ছিলাম আমি। আমার পাশের শয্যায় যে মেয়েটি ছিল, সেও খুব ভাল ছিল। ডাক্তার পিসিও খুব ভাল, ডাক্তার কাকুও খুব ভাল। আর তিন মাস পরে ভাল হয়েই বাড়ি এসেছিলাম। আমি তো বাবার কাছে ছাড়া ঘুমাতাম না। বাবার গলা জড়িয়ে না শুলে আমার ঘুম আসত না। এক রাত্রে সেই ভাবেই ঘুমিয়ে ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলাম। ঘুম চোখে তাকালাম।

জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় দেখলাম বাবা মা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বাবার গলা জড়িয়ে ধরার জন্যে হাত বাড়াতে গেলাম। কিন্তু কেন যেন সেদিন হাত উঠল না। বাবার গলায় তো মায়ের হাত! আমি ঐ ভাবেই শুয়ে রইলাম। একসময় কান্না ভেজা গলায় মা জিজ্ঞেস করল, - ডাক্তার আর কিছু বলল?
- 'একেবারে সুস্থ না হলেও কিছুদিন ভাল থাকবে যদি নিয়মমত ওষুধ পথ্য দেওয়া যায়,'  উত্তর দিল বাবা।

কিন্তু কতদিন ভাল থাকবে তা কিছু বলে নি? ব্যকুল হ’ল মা।
- বলেছে। দুইবছর, চারবছর বা আরেকটু বেশি। কিন্তু তারপর— 
একটু থেমে বাবা হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল, —- - - -খুঁকি না থাকলে আমরা কি নিয়ে থাকব....। কেঁদে উঠল মাও।

শিশি ভরা রক্ত, লাল রক্ত আমার বাবা মাকে হতাশ করেছে। আর আমি জেনে গেছি আমার সময় সীমা—দুই বা চার বা....।

ভোরের আকাশ লাল মেঘে সেজে আছে। সেই লালের সামনে জানালায় বসে তোমায় এত কিছু বলছি কেন—জান? সেই যে তুমি বলেছিলে—মনের গোপনীয় কথাটিও বলতে হয় প্রিয়তম বন্ধুটিকে। আর সবচেয়ে প্রিয়তম বন্ধু হতে পারে মা।'
 কিন্তু মাকে তো এ কথাগুলি বলা যায় না তাই বলছি দু’টো ‘মা’ এর যোগফলের কাছে অর্থাৎ তোমার কাছে। তুমি আরো বলতে——‘পাকা বুড়ি’। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বুড়ি হয়ে গেছি। বুড়িদের সামনে যেমন মৃত্যু অহরহ ঘোরা ফেরা করে—তেমনি আমিও তোমাদের অনেক আগেই চলে যাব।

জান, মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছিল সে রাত্রে, সেই ঝড় ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছিল। স্কুলে যেতাম। কামাই করতাম। ওষুধ খেতাম। আবার ভাল থাকতাম । ভালই ছিলাম তিন বছর। তারপর আবার একদিন লাল রক্ত নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। মাকে বললাম। মা বাবাকে বলল। বাবা কিন্তু এবার আর অস্বাভাবিক বলল না। মা আমাকে একান্তে অনেক কথা বলল। আমি শুনলাম। শুনতে শুনতে বার বছর বয়সে আমি বয়স্ক হয়ে উঠলাম।

তোমার ‘পাকা বুড়ি’ এরপর একটা কাণ্ড করল। এটাকে তুমি পাকামিও বলতে পার। আমি তো তখনও বাবার গলা জড়িয়ে শুতাম। অলক্ষ্যে মা বাবার হা-হুতাশও শুনতাম। তাদের একমাত্র সন্তান আমি। তাদের মত আমিও জানি, আর বেশিদিন বাঁচব না। কি নিয়ে কাকে নিয়ে থাকবে তারা? একদিন বাবার কাছে আব্দার করলাম,
-  ‘বাবা আমি পাশের ঘরে একলা শোব।' 
বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কি জানি কি ভাবল। কষ্টই পেল বাবা। কিন্তু কি করব বল— আমারও তো কষ্ট হচ্ছিল। আমি যদি বাবা মার কাছ থেকে দূরে না থাকি, আমার মত আরেকজন তো আসবার সুযোগ পাবে না। শুধু তাই নয়, একদিন বাবার মাথার পাকা চুল তুলতে তুলতে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
-  'বাবা, আমাকে যেমন তোমরা হাসপাতাল থেকে এনেছিলে তেমনি আমায় একটা ভাই বা বোন এনে দাও না। বাড়িতে একটা খেলার সাথী না থাকলে আমার ভাল লাগে না।' 
আমি জানতাম বাবা আমার জন্যে অসাধ্য সাধন করতে রাজি। সেদিন বাবা একটা কথাও বলেনি, কেবল আমায় জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছেছিল।

একা ঘরে থাকি আমি। ভাল লাগে না আমার। বাবাকে ছাড়া প্রথমে ঘুমই আসত না। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়। তোমায় তো বলেছি, বার বছর বয়সেই অনেক বয়স্ক হয়ে গেছি আমি। অন্য একদিনের ঘটনায় বুঝতে পারি আরো বেশি করে। গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়েছিলাম চোখ বুঁজে । কপালে একজন হাত রাখল। জানো, বাবার হাতের থেকে আলাদা ছোঁয়া, আলাদা অনুভূতি এনে দিয়েছিল সেদিন। ওপাড়ার মোরগ ডাকা বাড়ির চাচার ছেলে। আমার থেকে দু’তিন বছরের বড়। বার বছরের লাল আমার জীবনে একরাশ রঙ নিয়ে এল। রঙিন স্বপ্ন দেখতে লাগলাম আমি।

মোরগ ডাকা ভোরে আমি জানালার কাছে আসি। আমি জানি, মোরগ ডাকা ভোরেই আরেকটা মানুষ আমাকে দেখা দেবে। লাল সূর্য দেখলে তোমার কথা ভাবি। তুমি বলতে, 
- ‘লাল পতাকা একদিন সব দেশ একাকার করে দেবে। সব মানুষ একাকার করে দেবে।' 
সব মানুষ যদি এক হয় তবে তো সব জাতি, সব ধর্ম এক হয়ে যাবে। তা হলেই আমার স্বপ্ন সফল হবে। ও পাড়ার চাচার ছেলের ধর্ম আর আমার ধর্ম এক হয়ে যাবে। আমি অসম্ভবকে ছুঁতে পারব। তাই আমি তোমার মত স্বপ্ন দেখি, লালের স্বপ্ন, লাল পতাকার স্বপ্ন।

শরীরের যন্ত্রণা মাঝে মাঝে বাড়ে। সব সময় মা বাবাকে বলি না। কিছুটা নিজেকে আত্মস্থ করতে হয়। আমার যন্ত্রণা প্রকাশ পেলে ওদের যন্ত্রণাও বাড়ে। ইদানিং শরীরটা বাগে থাকতে চাইছে না। আমার দেহের মধ্যে যে ঝাড়ুদার আছে সে ঠিক মত কাজ করতে পারছে না। বর্জ পদার্থগুলি জমে যাচ্ছে রক্তের মধ্যে, দেহের আনাচে কানাচে। প্রস্রাব হয় না ঠিক মত। প্রস্রাবে আবার রক্তের দেখা পাই।

কয়দিন আগে দোল উৎসব হয়ে গেল। রঙ-এর ভাবনায় লাল আবিরে ডুবে গেলাম। শরীরের সব বাঁধা ভুলে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করছিলাম। চাচার ছেলে যখন পিছু নিল পালাতে যাচ্ছিলাম। আর তখনি পৃথিবীটা দুলে উঠল, অন্ধকার হয়ে গেল সব। ফের যখন চোখ মেললাম—আমার চারপাশে অনেক লোক, বাবা, মা, পড়শিরা। ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি।


তারপর থেকে স্কুল বন্ধ আমার। খুব তাড়াতাড়ি সেই বড় হাসপাতালে যেতে হবে। সেই ডাক্তার পিসির সাথে দেখা হবে। ডাক্তার কাকুর সাথে, তোমার সাথেও দেখা হবে। আবার তোমার কাছে গল্প শুনব। আর তুমি যদি মুখখানা হাঁড়ি করে রাখ, তোমাকে গল্প শোনাব আমি। জাতকের গল্প। গল্প শেষে তোমাকে পাঠাব পাড়ায় পাড়ায়, দোরে দোরে। একটা মৃত্যুহীন পরিবারের সন্ধান যদি তুমি পাও তবেই তোমার হাঁড়ি মুখের দিকে তাকাব আমি। তোমরা কষ্ট পেলে আমারও যে কষ্ট হয়। তখন আমার কেবল রোগের কথা মনে হয়। কিন্তু আমার তো ভাল থাকতে ইচ্ছা করে। তোমরা সবাই যদি স্বাভাবিক থাকো, আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে মশগুল থাকতে পারি। যোগ বিয়োগের একটা সাধারণ হিসাব ছাড়া তো অন্য কিছু নয় ; এ পৃথিবীটা তোমরা ছাড়তে, আমিও ছাড়তাম। ব্যতিক্রম এই আমি তোমাদের একটু আগেই ছাড়ব।

যে ডায়েরিটায় তোমাকে লিখছি তার রঙ ধূসর। কিন্তু এর পাতায় পাতায় অনেক রঙ,—তুমি খুঁজে নিও। এই ধূসর ডায়েরির পাতায় একদিন আমি হারিয়ে যাব। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলি থাকবে, আমার ভাই অথবা বোন থাকবে, ওপাড়ার চাচার ছেলে থাকবে। যে স্বপ্নগুলি আমি লালন করতাম, তোমরা সবাই মিলে সেগুলি বাস্তবায়িত ক’রো। তোমাদের নিরন্তর চেষ্টায় আমি, আমার মত অনেক মানুষ বেঁচে থাকব।
***

সাগর সংস্কৃতি, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭


বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সমীকরণ । Equalization

(Short story)

মেয়েটার মাথায় এখন বীজগণিত। সমীকরণের সমীরণ। কলমের ডগায় চুল জড়িয়ে টেনে-হিঁচড়ে, কপালে কলম দিয়ে ঠক্ ঠক্ শব্দ তুলে, নাকের ডগায় দুর্যোধনের উরু ভাঙ্গার অসফল চেষ্টা করে, হাতের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত ভাগ্য রেখার ওপর ভারতের রেলপথের ম্যাপ এঁকে অবশেষে বাপের শরণাপন্ন । তার মাতৃদেবী বুনো কচুর সমস্ত র‍্যাফাইডগুলি চিরতার জল মিশানো কণ্ঠে আমার দিকে নিক্ষেপ করে এখন রান্না ঘরে রুদ্র বীণা বাজাচ্ছেন। ঝন ঝন্ শব্দের মহালয় তারই প্রকাশ। কিন্তু আমার সমস্যা বিড়াল–আমার পড়ার ঘরে বংশ পরম্পরায় ইজারা নিয়েছে সে, মানে তারা।

কবে যে এসেছিল সেটা আমার মনে নেই। কোথা থেকে এসেছিল তা তো জানিই না। তবে তার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন। সে বলতে যদিও একজনকে বোঝাচ্ছি, বাস্তবে একজন নয়। চতুর্থ বংশধর। সাদা মুখের কালো বিড়ালটা। জাতিতে মেয়ে। ‘মেয়ে জাত সহজে মরে না' প্রবাদকে সত্যে উপনীত করার জন্যেই বংশপরম্পরায় ওদের বংশ মেয়ের বংশ। আরেকটা ব্যাপারেও এদের মিল দেখেছি, সবার রংয়ের মধ্যেই কালোর আধিক্য। কারো লেজ সাদা, কারো পিঠ সাদা, কারো পেট বা ঠ্যাং সাদা। কিন্তু বাকি সব কালো। ব্যতিক্রমী যারা জন্মেছিল, বেঁচে থাকা তাদের হয়নি।

সে কিন্তু পোষা নয় বা তারা কেউই পোষা ছিল না। আদর-যত্ন মোটেই পেত না বাড়ির কারো কাছে। একেবারেই অচ্ছুত ছিল। এঁটো-কাঁটা খেয়েই বাঁচত। এঁটো-কাঁটাগুলো যে ওদের সামনে তুলে ধরতাম, তাও নয়। মাছ মাংস আমরা আয়েশ করেই খেতাম্ বা খাই। চেয়ারে পা দুলিয়ে টেবিলে খাবার রেখে খাই। অলক্ষ্যে টেবিলের তলায় জড় হয় সে বা তারা। টেবিলের উপরেরটা তো দেখতে পারে না, পা দোলানী দেখে। হয়তো কান খাড়া করে আয়েশি মুখের শব্দ শোনে। শব্দ না শুনলেও গন্ধ শোঁকে নিশ্চিত। খাবারের ইচ্ছেটা চাপা দিতে পারে না, অজান্তেই মুখ দিয়ে মিউ-মিউ মিহি স্বর বেরিয়ে আসে। মাথা নিচু করলে দেখতে পাই আধ-বোজা বিনয়ে পায়ের ধারে বসে যেন মিনতি করছে—বাপ, দুটো খাবার। খাবার সময়ে এই বিনয়-বিনয় ভাব একদম পছন্দ হয় না। কেমন ভিখিরি স্বভাব। চাণক্য স্বভাবে খাওয়া ফেলে তেড়ে যাই বা জুতোর গোত্তা লাগাই,  মুখে-বুকে যেখানেই লাগুক না কেন। আত্মরক্ষায় দৌড়ে পালায়। নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষা করে। খাওয়া শেষ করে এঁটো-কাঁটায় জল মিশাই। ওদের প্রতি হিংসা করে জল মিশাই না, স্বভাববশতই মিশাই। জল মিশানোর পর সেগুলো ফেলনা খাবার হয়ে যায়। বিড়ালের পক্ষেও তা আর খাবারযোগ্য থাকে না। তবু সেই ফেলনা চেটে-পুটেই বেঁচে আছে তারা। রোগা লিক্‌লিকে হয়ে এভাবেই বেঁচে থাকে। খিদের তাগিদে দেয়াল টপকে এ-বাড়ি সে বাড়িও যায়।

সাদা মুখের কালো বিড়ালটার তখনো জন্ম হয়নি। পেট ভারী তার মা ঘুরে বেড়ায়। আমাদের চোখে এটা সাধারণ ঘটনা। তার পেটটা তো সারা বছরই ভারী থাকে। সেই রকম ভারী পেটে রান্না ঘরের আশে পাশেই ঘোরে বেশি। এই সময় বড়বেশী ম্যাও-ম্যাও করে। খিদে-টিদে বাড়ে বোধ হয়। আমার গিন্নিও সেই সময় পোয়াতি। তাকে সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সব ভিটামিনযুক্ত খাবার খেতে হয়। তো বিপত্তি ঘটলো একদিন। কাজের মেয়েটা ছিল না। রান্না ঘরে গিন্নিকেই ঢুকতে হয়েছে। বিড়ালটা প্রায় পায়ে পায়ে ঘুরছে। ম্যাও ম্যাও তো আছেই। বিরক্ত হয়ে আমি একবার ঝাটা দিয়ে অতর্কিতে মারলাম। দৌড়াবার সামর্থ ততটা ছিল না, যথাসাধ্য ভারী শরীরটা নিয়ে বাইরে গেল। চোখের আড়ালে গেল না, দাঁড়িয়ে আমার দিকে চোখ রেখে হাঁফাতে লাগল। আমি সরে যেতেই আবার পায়ে পায়ে এসে গিন্নির পায়ের কাছে হাজির।

ভাতের ফ্যান বাইরে ফেলবার দরকার ছিল। গিন্নি ফ্যানের গামলাটা নিয়ে দরজার বাইরে গেল। পায়ে পায়ে ডাকতে ডাকতে বিড়ালটাও ৷ হয়তো তার লক্ষ্য ছিল ফ্যান বা ভিতরের দু’চারটে ভাত। কিন্তু আমার গিন্নি বিড়ালের জ্বালাতন সহ্য করতে পারল না। পায়ে জড়াতে থাকলে কঁহাতক সহ্য করা যায়? বিড়ালের জন্যে সে নিজে যদি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়? বিরক্ত হয়ে গিন্নি প্রথমে বিড়ালটাকে একটা লাথি মারল। তারপরই গরম ফ্যান ঢেলে দিল বিড়ালটার গায়।

কষ্ট হয়েছিল বৈকি। গরম ফ্যান পোয়াতি বিড়ালের গায়ে ঢালার পর বিড়ালের দুর্দশায় কষ্ট পেয়েছিলাম আমরাও। সাদা মুখের মায়ের জন্যে সেই একবারই মাত্র কষ্ট হয়েছিল আমার। কয়েকদিনের জন্যে সারা গায়ে দগদগে ঘা হয়ে গেল। কষ্টের বদলে ঘেন্না জায়গা দখল করল ধীরে ধীরে। তাছাড়া স্বস্তি পাচ্ছিলাম অন্য কথা ভেবে। বিড়ালটার জন্যে আমার গিন্নিরও একই দশা হতে পারত। গিন্নি যদি পড়ে যেত, যদি ফ্যানে পুড়ে যেত সারা গা! ভাবতেও কেমন শিউরে উঠি। ভাগ্যিস সেরকম কিছু ঘটেনি।

সাদা মুখের কালো বিড়ালটা আমার দেখা চতুর্থ বংশধর। পেটে খাবার থাক বা না থাক সে এখন কৈশোরে হুট্-পাট করছে। মাতৃপন্থী হতে আরেকটু সময় লাগবে। অঘটন ঘটবার সম্ভাবনা তো আমি দেখি না, মায়েদের অনুসারী তাকে হতেই হবে। এটাই নিয়ম। কিসের নিয়ম, কেন নিয়ম— সে সব আমি জানি না। তবে পেটে যাদের নিশ্চিন্ত খাবার জোটে না দু’বেলা। তাদের নিয়ম এরকমই। পায়ে পায়ে চলাটাই নিয়ম।

সাদা মুখের পূর্ব মায়েদের ভূমিকা ছিল এক। সবাই এঁটো-কাঁটা খেয়ে কোন মতে জীবন ধারণ করত আর সন্তানের জন্ম দিত। আর তাদের জন্যে আমার ভূমিকা ছিল সাফাইওয়ালার মত। এত মারধোর করতাম অথচ ঠিক কোন এক ঘরে জন্ম দিত সন্তানের। ওর প্রথম মা-র কথাই বলি। কৈশোর পেরোবার সন্ধিক্ষণে কোথা থেকে একটা মদ্দা বিড়াল এসে হাজির হল। দু'চার দিন পরে আরো দু’চারটা। প্রথম দু’চারদিন পালিয়ে বা লুকিয়ে বেড়াল। হয়তো ভয়ে বা অন্য কোন কারণে। তারপরই সে সাহসী হয়ে উঠল। মহারাণীর চালে নিজের মত চলাফেরা করে। তার পিছে কয়েকটা মদ্দা। মাঝে মাঝে মদ্দা-বিড়ালের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় মাঝরাতে। নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া করে। রাণী একপাশে চুপচাপ। যে জেতে সেই অধিকার পায় তার।

এইভাবে চলতে চলতে ভারী হয়ে আসে মহারাণীর শরীর। তখন আর সে মহারাণী থাকে না। এক এক করে সরে পড়ে মদ্দা বিড়ালেরা। সে তখন রান্না ঘরের আশেপাশে সময় কাটায়। পায়ে পায়ে ঘোরে। তার আসন্ন মাতৃত্বের চিন্তায় আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। তিতিবিরক্ত হয়ে উঠি বিড়ালের বাচ্চা প্রসবে। নিরাপদ কোন জায়গায় তিন বা চারটে বাচ্চার জন্ম দেয়। ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হই আমরা। একটার জ্বালাতনে দিশেহারা, আবার যদি চারটা বা পাঁচটা বিড়াল বাড়িতে থাকে! অগত্যা নির্মম হতে হয়। তুলোর মত তুলতুলে বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটবার আগেই ব্যাগ-বন্দি করে রাতের অন্ধকারে অন্যপাড়ায় বা খালের ধারে বা নির্জন ভাগাড়ে ফেলে আসি। জীবিত অবস্থায়ই রেখে আসি। ভেবে সান্তনা পাই—জীব হত্যার পাপ থেকে তো রক্ষা পেয়েছি। ভগবানের সৃষ্টি ভগবানের জিম্মায় রেখে আসি। প্রায় স্নান করে যখন ঘরে ফিরি, গিন্নির তৃপ্তি মাখা হাসি মনে স্বস্তি দেয়।

সন্তানহারা মা দু’চারদিন বড় করুণভাবে ডাকে। এ-ঘর সে ঘর যায়। ঘরের আশে-পাশে ঘুরে ডাকতে থাকে। আমার গিন্নি এই করুণ কান্না একদম সইতে পারে না। গরমের মধ্যেও জানালা দরজা সব বন্ধ করে দেয়। বিড়ালের কান্না যাতে কানে না প্রবেশ করে তার সব ব্যবস্থা করে।

কিন্তু দু’চারদিনের মধ্যেই অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। মদ্দাগুলি আবার জড় হয়। প্রথমে দূরে দূরে বসে থাকে। দূরত্ব কমতে থাকে আস্তে আস্তে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আবার।

ইতিমধ্যে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি, যা আমাকে অনেকটা স্বস্তি দেয়। সন্তান প্রসবের পর আমাকে আর বস্তায় বা থলিতে করে বাচ্চাদের দূরে ফেলতে হয় না ৷ মদ্দাগুলোই দূরে সরাবার ব্যবস্থা করে। প্রসবের কয়েকদিনের মধ্যে তারা এসে হাজির হয়। ওৎ পেতে থাকে। এইসময় মা সহজে তাদের কাছে ভেড়ে না। তাই হয়তো রেগে যায় তারা। সব রাগ গিয়ে পড়ে বাচ্চাদের উপর। ফাঁক পেলেই তীব্রগতিতে বাচ্চাদের কাছে যায়। চকিতে ঘাড়ের কাছে কামড় বসায়। তাতেই কেল্লা ফতে। এক এক করে সন্তান হারাতে থাকে মা।

ক্রমাগত সন্তান হারাতে হারাতে মায়েরা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। বয়েস বাড়ে তাদের। শেষের দিকে সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। লুকোচুরি খেলা চলে ৷ আমাদের সাথে, মদ্দাদের সাথে। তারই ফলে বেঁচে যায় কেউ কেউ। যেমন সাদা মুখের কালো বিড়াল ছানা বেঁচেছে, যেমন তার মা বেঁচেছে।

পোড়া দেহ নিয়েই সাদা মুখের জন্ম দেয়। কাঁচ ভাঙ্গা আলমারীর ভিতরে আঁতুড় ঘর বানায় মা। সবার অলক্ষ্যে জন্ম নেয় তারা। মোট তিনজন। যতই গোপনীয়তা থাকুক, অবোধ বাচ্চাদের মিহি ডাকে চেতন বাড়ে আমাদের। জাগ্রত চেতনায় হাজির হয় মদ্দারাও। চামড়াখসা পোড়া দেহও তাদের কামনা, হিংসা দমাতে পারে না। ভাঙ্গা আলমারীর ফাকে ঢুকে দাঁত বসাতে পারে না তারা। ওৎ পেতে বসে থাকে। আমিও চেষ্টা করি বাচ্চাদের বের করার। কিন্তু মা-বিড়ালের ধারালো দাঁতের শাসানীতে পিছু হঠতে হয়। সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।

সন্তানের দুধের যোগান দেবার জন্যে নিজের খিদের কাছে হার মানতে হয়। সন্তর্পণে বেরিয়ে যায় খাবারের সন্ধানে। তাড়াতাড়ি করে চোেখ না ফোটা দুটো বাচ্চা বের করি। মিহি স্বরে ডাকতে থাকে তারা। তৃতীয়টা বের করার আগেই ছুটে আসে তাদের মা। বাইরে রাখা দুটোকে মুখে করে দ্রুত সরে পড়ে। তৃতীয়টা বের করে ভাগাড়ে চালান দিতে সচেষ্ট হই।

নিরাপদ জায়গা হারিয়ে ত্রস্ত হয় মা। লুকোচুরি শুরু হয়। এঘর সে ঘর, চৌকির তলা, আড়াল-আবডাল করতে থাকে। হুলোদের ভয়, গৃহস্বামীর ভয় বাচ্চাদের কাছ ছাড়া হতে চায় না। এরই মধ্যে হঠাৎ চিৎকার শুনি মা বিড়ালের। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে একটি বাচ্চা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রাণহীন হয়ে যায়। ওৎ পেতে থাকা হুলো শত্রু নিধন করে ফিরে গেছে। মৃত সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে অদ্ভুতস্বরে ডাকছে মা। অসহায় ভাবে তাকাচ্ছে একবার আমার দিকে, একবার মৃত সন্তানের দিকে। একটু আড়ালে দাঁড়াই। মৃত বাচ্চাটাকে মুখে করে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে পাঁচিলের আড়ালে চলে যায় মা।

বাচ্চার সংখ্যা ছিল তিন। গতায়ু হল দুই। আরেকটা কোথায়? খুঁজতে থাকি। কিন্তু পাই না। মা বিড়ালকে দেখি বটে। বাচ্চাকে দেখি না। মনে মনে আশ্বস্ত হই, নিশ্চয়ই হুলো মেরে ফেলেছে। যাক্ আবার কিছুদিন নিশ্চিন্ত!

হঠাৎ একদিন পায়রার হাড় চিবোতে চিবোতে আবিষ্কার করি সাদা মুখো কালো বিড়াল ছানাকে। নিরাপদ বয়সের মায়ের ছোটবেলা নিয়ে হাজির সে। মনে হচ্ছিল পিট্‌পিট চোখে কংস মামাকে জিভ ভ্যাঙাতে হাজির হয়েছে সে। বুঝতে পারলাম, মাতা-মাতামহীদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাকে শিক্ষা দিতে প্রস্তুত সে।

পোড়া দেহের ক্ষত নিয়ে ওর মা আরো রোগা হয়েছে। মাঝে মাঝে দেখতে পাই। সন্তানকে এঁটো-কাটার নিরাপদ আস্তানায় রেখে মা তখন বিবাগী। এক সকালে ধীর পায়ে দেয়ালের উপর হাঁটতে দেখলাম একটা হুলোকে। অনেকদিন পর। বুঝতে পারলাম। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়ে হাজির সাদা মুখো বিড়াল।

রেল জংসন। চারনম্বর প্লাটফর্ম যেন চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিক। এক, দুই, তিন থেকে চারের অকৌলীন্য সহজেই চোখে পড়ে। যেন তার বাসিন্দারা, পরজীবী এঁটেল পোকার মত। তাড়ালেও যায় না। কামড়ে পড়ে থাকে ষ্টেশন চত্বরে। তাড়িয়ে দিলেও দু’চারদিনের মধ্যে আবার এসে জড় হয়। ছেলে-মেয়ে, জীবন জীবিকা, ঘর-সংসার—সবকিছুই তাদের ষ্টেশন ঘিরে।

এক পরজীবী পরিবারের সদস্য বোবা মেয়েটি। কোমরে ঢিলে রবারের প্যান্ট, কালো, তেলহীন তামাটে চুল। লুডো খেলে, গুলি খেলে, কখনো এক্কা-দোক্কা। আগাছার মত জন্মানো হাড় জির-জিরে বাচ্চাদের কোলে নেয়। বাবাকে দেখেনি কোনদিন। প্রকাশ্য আলোয় তার বাবার অস্তিত্ব নেই বলে। যেমন ছিল না তার মায়ের বাবা, যেমন ছিল না তার দিদিমার বাবা। বোবা মেয়েটি কৈশোরের শেষের লজ্জার মুখোমুখি আজ। সাদা মুখের কালো বিড়ালটির সাথে কখনো দেখা হয়নি তার। যদিও কয়েকটি শব্দ ওলট-পালট করলে ওদের জীবন অভিন্ন। 

মেয়েকে সমীকরণ বোঝাতে সচেষ্ট হই।

শিকার । Hunting



বক-বকম -

এঁদের জীবনে শব্দটা খুব মানানসই। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স দু'জনের। সেই  কবে থেকে ক্লাশ ডিঙোতে ডিঙোতে দু’জনের বক্-বকম্ শুরু হয়েছিল।সেই বক্-বকম্ আর থামেনি। চেষ্টা চলেছিল বৈকি। ছেলের বাপ তার রাজপুত্রের মত ছেলেকে থামাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কি যে দেখেছিল সে একটা কালো, নাদুস-নুদুস, কৌলিন্যহীন মেয়ের মধ্যে ! বাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘর বেঁধেছিল তারা।

ঘর বেঁধেছিল বটে তবে ঘর ভরতে পারেনি। কেন যে ঘরে কোন নতুন  অতিথি এল না,— জানে না তারা। তবু বক্-বকম্ তাদের থামেনি। প্রাণের জোয়ার ছিল বড় বেশি। আর সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একদিন গেঁটে বাতে বিছানায় আশ্রয় নিল গৃহিনী। আর সেই সুবাদে দু’জনেরই অফিসের হাজিরা খাতায় ছুটি শব্দটা যোগ হয়ে গেল বেশ কয়েক দিনের।


কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। চলতে পারে না বলেই কাজের মেয়ের খোঁজ করতে হল। এবং খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল—“কোন এক গাঁয়ের বধূ।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল গৃহিনী। আবার হাজিরা খাতায় সই করতে লাগল। সেই সঙ্গে বাড়ির প্রাত্যহিক কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল কাজের মেয়েটা। সে হয়ে উঠল ‘অপরিহার্য। গৃহকর্তা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন –বক বকম  ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয় গৃহিনীকে। সে কাজে সহযোগিতা করার দায় তো তারই। আর সেই জন্যেই স্থায়ী হয়ে গেল কাজের মেয়েটা।

সময় যাচ্ছিল উচ্ছ্বাসেই। বিশেষ করে বাড়ির কর্তার। কর্তার এই উচ্ছাসের রেশ ধরে হিসাব কষলেন গৃহিনী। কর্তার বক বকম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তার বাড়িতে হাজিরা। তার গেঁটে বাতের পর বাড়িটাকে বড় বেশি এঁটে ধরেছে কর্তা। গৃহিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল। বিপদের আঁচ পেলেন তিনি। ঝাকুনি খেল তার মনের সিংহাসন। অস্থির হয়ে উঠলেন। একদিন বক্-বকম্ করতে করতেই পাড়লেন কথাটা। কর্তা কিন্তু অভিযোগ স্বীকার করলো না। গৃহিনীর বড় বাড়াবাড়ি। কয়েক দিনের জন্য নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল সংসার।


কর্তা ভাবলেন কয়েকটা দিন। ফিরে দেখলেন নিজেকে। সত্যিই তো কাদা জমেছে তার মনে! ভাবলেন ধুয়ে ফেলবেন। গৃহিনীর মুখোমুখি হলেন আবার।

--বাবা বলতেন, তুমি কালো। কিন্তু আমি তোমার মধ্যে কোন কালো খুঁজে পাইনি, খুঁজে পেয়েছিলাম মনের সত্যকে। সেই সত্যকে আমি বেছে নিয়েছিলাম। 

গৃহিনীর নিরস মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন। কথার যাদু জানেন কর্তা। সেই যাদুতে স্পষ্ট দলিল লিখতে সচেষ্ট হন 

--কিন্তু আরো এক সত্যের মুখোমুখি আমি। এই বুড়োবয়সেও পথে-ঘাটে তোমাকে খুঁজি, তোমার দিকে লোভীর মত তাকিয়ে থাকি আমি—আমাদের সেই প্রথম জীবনের অষ্টাদশী নাদুস-নুদুস্ তোমাকে।

নীরস মুখে হাসির আভাস মেলে। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে যায় কর্তার পরের কথায়, 

–বাড়ির কাজের মেয়েটা আমার সেই পুরনো লোভটাকে জাগিয়ে দিয়েছে।

কর্তার মনের কাদার ছোপ লাগল গৃহিনীর। স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। আবার থমথমে ভাব। দু’জনের মাঝে চোরকাটা জমে উঠেছে ধীরে ধীরে। বক্-বকম্ আর

জমে উঠছে না কোন মতেই। চেষ্টা করলেন গৃহিনী। সেই চেষ্টার প্রথম ধাপে কয়েক দিনের মধ্যেই কাজের মেয়েকে বিদায় দিলেন।


অভ্যস্ত জীবনটায় টান পড়ল আবার । অফিস ও রান্নাঘরের ঠুন-ঠানের সাথে মানিয়ে নিতে চাইলেন আগের মতন। দু'জনেই প্রাণ খুলে আবার আসর বসাতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে। গোপনীয়তার কাদা উঠে গেল ধীরে ধীরে। আর সেই ধোয়া মনে পরিষ্কার হয়ে গেল কর্তার লোভের দাগটা। নিত্যদিনের আলোচনা - অফিস, বাস, ট্রাম, স্কুলের গেট—সবকিছুর মাঝখানেই একটা বিষয় ঘুরে ফিরে আসতে লাগল; নাদুস নুদুস্ – অষ্টাদশী.... । তবু এই সব প্রাথমিক আলোচনার

মাঝে অপ্রাসঙ্গিক কিছু খুঁজে পাননি গৃহিনী, কিন্তু হঠাৎই একদিন গৃহিনীর ভাবনার আকাশে মেঘ জমল। সেদিন একটু রাত করে বাড়ি এলেন কর্তা। বেশ হাসি

খুশি, টগবগে। গৃহিনী বুঝতেই পারছিলেন বক্-বকমের জোয়ার বইবে আজ।

তাড়াতাড়ি সব কাজ গুছিয়ে মুখোমুখি হলেন কর্তার।

--একটু ঘুর পথে ফিরলাম আজ । নিজেই শুরু করলেন কর্তা।

--কোথায় গিয়েছিলে?-পানে চুন লাগাতে লাগাতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন তিনি।

-- হাটে।

-- হাটে? এই শহরে হাট?

--শুনেছি অনেক দিন—এই শহরেই হাট বসে। বেশ জমজমাট হাট। প্রতিদিন। প্রতিক্ষণ। তবে বিক্রি হয় মাত্র একটাই জিনিস। পুতুল। বিবরণ কেন্দ্রীভূত হয়।

--পুতুল? সে কি গো——কোথায় সেটা, কেমন পুতুল?—উৎসুক প্রশ্ন করে এক নাগাড়ে।

--হ্যা পুতুল। তবে মাটির নয়, প্লাস্টিকেরও নয়। রক্ত-মাংসের।

গৃহিনীর ইন্দ্রিয় সজাগ হয়। বাক্যহারা হয়ে যান তিনি। বলতে থাকেন কর্তা,

--মেলার পুতুল তো দেখেছ-- ছোট, বড়, নানা আকারের। এ মেলায়ও ছেট, বড় নানা আকারের রক্ত মাংসের পুতুল পয়সায় মেলে। তবে বাড়ি আনা যায় না।। যতক্ষণ পয়সার রেশ থাকে ততক্ষণ তোমার। অনর্গল কথা বলে যায় কর্তা।

কিন্তু গৃহিনীর কানে পৌঁছায় না সে সব । শব্দের কোলাহলে নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় গৃহিনী। কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন-- সে প্রশ্ন আর করতে হয় না। বুঝতে পারে অতীতের সেই লোভী মানুষটা আবার জেগে উঠছে। শিকার খুঁজছে সে, নাদুস-নুদুস– অষ্টাদশী।


কিন্তু কি করবে গৃহিনী? কি সে করতে পারে? তার ভালবাসার এই লোভী মানুষটাকে সে কি ছেড়ে দেবে শিকারের দিকে? এই লোেভ মিটাবার সামর্থ্য তো তার নেই। তবে সে কি জোর করে বশীভূত করে রাখবে? সে কি এই স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনায় জল ঢেলে দেবে? কর্তাকে বাধ্য করবে এই সব অলোচনার প্রসঙ্গ না তুলতে? কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? সেকি পারবে তার কর্তার মনের মাঝে বাসা বাঁধা লোভী সত্তাটাকে উপড়ে ফেলতে?

ভাবনায় রাতের ঘুম চলে যায় গৃহিনীর। যে রাজপুত্রকে সে খাঁচায় বন্দী করেছিল—সে তো খাঁচায় আছে এখনো। দরজা খোলা পেয়েও পালায়নি। হয়তো সেও ভালবেসে ফেলেছে এই খাঁচাকে খোলা দরজায় না পালিয়ে বরং সে উঁকি-ঝুঁকি মারতে ভালবাসে। খাঁচায় থেকেই সে অষ্টাদশীর ছোঁয়া পেতে চায়। কি করবে গৃহিনী! সে খাঁচার দরজা শক্ত করে আটকে দেবে? কিন্তু পুরুষের তৈরি খাঁচায় সে কি পুরুষকে আটকে রাখতে পারবে? তাদের যে হাজার দরজা খোলা। ভাবতে থাকে গৃহিনী। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা মাথার মধ্যে ডাকতে থাকে একটানা। যতই সে বন্দী করুক -এ আকাশ পুরুষের, একা পুরুষের। তবু তার ইচ্ছা করে এ পাখি তার একার থাক। সে তার বক্-বকম্ হারাতে চায় না। তার রাজপুত্র তারই, একান্তভাবেই তার।

অফিসে গিয়ে উলের কাঁটা নাড়তে নাড়তে পাশের টেবিলের সহকর্মীকে গিট-বাতের কথা বলে। ঘর মোছার কষ্ট, কাপড় কাচার কষ্ট, সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট। আর বলে একটা মেয়ের কথা। কাজের মেয়ে। একজন অষ্টাদশী চাই তার। নাদুস-নুদুস হলেই ভাল। তার সুন্দর ঘরে, সারা জীবনের সাজানো ঘরের মানান সই একজন মানুষ চাই। পয়সার কথা ভাবে না সে। সে ভাবে ঘরের মানুষের কথা।

যরের মানুষের ঘরে ফেরার কথা।

সহকর্মীর আকুতিতে সাড়া দেয় সহকর্মী। দুর গ্রাম থেকে নিয়ে আসে একজনকে।

বাপ মরা মেয়ে। মায়ের বুক ছিঁড়ে চলে আসে দুটো ভাতের আশায়, ভাল থাকার আশায়। বুড়ো-বুড়ির সংসার । সাজানো সংসার । ভাবনার কিছু না পেয়ে নিশ্চিন্তে সহকর্মীর হাতে তুলে দেয় সহকর্মী।

লাজুক মেয়ের জটা চুলে হাত বোলায় গৃহিনী। গভীর মমতায়। ভালবাসতে চায়। সুগন্ধী সাবান আর শ্যাম্পুতে স্নান করায় তাকে। নতুন জামা পরায়। সুন্দর ঘরের উপযোগী করে সাজায়।

অফিস আবার আগের মত তাড়াতাড়ি ছুটি হতে থাকে। এই শহরের হাটে একজন হাটুরে কমে যায়। বক্-বকম্ বাড়ে। রান্না ঘরে আনা-গোনা বাড়ে। ঝি ঝিঁ পোকার ডাক আর একঘেয়ে থাকে না, চুড়ির শব্দ যোগ হয় তাতে। বক-বকমের মাত্রা বাড়ে, রাত বাড়ে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে গৃহিনী। বাতের ব্যথায় জেগে ওঠে আবার। অভ্যস্ত হাতটা শূন্য লাগে। হাতড়ায় , চোখ মেলে অন্ধকারে তন্ন তন্ন করে খোঁজে । পায় না কিছু। শুধু একটা আওয়াজ ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে—খট্ খট্। গৃহিনী বুকের মধ্যের গৃহটাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। বুকটা কেমন ফাঁকা হতে থাকে। প্রাণপণে বালিশ চাপে বুকে। বালিশে, বিছানায় গন্ধ খোঁজে, সুগন্ধী সাবানের , শ্যাম্পুর; তার নিজের তেরি গন্ধে সতেজ হতে চায়। সুগন্ধ খুঁজে পায় না। চারিদিক থেকে কেবল খট্ খট্ আওয়াজে কেঁপে ওঠে, ইটগুলো খসে পড়তে চায়। দু'কানে আঙ্গুল চেপে শব্দটা আটকাতে চায়; আর জোর করে সে অষ্টাদশী হতে চায়, নাদুস-নুদুস অষ্টাদশী।


ভোর হয়। পাখির পালকের মত বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে যান কর্তা।

কাজের মেয়েটি গাঁয়ের মেয়ে হয়ে দাঁড়ায় গৃহিনীর সামনে। পরনে পুরনো জামা, খালি পা, এলো চুল। সরাসরি তাকায় গৃহিনীর চোখের দিকে। গৃহিনী কিছু বলার আগেই হাত বাড়ায় মেয়েটি। ভাঙা চুড়িগুলি গৃহিনীকে ফেরৎ দেয়। ছোট্ট পুঁটলী হাতে লোহার গেট পেরিয়ে জংলা গাঁয়ের দিকে হেঁটে চলে মেয়েটি।


আবার একদিন কোলের উপর শরৎচন্দ্র পড়তে পড়তে সহকর্মীকে বাতের কষ্টের কথা বলে গৃহিনী। আর বলে বক-বকমের কথা। বক্-বকম করার জন্য একটা মেয়ে চাই তার। কাজের মেয়ে। নাদুস-নুদুস। অষ্টাদশী হলেই ভাল হয়।


চতুর্থ দুনিয়া, '৯৬


2021-9-21 14:13

জীবন যুদ্ধ । The Battle of Life

জীবন যুদ্ধ(short story)
The Battle of Life.

বাগদার চারা পোনা ধরছিল মেয়েটা। বছর তেইশ বয়স, পিঠে-বুকে আড়াআড়ি কাপড় কোমরে প্যাচ খেয়ে নেমে এসেছে হাঁটু অবধি। শক্ত-পোক্ত করে পরা যাতে জলের মধ্যে চলাফেরা করতে অসুবিধা না হয়। জট পাকানো চুলে শক্ত খোঁপা বাঁধা। মশারির মত নাইলনের তিনকোনা জাল দিয়ে নোনা নদীর কিনার ধরে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরছিল। সরু সূতোর মত পোনা, স্বচ্ছ, প্রায় চোখে দেখা যায় না। এই প্রায় অদৃশ্য প্রাণীটাই তাদের প্রাণের উৎস এখন। জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ—এ প্রবাদটা যথার্থই এ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ডাঙ্গা হলেই বাঘ থাকে না, কিন্তু বাঘের মত মানুষের অভাব হয় না, সাপের মত ছোবলের অভাব হয় না। তেমনি আক্ষরিক অর্থেই কুমীর কামটের অভাব হয় না জলে। তবু তাদের জলে নামতে হয়। আবার ডাঙ্গায় উঠতে হয়।

সেই সাত সকালে দুটো পান্তা খেয়ে জলে নেমেছে মেয়েটা। জলের এধার ওধার দু’চার পাক দিয়ে মাঝে মধ্যেই বাঁধের উপরে উঠছে। মাটির উপরে ছোট কূয়ার মত করে তার মধ্যে পোনা মিশানো জল ঢালছে। সেখানে বসে নয় বছরের ছেলেটা ঝিনুকের খোলা দিয়ে একটা একটা করে পোনা তুলে হাড়িতে রাখছে। হাড়ির মুখ ভিজা গামছায় ঢাকা।

ছেলে-নদী-বাগদার পোনা, বৃত্তের মধ্যে চলতে থাকে মেয়েটার জীবন। সকাল সন্ধ্যে এর বাইরে আর কোন ভাবনা কাজ করে না। স্বপ্ন তো দেখেই। কিন্তু কঠিন বাস্তবে সে স্বপ্ন উড়তে পারে না। ছেলে একদিন বড় হবে, নাতি-পুতি আসবে ঘরে। সে তো অনেক দূরে। আপাতত বেঁচে থাকাটাই তার একমাত্র কাজ । নদীতে কুমির আছে, কামট আছে। যে নদী তাক প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে—সেই নদী যে কোন দিন তার প্রাণটা নিয়ে নিতে পারে। অথবা অঙ্গহানি হতে পারে। তবু তাকে নদীতে নামতে হয় আরও অনেকের মত। জীবনের হাতছানি সবার আগে।

নরম কাদা-মাটিতে পা ফেলে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে মনের অলিতে গলিতে চলে যায় মাঝে মধ্যে। পাশের বাড়ির ঠাকুমা তাকে বলে পাষাণি। অথচ সে তো পাষাণি হতে চায়নি। কিছু না চাইতেই এগারো বছর বয়সে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। আইবুড়ো মেয়েটার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল সে ছিল বছর দশেকের বড়। শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর ঘর একদিন করেই সে পালিয়েছিল
বাপের বাড়ি। বছর দুয়েকের মধ্যে যম সদৃশ্য স্বামীর বাড়ি সে যায়নি। তারপরে তাকে যেতেই হয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ীর ভালবাসা, অনুশাসন; উঠোনের ধান, গোয়ালের গরু, উনুনের আঁচ আর স্বামীর সোহাগের মাঝেই – ছেলেটা এসেছে তার  কোলে।

আর পাঁচটা বউয়ের মত বুকের দুধ ফুরোবার আগেই আরেকটা বাচ্চা এসে কোল ভরেনি তার। বাঁজা না বললেও পাড়ায় মাসিমা-খুড়িমা-ঠাকুমাদের কাছে কথা শুনতে হয়েছে। নিরক্ষর মায়ের ছেলে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখনও কোল তার শূন্য থাকে। শূন্য থাকে মেয়েটার জন্যেই। এর জন্যে স্বামীর সোহাগে বৃত্ত রেখা টানতে হয় তাকে। কাজটা সহজ হয় না একটা লেখাপড়া না জানা মেয়ের পক্ষে। হাসপাতাল থেকে যে সব দিদিরা আসে তাদের গ্রামে—তাদের সাথে গল্প করে সে।
--ভগমান যদি দেয় আমরা কি কত্তি পারি বাপু। দেবেন যিনি, বাঁচাবেন তিনি।
-শোন, একটু ভাব। আমরা, মেয়েরা না চাইলে ভগবান কখনো দিতে পারে না। ছেলে মেয়ে দুজনের মিলনেই সন্তান হয়। একা একা কেউ সন্তানের জন্ম দিতে পারে না।ভগবানও পারে না।
ভগবান যেমন সন্তান দেন না—ভগবান বাঁচানও না। মা-বাবাকেই বাঁচাতে হয়। খাওয়াতে হয়, বড় করতে হয়, লেখা পড়া শেখাতে হয়। তোমার ছেলের খাবার কি অন্য কেউ জোগাড় করে দেয়? – তা তো বোঝলাম। কিন্তুক বেটারা যদি চায় আমরা কি কত্তি পারি? আমরা তো তাগে আটকাতে পারি না।
—আটকাতে পারি, সত্যি সত্যিই পারি। আমরা না চাহলে সন্তান হবে না। শুধু একপাল জন্ম দিলেই তো হবে না—তাদের ভাল-মন্দর কথা ভাবতে হবে, তাদের লেখা-পড়া শেখাতে হবে, তাদের মানুষ করতে হবে।

পরামর্শ নেয় দিদিদের কাছে। স্বামীর সাথে আলোচনা করে। দিদিদের কথা বলে। ছেলের প্রসঙ্গে বলে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা বলে। সম্ভবের কথা বলে, অসম্ভবের কথা বলে। জীবনটা নিয়ে একটা পরিকাঠামো তৈরি করে।

নদীর পাড় থেকে বিকট গলার আওয়াজ আসে তার কানে। সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে। হাতের জাল ছুঁড়ে অতি দ্রুত চলে আসে উপরে। হাড়িটা উল্টে আছে, ছেলেটা পড়ে আছে মাটিতে। ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে তার দেহ। দাঁতে দাঁত লেগে আছে। খিঁচুনী সারা দেহে। হতভম্ব ভাবটা কেটে যায় মুহূর্তেই।

নিজের হাত-পা-মাথা দিয়ে মাটির সঙ্গে সজোরে চেপে ধরে ছেলেকে। ওইটুকু ছেলের গায়ে অসুরের মত অত শক্তি কোথা থেকে আসে সে বুঝতে পারে না। হার মানতে মানতে সব শক্তি উজাড় করে চেপে রাখে। চোখ উল্টায়, ভয় পায় মেয়েটা। মুখে গাজলা বেরিয়ে আসে, আরো অস্থির হয়ে ওঠে মা।–ও বাবাগো.……... কে কোথায় আছগো....আমি এখন কি করি....আমার বাবার কি হল গো।.. বুঝে উঠতে পারে না কি করবে এখন। ধারে কাছে কেউ নেই। ফাঁকা নদীর পাড়ে দিন-দুপুরে ভয় তাকে নিশ্চল করে দিতে চায়। বেশ কিছু সময় ধস্তাধস্তির পর নিস্তেজ হয়ে আসে ছেলেটি। হাঁপাতে থাকে, জড়িয়ে ধরে মাকে।

তারপর বেশ কয়েকদিন আর নদীতে যাওয়া হয় না। ছেলের এ অবস্থা চলতে থাকে মাঝে মধ্যে। গাঁয়ের সবাই বলে ভূতে ধরেছে। ছোটরা বলে, বুড়োরা বলে। গুণিনের খোঁজ দেয় অনেকে। কেউ কাছের গুণিন, কেউ দূরের। সঙ্গে সত্যি থেকে সত্যিতর গল্প চলতে থাকে। শক্তিশালী থেকে মহাশক্তিশালী গুণিনের সন্ধান মিলতে থাকে। মেয়েটা সবাইকে নিরাশ করে হাসপাতালের দিদিদের সাথে কথা বলে। দিদিদের কথায় ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ওষুধ লিখে দেন। কিছু ভিটামিনের বড়ি ছাড়া কিছুই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। ‘নেই’—তাই বাইরে থেকে কিনতে বলেন। দায়মুক্ত হয়ে যান ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্মীরা। মেয়েটা দায়মুক্ত হতে পারে না। এর-ওর কাছে যায়। দু’চারজনের কাছে কিছু ধার পায়। কিন্তু যাদের দেবার সামর্থ বেশি তাদের গরীব মানুষকে ধার দেবার অক্ষমতা আরো বেশি। তাই মেয়েটার দৌড়-ঝাপ দু’চারদিনের বেশি ওষুধ দিতে পারে না। ঘরের চাল ফুরিয়ে যায়। বেঁচে থাকার দায় অনেক বেশি বলেই জাল নিয়ে আবার নদীর পাড়ে যেতে হয়। ডাক্তারি চিকিৎসা সামর্থের বেড়া টপকাতে পারে না। অগত্যা গুণিন আসে। মন্ত্র-টন্ত্র। হাতে তাবিজ ওঠে, কোমরে তাবিজ ওঠে, গলায় তাবিজ ওঠে। ছোট গুণিন থেকে বড় গুণিন। কাছের গুণিন থেকে দূরের গুণিন। সবার শ্রেষ্ঠত্বকে অসার করে ছেলেটা হেসে-খেলে, অজ্ঞান হওয়া ভূতের রোগটাকে অভ্যাসের দাস-এর মত বয়ে বেড়ায়। মায়ের মন তো মানে না। তার সামর্থের সবটুকু সে করে। ছেলেকে একদম চোখের আড়াল করে না। ছেলেকে নদীর পাড়ে বসায়। সে চিংড়ির পোনা ধরে। আর চোখে চোখে রাখে। জীবন নিয়ে একটা পরিকাঠামো সে তৈরি করেছিল। সে ভেবেছিল একগাদা সন্তানের মা যেমন সে হবে না, তেমনি তার সন্তান একটু আলাদা হবে। জমির ধান, ঘরের ভাত আর জন্ম দেবার বাইরের পৃথিবী তাকে হাতছানি দেয়। কিন্তু নোনা ঝড় সব পরিকল্পনা তছনছ করে দেয়।

চৈত্রের মেলায় যাত্রার আসর বসে দুটো নদী পার হয়ে। দল বেঁধে সব যায় যাত্রা শুনতে। ফিরেও আসে আবার। তার স্বামীও যায়। কিন্তু ফেরে না। পাঁচদিনের যাত্রার আসর ভেঙ্গে গেলেও ফেরে না। পাড়া-প্রতিবেশীদের দু’একটা কথা কানে আসে। সে বিশ্বাস করে না সে সব। কিন্তু সব জল্পনা শেষ করে আরো দু’দিন পরে বাড়িতে ঢোকে তার স্বামী। রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পাষাণ হয়ে যায় মেয়েটা। সে দেখে সোহাগের স্বামী ঘোমটা পরা এক সোহাগিনীকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। কোমরে আঁচল জড়ায় মেয়েটি। ছেলে এসে পাশে দাঁড়ায়। উনুনের উপরের টগবগ  ভাতের হাড়ির আগুনটা নিভিয়ে দেয় সে। ছেলের হাত ধরে। উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে আসে। পিছন ফিরে তাকাতে ঘেন্না হয় তার।

গ্রামের বিচার ব্যবস্থা সজাগ হয়। সভার মাঝে বিনীত হয় তার স্বামী। বিনয়ের অবতার হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে। করজোড়ে গ্রামের বিচার মাথা পেতে নেবার অঙ্গীকার করে। বলে, ভুল হয়ে গেছে। বলে—আপনারা দশজনে আছেন, যা বলবেন তাই হবে। একটা ঘোরের মধ্যে ভুল করে ফেলেছি, বনবিবিকে স্বাক্ষী রেখে সিঁদুর দিয়েছি এক জনের সিঁথিতে: স্ত্রী বলে স্বীকার করেছি। এখন আপনারা যে শাস্তি দেন, মাথা পেতে নেব।

তার স্বামীর এই আত্মসমর্পণ মোড়লদের খুশী করে। সেই খুশীতে বনবিবিকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না। বিধির বিধান মেনে নেবার রায় দেয়। মেয়েটার কাছে মাথা নত করে বাড়ি ফিরে যেতে বলে তার স্বামী। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তেইশ বছরের মেয়ে।

পরের দিন বাপের বাড়ি থেকে পা বাড়ায়। স্বামীর ঘরে যায় না। হাসপাতালে দিদিদের কাছে যায়। দিদিরা নিজেরা আলোচনা করে। অবশেষে আরো এক দিদির ঠিকানা দেয়। গাঁয়ের মেয়েটা জল-কাদা পথ ভাঙ্গে। মেঠোপথ থেকে মোরাম দেওয়া রাস্তায় আসে, সেখান থেকে রাজপথে। হিতৈষী দিদির সহাযোগিতায় জেলা সদরের আদালতে সোজা পায়ে দাঁড়ায় সে। নালিশ জানায় মহামান্য বিচারকের কাছে।

বর্ষা আসে বর্ষা যায়। স্বামী মিটমাট করতে চায়। কিন্তু স্বামীর আবেদনে মন ভেজে না মেয়েটার। চার বছর পর অইনি নির্দেশে জমি লিখে দেয় তার স্বামী। ভুল করে ফেলা স্বামীর ঘরে আর কোনদিন ফেরে না।

ইতিমধ্যে জীবনের ধারাও পাল্টে যায় একটু একটু করে। বিশ্বাসী স্বামীর হঠাৎ ঘাতক হয়ে ওঠা মেনে নিতে পারে না। এত কিছুর পরও সে আর গ্রামে ফিরতে পারে না। সে ভুলতে পারেনা—ওই গ্রামেই থাকে তার সন্তানের বাপ। এই কঠিন বাস্তবকে সে এড়াতে চায়। এড়াতে চায় বলেই কাজ খোঁজে শহরে। নিরক্ষর মহিলা। শহুরে চাহিদায় কাজ সে পেয়ে যায়। বাড়ির কাজ। বিচিত্র মানুষের মুখোমুখি হয় সে। মানুষ যে এত রকম হয়, মানুষের ভাষা এত রকম হয়— সে জানতে পারে ধীরে ধীরে। কখনো নিজের প্রয়োজনে বাড়ি পাল্টায়, কখনো অন্যের কারণে বাড়ি পাল্টাতে বাধ্য হয়।

দুর্বল মনের সাথে শরীরও দুর্বল হয়। প্রায়ই অসুস্থ হতে থাকে। গৃহকর্তা সজাগ হয়। অতি সচেতনভাবে সযতনে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। অর্ধেক বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ওঠে মেয়েটি। আবার ফিরে আসে শহরে।

পুরনো বাড়িতে জায়গা না পেয়ে আবার নতুন বাড়ি। নতুন গৃহকর্তা, নতুন গৃহকর্ত্রী। অশক্ত দেহ ধীরে ধীরে পোক্ত হয়ে ওঠে। ভাল মানুষের সংসারে সেও ভাল হয়ে ওঠে। স্নেহময়ী গৃহকর্ত্রী। সুখ দুখের খোঁজ নেয়। সুখ দুখে অংশ নেয়। সেই সাহসেই মেয়েটি তাদের গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। চৈত্রের মেলা দেখার অমন্ত্রণ। স্নেহময়ী গ্রহণ করে সে অমন্ত্রণ। চৈত্রের মেলায় হাজির হয় নোনা জলের গাঁয়ে।

মাকে কাছে পেয়ে আঁচল ছাড়তে চায় না ছেলেটি। মায়েদের সাথে মেলায় যায়৷ বাঁশি কেনে। গ্যাস বেলুন কেনে। মেলা থেকে ফিরে আসতে আসতে গ্যাস বেলুনটি হঠাৎ আলগা হাত থেকে বেরিয়ে যায়। কুঁকড়ে মাটিতে পড়ে। বেঁকে যায় শরীর, দাঁতে কপাটি লাগে। খিঁচুনী ওঠে সারা দেহে। গ্যাঁজলা বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। অভ্যস্ত হাতে মা সামলায়। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে স্নেহময়ী। করুণার ধারা নেমে আসে। সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

ছেলের জামা-প্যান্ট গোছাতে গোছাতে আশায় বুক বাঁধে মা। আর তুক-তাক্ নয়। এবার বড় শহরের বড় ডাক্তারের চিকিৎসা পাবে ছেলে। তার একমাত্র সন্তান আবার ভাল হয়ে যাবে। সে আবার স্কুলে যাবে। মানুষ হবে। স্বামীর অমানবিক ব্যবহারের জবাব দেবে ছেলেকে দিয়ে। ভাবে সে। এবং শহরে আসে ছেলেকে নিয়ে।

আন্তরিকতার অভাব থাকে না স্নেহময়ীর। পরিবারের একজনের মতই ছেলেটাকে রাখেন। ডাক্তার দেখান। ওষুধ কেনেন। ভাল ডাক্তারের জন্যে ভাল ফি দিতে হয়। ভাল ওষুধের জন্যে ভাল পয়সা ব্যয় হয়। কঠিন একটা রোগকে ভাল করতে ভাল সময় লাগার কথা বলেন ডাক্তার। ভাল ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনের কথা জেনে যান স্নেহময়ী। স্নেহের রসদের কথা ভাবেন।

দু’চারদিনের মধ্যেই আগ্রহে টান ধরে গৃহকর্ত্রীর। অন্যকাজে বড় বেশি জড়িয়ে পড়েন তারা। ডাক্তার দেখাবার সময় পান না। ছেলের খবর নেবার সময় পান না। মেয়েটি বুঝতে পারে তাদের মানসিকতা। ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় সময়ের লেখা পড়তে পারে। জোড়া লাগা আশায় ফাটল ধরে আবার। পাশের বাড়ির কাজের বুড়িটা এক সাধুর খোঁজ দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের অবসরে ছেলেকে নিয়ে সাধুর কাছে যায়। গ্রাম থেকে আসবার সময় ছেলের হাত থেকে, কোমর থেকে, গলা থেকে সমস্ত তাবিজ সে খুলে ফেলে দিয়েছিল নদীর জলে। সেই হাতে আবার তাবিজ ওঠে। কোমরে তাবিজ ওঠে। গলায় তাবিজ ওঠে। তার ছেলে হাসতে থাকে ; খেলতে থাকে। তারই মাঝে কখনো ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, মাটিতে পড়ে ধনুকের মত বেঁকে যায়। সর্বাঙ্গে খিঁচুনী আরম্ভ হয়, মুখে গ্যাঁজলা আসে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটির দিকে চোখ যায়। পরিত্রাতা দেবতার ছবি। হাসি মুখে তাকিয়ে। তার একমাত্র সন্তান, আশা-ভরসা এখন মৃত্যুর মুখে মাটিতে। দেবতা হাসছে দেওয়ালে। চোখে জল আসে না মেয়েটির। হাসি মুখের দেবতার ক্যালেন্ডারটা মুহূর্তে এক টানে ছিঁড়ে ফেলে, টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়। কোমরে আঁচল জড়ায় শক্ত করে। চোয়াল শক্ত করে ঝুঁকে পড়ে ছেলের দিকে। বিড় বিড় করে সে—
—ঘাবড়াস্ না বাপ। মুখের ফেনা মোছে আঁচল দিয়ে। 
—তোকে আমি ভাল করবোই। দাঁতের ফাকে ভিজে ন্যাকড়া গুঁজে দেয় যাতে দাঁতের চাপে জিভ না কেটে যায়।
—তোর বাপ যদি যাত্রার মাগীর জন্যে সব খোয়াতে পারে, তোর জন্যে আমি কেন পারব না? পারব-পারব—কি হবে ছাই যক্ষের ধন রেখে?......... তোর জন্যে আমি সব দেব...... যত কষ্টই হোক...... ভাল ডাক্তার দেখাব...... ভাল তোকে করবই।.....

 ঝাপসা চোখ কচলিয়ে পরিষ্কার করে। আরেকটা যুদ্ধ জয়ের জন্যে প্রস্তুতি নেয় ছেলের মা।


মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধা ধিন ধিন ধা (Short Story)



শ্যামলা রঙের অষ্টাদশী মেয়েটি যখন পাশ ফিরে বিছানা ছাড়বার কথা ভাবে তখন ভোর হয় হয়। এই সময়ে তাকে উঠতেই হয়। পাখি ডাকা ভোর তার নিত্য সঙ্গী। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে এক চিলতে ছাদে দাঁড়ায় সে। শান্ত সকালের পূব আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হ’তে থাকে। দু'চারটে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ, দু’চার জন মানুষের আনাগোনা, কাকের কা-কা, চড়ুইয়ের কিচির মিচির, দূর রেল লাইনে গাড়ি চলার শব্দ, ব্যস্ত দিনের সূচনা করতে থাকে। আলো বাড়ে, মানুষ বাড়ে। তারই মধ্যে আপনাকে গুছিয়ে নেয় সে। শুদ্ধ মনে ধূপ কাঠি জ্বালে। এক পায়ে ঘুঙুর বাঁধে। ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে গিঁট দেয়। মেঝেতে পা ঠুকে ঘুঙুরের তালে তালে নিজেকে দোলাতে থাকে। পায়ের শব্দের সাথে মুখের শব্দ একাকার হ’তে থাকে। ধা-ধিন-ধিন-ধা——

সেই তালে তালে সময়ের কাটা এগিয়ে চলে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে কপালে, গলায়। সাড়ে ছ'টার মধ্যেই তাকে থামতে হয়। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্টোভ জ্বালে। চায়ের জল চাপিয়ে পাশের ছোট্ট ঘরটায় ঢোকে। অসুস্থ না থাকলে তার বাবা এর মধ্যেই প্রাত্যহিকী সেরে নেয়। তার প্রিয় বহু পুরানো বেহালাখানা হাতে নিয়ে বসে। ছড়ের পরশ লাগায় বেহালার তারে। জীবনের সব ছন্দ হারিয়ে বেহালার ছন্দ খোঁজে তার বাবা।

বাবার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে ভাইয়ের কাছে যায়। গায়ে হাত বোলায়, আলতো করে ডাকে। তাকে তোলে। বোনদের নামে হাঁক-ডাক পাড়ে। তারা উঠতে থাকে, সেও ব্যস্ত হ’তে থাকে। ভাইয়ের টিফিন, বোনদের টিফিন, ভাইয়ের স্কুল, বোনদের স্কুল। ভাইয়ের আব্দার, বোনদের আব্দার। সব তাকে সামলাতে হয়। মা থাকলে করতে হ’ত না। মায়ের অভাবটা তাকেই মেটাতে হয়। মা-বাবার প্রথম সন্তান সে। তার জন্যে কতটা কামনা ছিল সে জানে না। কিন্তু ভাইয়ের জন্যে বাবার কামনা ছিল বড় তীব্র। ভাই না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি তার মা। ভাই এল। বাবা স্বস্তি পেল। মাও স্বস্তি পেল, চিরতরে। ভাই ঘরে ফিরে এল, মা আর এল না। সারির প্রথমে সে, সব শেষে ভাই।

ভাই-বোনদের প্রাথমিক পাঠ চুকতে চুকতে তার খুদে শিক্ষার্থীরা হাজির হ’তে থাকে। তাদের ঘুঙুর বাঁধা পায়ের তাল তুলতে তুলতে তাকে বলতে হয়,
তবলার তালে নাচতে হয়—-ধা-ধিন-ধিন-ধা....।এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রায় ঘন্টা দুয়েক। জীবিকার প্রয়োজনটাই এখানে প্রধান। জীবিকার প্রয়োজনে এদের বিদায় দিতে দিতে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই সময়ে রান্না ঘরের দায়িত্ব থাকে বোনদের উপর। স্নান সেরে নাকে মুখে দুটো গুঁজে ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রেন ধরতে ছোটে।

একটি বেসরকারি সংস্থার বিপণন বিভাগের কর্মী সে। নির্দিষ্ট অফিসে বসে কাজ করার সুযোগ তার কম। বাইরেই কাটাতে হয় বেশির ভাগ সময়। এলাকা ভিত্তিক লোকের দোরে দোরে হাজির হতে হয়। দোকানে দোকানে হাজির হ’তে হয়। তার সংস্থার তৈরি পণ্য বিক্রির জন্যে, জনপ্রিয় করার জন্যেই সময় কাটে। তার সুঠাম শরীর দোরে দোরে ঘোরার কষ্ট সইতে সাহায্য করে। তার শ্যামলা গায়ের রঙ রোদে পুড়ে কালো হওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। তার দীঘল কালো চোখ, তার মিষ্টি হাসি, তার কথার ছন্দ তাকে বিপণনে সাহায্য করে, তার প্রতিষ্ঠানের কাছে অপরিহার্য করে তোলে।

অফিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে আসে না সে। সান্ধ্য কলেজের ক্লাসে থাকতে হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। সময় পেলে লাইব্রেরীতে ঢোকে। পড়ে। বই নেয়। বাড়ি আসে। রান্নাঘরে ঢোকে। ভাই-বোন-বাবাকে খেতে দেয়। নিজে খায়। থালা-বাসন ধোয়। সবার বিছানা করে, মশারি টাঙায়। ঘরের আলো নিভিয়ে মশারির মধ্যে ঢোকে।

অষ্টাদশী মেয়েটার সকাল-সন্ধ্যের জীবনচক্রটা এ রকমই। ব্যতিক্রম তো হয়ই। একটার প্রয়োজনে অন্যটা বাদ যায়। তবু সময়ের বেড়াজালে ধরা পড়েও সময়কে হার মানাতে চেষ্টা করে সে। তার দায় তাকে বাধ্য করে, তার আশা তাকে উজ্জীবিত করে।

কারো জীবনে লক্ষ্য থাকে, কারো থাকে না। অষ্টাদশী মেয়েটার লক্ষ্য আছে। ঘুঙুর পায়ে অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখে সে। তার আদর্শ ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি পৌঁছাতে চায় সে। কিন্তু সে লক্ষ্যের পথ বড় অমসৃন। সংসারের দায় তার কাঁধে। ভাই-বোনের সংসারের সব বোঝা নিয়ে তাকে লক্ষ্যের দিকে এগোতে হয়। বাবা কাজ করত একটা কারখানায়। অনেক দিন ধরেই ধুঁকছিল। কারখানার সাথে পাল্লা দিয়ে বাবাও ধুঁকতে শুরু করে। ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন অচল হয়ে যায় কারখানা। বাবার সাথে সংসারটাও ধুঁকতে থাকে কিন্তু একদম অচল হয়ে যায় না। প্রথম সন্তান হিসাবে একটু একটু করে কবে যে সংসারের পুরো দায় তার উপর চেপেছে, সেটা হিসাবে মেলাতে পারে না। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা বাবার কর্মক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। একমাত্র বেহালার ছড় ছাড়া সবই তাকে ছেড়ে গেছে। সংসারের দায়, নিজের নাচের চর্চা—সবই তার ধরা-বাঁধা কাজ। যন্ত্রের মত একটার পর একটা তাকে করতে হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল সব। মাঝে মধ্যে নিজের পাড়ায়, অন্য পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। কখনো নিজের নাচের অনুষ্ঠান থাকে, কখনো অন্যদের নাচ পরিচালনা করতে হয়। এমনি এক অনুষ্ঠানের দিন কয়েক পরে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা স্কুটারের শব্দ যেতে আসতে থাকে। প্রথম দিকে ব্যাপারটায় আমল দেয় না সে। কিন্তু দু’চারদিন জানালা দিয়ে বাইরে দেখার পর সন্দেহ হয় তার। বিশেষ একটা স্কুটার, আরোহীও নির্দিষ্ট একজন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসে, চলে যায়। সুঠাম, সুপুরুষ, রোদ চশমার ছেলেটা একবার করে বাড়ির দিকে তাকায়। যেতে এবং আসতে। এমনি কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয় স্কুটারের শব্দ। কিন্তু আবার দেখা যায় ছেলেটিকে। হঠাৎ একদিন অফিসে যাওয়ার পথেই রেল ষ্টেশনে তাকে দেখে। আবার একদিন। আবার। দেখাটা যখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, সহাস্যে ছেলেটি বলে—

–কেমন আছ?

--ভাল। আপনি?

কথা হয় তাদের। মাঝে মাঝেই হয়। অতঃপর প্রায়ই। প্রাসঙ্গিক কথা। ট্রেনের কথা। সময়ে আসবার কথা, অসময়ে আসবার কথা। ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। ওরা যায়। যার যার গন্তব্যে।

একদিন ছাই রঙের শাড়ী পরে সে। তার চাপা রঙের সাথে সুন্দর মানিয়ে যায়। লম্বা বেণী। অলঙ্কারের বালাই নেই। শাড়ীতে আরো তন্বী মনে হয়। ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়। ভাল লাগা মন নিয়ে ছেলেটি বলে

-বাঃ! দারুণ!

হাসিমুখে তাকায় মেয়েটি। তৃপ্তির হাসি। সে হাসিতে ধন্যবাদ প্রকাশ পায়। আবার একদিন হালকা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। দূর থেকে আসতে দেখে ছেলেটি। শান্ত পুকুরে ঢিল ফেলা ঢেউ তীরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, ছেলেটা প্রশংসা করে তার রুচির, সে আপ্লুত হয়।

দিন এগোয়। ছেলেটি এগোয়। অতি সতর্কতার সাথে এগোয়, কথা বলে মেপে। প্রয়োজনীয় কথাটুকু প্রয়োজনের সময় বলে সে।


অচেনা অষ্টাদশী মেয়েটি অচেনাই থাকত ছেলেটির কাছে। পাশের পাড়ার ছেলে সে, তবু সাধারণ মেয়েটা সাধারণের মধ্যেই মিশে ছিল। ওদের পাড়ার অনুষ্ঠানে সেদিন যখন অষ্টাদশীর নামটা মাইকে ঘোষণা করে, সাধারণের মতই না শোনার মত শোনে তার নাম।

ধা-ধিন-ধিন-ধা -
নাচতে শুরু করে। বিড়ি-সিগারেট-খৈনী সহযোগে আগত মহিলাদের ভাবনায় যখন তার বন্ধুরা মগ্ন, সে মগ্নতায় হঠাৎ ভাগ বসায় ধা-ধিন-ধিন-ধা।

ধ্যানমগ্ন ঋষি। তার কঠোর তপস্যায় দেবতার মন টাল-মাটাল। কিন্তু ঋষির প্রার্থিত বর দেওয়া যাবে না। তাই বিপথগামী করা দরকার ঋষিকে। স্বর্গ থেকে নেমে আসে অপ্সরা। ঋষিকে ঘিরে নাচতে থাকে , ধা-ধিন-ধিন-ধা....। ঋষি অনড়। মগ্ন। নাচতে থাকে অপ্সরা। দ্রুত থেকে দ্রুত হতে থাকে লয়। শৃঙ্গাররসে পরিপূর্ণ মোহময় ছন্দে পরিব্যাপ্ত হতে থাকে চারিদিক। শরীরী উন্মাদনায় ষড়রিপু চেতন হতে থাকে। কেঁপে ওঠে ঋষি,  ধ্যান ভাঙতে থাকে। কামনার হাতছানি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সৃষ্টির অমোঘ আকাঙ্খা সজীব হতে থাকে।

কেঁপে ওঠে ছেলেটিও। ধ্যান ভাঙছিল তারও। নৃত্যের অপ্সরা তার দীঘল কালো চোখ, ছন্দের শরীরী ভঙ্গিমায় সমস্ত দর্শককে এককেন্দ্রিক করে তোলে। সেই থেকে ছেলেটির অন্তরে নাচতে থাকে অপ্সরা। নিজের আকুতিতে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ধ্যানভঙ্গ ঋষির উদ্ভ্রান্ত ভাব নিয়ে অষ্টাদশীর পাড়া দিয়ে, বাড়ির সামনে দিয়ে চক্কর দিয়েছে কয়েকদিন। অবশেষে লক্ষ্য পুরণের আশায় নিজেকে সংযত করেছে। সতর্ক হয়েছে ছেলেটি। আস্তে আস্তে নিজের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মেয়েটি। ছেলেটার অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছা করে, জানাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মনের দরজাটা হুট্ করে খোলে না। নিজের ইচ্ছেটাকে একদম প্রকাশ পেতে দেয় না। যেটুকু সময় ছেলেটি পায়, মনোযোগী শ্রোতা হতে চায়। অতি ব্যস্ততার সময়ও শান্ত শ্রোতা। অপ্রাসঙ্গিক হলেও মেয়েটাকে প্রাধান্য দিতে কার্পণ্য করে না। সময়ের অপক্ষা করে।

প্রাধান্য পায় মেয়েটি। মেয়েটির ভাব ভাবনার অংশীদার হয় ছেলেটি, সব ভাবনার অংশীদার হতে স্বতঃস্ফূর্ত হয়। তার কষ্টটাকে, বাড়ির প্রতি দায়বদ্ধতাকে বড় করে দেখে, তার দায়িত্বশীলতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। তার শিল্প সাধনায় উৎসাহী হয়ে ওঠে। মেয়েটির আগ্রহের বিষয়গুলি একান্তে রপ্ত করতে সচেষ্ট হয়।
তার ভাল লাগা রঙে চমৎকারিত্ব প্রকাশ করে। মেয়েটি উৎফুল্ল হয়, তার মনকে অবারিত করার সুযোগ পায়।

ভাল লাগার রেশ একদিন ছেলেটাকে মেয়েটার কলেজের সামনে দাঁড় করায়। কলেজ থেকে কলেজ স্ট্রীট। বই কেনে, গল্প করে, ফিরে আসে। আবার একদিন কলেজ থেকে কলেজ স্ট্রীট। বইয়ের দোকান। কফি হাউজ। পার্কের বেঞ্চ। দু’জন দু’জনের কাছে প্রকাশ হয়। সময় দৌড়ে পালাতে থাকে। বিনা নোটিসে ছেলেটার হাজিরা খাতায় লাল দাগ পড়ে মাঝে মধ্যে। কলেজের হাজিরা খাতায় দাগ পড়ে মেয়েটির। বিনা নোটিসে নাচের ক্লাস নেওয়া হয় না। বাবার চায়ের জল ঠিক সময়ে চাপান হয় না কোন কোন দিন। ভাই-বোনদের প্রতি দায়টা যেন আলগা হ’তে থাকে। সময়ে টান ধরে তার। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় কখনো। বাবার বেহালার সুর করুণ হয়ে ওঠে আরো। অপরাধ বোধে ভোগে সে। ছাত্রীদের দিকে অমনোযোগিতা পীড়া দেয়। নিজের নাচের .প্রতি অবহেলায় রুষ্ট হয় নিজেই। ছক করে নিজে। আবার আগের মত তৈরি হবে সে। এক সকালে ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে কোমরে ওড়না জড়ায়। আড়ষ্ট মনটাকে প্রসারিত করতে সশব্দে হাত-পা ক্রিয়াশীল করে সে—

ধা/ ধিন/ ধিন/ধা—

ছেলেটার মিষ্টি হাসি হাতছানি দেয়।
 ধা/ ধিন/ ধিন/-ধা/ধা/ ধিন/ ধিন/-ধা—

গঙ্গার পাড়, দোয়েলের স্বর, হাতে হাত–
ধা/-ধিন/-ধিন/-ধা/ধা/-ধিন/-ধিন/-ধা--

পার্কের বেঞ্চ, আবছা-আঁধার, স্বর-হীন মুখ, দ্রুত-হৃৎস্পন্দন

—ধা।

থেমে যায় সব। শাসন মানাতে পারে না মনকে। হতাশ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আত্মসমর্পিতের মত নিজেকে তৈরি করে সে। নির্ধারিত সময়কে অনুসরণ করে।

কিন্তু নিজের উপর গ্লানি বাড়তে থাকে তার। একদিন নিজের প্রতি রুখে দাঁড়াতে চায়। নির্ধারিত সময়ে নিজেকে ঘরে আটকায় সে। জানালা-দরজা আবার বন্ধ করে। পায়ে ঘুঙুর বাঁধে। বাজনার তালে তালে অভিমন্যু হয়ে ওঠে সে। ছোট্ট অভিমন্যু বিরাট দায়বদ্ধতার সামনে পড়ে। কুরু-পান্ডবের মহারণে জয়-পরাজয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। এ মহাযুদ্ধে পাণ্ডবের মর্যাদা রক্ষার দায় আসে তার উপর। সে দায় সে নিতে পারে, নাও নিতে পারে। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধার মত দায়িত্ব মাথা পেতে নেয়। চক্রব্যুহে ঢোকার কৌশল সে জানে। পিতার অনুপস্থিতিতে তাই অপরিণত বয়সেই মহারণে অংশ নিতে হয়।

-ধা-ধা৷ ধিন-তা।.....

দ্রুত থেকে দ্রুত হ’তে থাকে ঘুঙুরের শব্দ—

—ধা-ধা/ধিন-তা/কত— তাগে—

ঘামে ভিজে উঠতে থাকে সারা দেহ, 
ধিন-তা/তেটে কতা/গদি-ঘেনে——

অভিমন্যু একটার পর একটা ব্যুহ ভেঙ্গে এগোতে থাকে। মুখোমুখি হয় সপ্তরথীর। সপ্তরথীর সাথে অসম যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়তে থাকে সে। ষড়-রিপু সহস্র রিপু হয়ে আক্রমণ করতে থাকে। ভেঙ্গে পড়ে অষ্টাদশী ;
তেটে-কতা/গদি-ঘেনে/ধা।.... ;

নিজের মনের কাছে হেরে যায়। থেমে যায় সে।

ধরা দেয় ছেলেটির কাছে। নিজেকে সমর্পণ করে। সব বাধা ভুলে সে আশ্রয় নেয় ছেলেটির মাঝে।

রাখাল জানে খোঁয়াড়ে গরুর ক্ষমতা। পৌরুষ প্রকাশ পায় ছেলেটির। এক দিন প্রশ্ন তোলে,
—কাল এলে না কেন? 
-তোমায় তো বলেছিলাম, না-ও আসতে পরি।
—কিন্তু আমি যে আসতে বলেছিলাম। 
আদেশের সুর কঠিন হয়ে ওঠে।
-- আমার নাচের অনুশীলন ছিল। অপরাধ স্বীকার করে মেয়েটি। 
–তোমার নাচুনী হবার স্বপ্ন না দেখলেও চলবে। ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত দেয় সরাসরি।

আবার একদিন ছন্দ হারায় মেয়েটি। ছেলেটি ফরমান জারি করে,
—নাচের ছাত্রীদের বিদায় দাও। ও কটা টাকা আমি তোমায় দেব। 
–কিন্তু নাচের ক্লাশ তো শুধু টাকার জন্যে নয়, নিজের অভ্যাসের জন্যেও দরকার। 
নিজের অবস্থান বোঝাতে চেষ্টা করে সে।
 –কি হবে ও ছাই করে, ঠিকানা তো সেই রান্নাঘর আর নার্সিং হোম।

খোঁয়াড়ের গরু কি খাবে সেটা তো একমাত্র খোঁয়াড়ের মালিকই জানে। সতর্কতার আর প্রয়োজন নেই জেনে ভবিষ্যৎ বাতলে দেয় মেয়েটির। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে মেয়েটি। সব কিছু কেমন গোলমাল হয়ে যেতে থাকে তার। একটু একটু করে চেনা মানুষটি বদলে যেতে থাকে, অচেনা হয়ে যায়। সে বুঝে উঠতে পারে না কি বলা উচিত, কি করা উচিত। অসহায় মানুষের মত বাক্যহীন হয়ে যায় প্রথমে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হতে থাকে সে।

পরদিন পাখী ডাকা ভোরে বিছানা ছাড়ে সে। ঘুম জড়ানো চোখে ছাদে দাঁড়ায়। কতদিন পর সে আবার পাখী-ডাকা ভোরে ছাদে এল! মনে হয় এক যুগ। তৃপ্তির নিঃশ্বাস নেয় বুক ভরে। প্রাত্যহিকী সেরে ধূপকাঠি জ্বালে। ঘুঙুর বাঁধে ৷ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেয়। অভিমন্যু যা শেষ করতে পারেনি, সে কাজ শেষ করতে সচেষ্ট হয়। কুরুক্ষেত্র দাপিয়ে ফেরে ঘুঙুর। মনের জানালায় বিনয়ী ছেলেটা উঁকি দেয়, সুন্দর সুঠাম ছেলেটা উঁকি দেয়, উৎসাহী-উদ্যমী ছেলেটা উঁকি দেয়। যুদ্ধের দামামা বাজে ঘরময়। বাবার বেহালার সুর করুণ থেকে করুণতর হতে থাকে। মেয়েটার হৃৎপিন্ড রক্তাক্ত হতে থাকে। উদ্ধত রূঢ় ছেলেটি ভেসে ওঠে। চোখের জল বাষ্প হয়ে উবে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। তূণের তীর ধনুকে লাগায় মেয়েটি। 
ধিন-ধিন। ধাগে-তেরেকেটে। থুন-নানা। কৎ-তা।

ধাগে-তেরেকেটে। ধিন-ধাধা।....

সপ্তরথীর লোভের তীর, নিরাপত্তার তীর, কপট মুখোশের তীর প্রতিহত করতে করতে চক্রব্যুহের বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে অষ্টাদশী মেয়েটি।

নীড়, জানুয়ারী, ৯৮

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অনুপ্রেরণা : রবীন্দ্রনাথ

 দেখতে দেখতে ষাট বছর পেরিয়ে গেলো।পয়ত্রিশ বছরের অবিরাম যাওয়া আসা একদিন বন্ধ হয়ে গেল। এক সন্ধ্যায় এক তোড়া ফুল হাতে দিয়ে অফিসের বন্ধুরা বলল- বুড়ো হয়ে গেছ, এবার বিদায় হও।


পরের দিন থেকে আর অফিসে গেলাম না। পরের মাসে কোন মাইনে পেলাম না। বিরাট ধাক্কা। মানসিক ধাক্কা। আয় নেই। পেনশন নেই। একরাশ অনিশ্চয়তা আছে।


কিছু একটা করা দরকার। সময় কাটানোর জন্য। আয় করার জন্য। কিন্তু কি করবো ? ষাট বছরে কিছু শুরু করা দুষ্কর। চিন্তা বাড়ছে। ভাল ঘুমাতে পারছিনা। জীবনের তাল কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।


টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখলাম। চিনের সফল ব‍্যবসায়ী মা(Maa) জীবন নিয়ে আলোচনা করছেন। জীবনকে কয়েকটি ভাগ করেছেন। সর্বশেষ ধাপ ষাট বছর থেকে। বললেন, বয়স যখন ষাট , এবার বিশ্রাম নিন। মনকে, শরীরকে বিশ্রাম দিন। অনেক করেছেন, এবার জীবনকে উপভোগ করুন। হতাশা বাড়ল। তিনিও বললেন, ষাট মানেই বুড়ো !


কয়েকজন বন্ধু বিজনেস ম‍্যাগনেট মা-এর মত বললেন- অনেক করেছি, এবার বিশ্রাম নিতে হবে। কয়েকজন বন্ধু কাশী-বৃন্দাবন-মক্কায় গেল। পরকালের ভাবনায় জীবন কাটাতে লাগলো।


বাকি কিছু বন্ধু ভাবতে লাগলো নতুন কিছু করা যায় কিনা। ভাবতে ভাবতে একটা বছর কেটে গেল।


হঠাৎ মনে পড়ল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যাপকের কথা। তিনি বলেছিলেন, " রবীন্দ্রনাথ আমাদের সুখে আছেন, দুখে আছেন, কোলাহলে আছেন, নির্জনতায় আছেন। " ভাবলাম, তবে কি তিনি আমার নিস্তেজ জীবনেও আছেন ?


আমি রবীন্দ্র জীবনীতে ডুব দিলাম। কয়েকদিন সময় লাগলো পড়তে। পড়া শেষে এক অন‍্য অনুভূতি জন্ম নিল মনের মধ্যে। বিশ্বাস করুন, আমার সেই নিস্তেজ ভাবটা কেটে গেল।


যে বয়সে আমি এবং আমরা নিস্তেজ হয়ে পড়ছি, দিশাহীন হয়ে পড়ছি- সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথ কী করতেন ? এক উজ্জিবক রবীন্দ্রনাথ- তাঁর সৃজনশীলতা , উদ‍্যম, কঠোর পরিশ্রম, তাঁর একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করে এবং সতেজ করে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারেন কিন্তু আমরা পারিনা। কেন পারিনা ? একটা তথ্য মনে রাখা দরকার। সেই সময় অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে ভারতীয় মানুষের গড় বয়স ছিল ত্রিশ বছর। আর আজ মানুষের গড় বয়স আটষট্টি বছর। অর্থাৎ সময়ের তুলনায় আমরাতো তরুণ !


চলুন, আমাদের প্রাণের আরাম , মনের শান্তি রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যাই।


চল্লিশ বছর বয়সে মাত্র পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ  প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রম্মচর্য বিদ‍্যালয়। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে একটি স্বপ্নও প্রতিষ্ঠা করলেন। এই ছোট্ট বিদ‍্যালয় একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে, বিশ্বজ্ঞানের আকর হবে। সারা পৃথিবীর মানুষ আসবে জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে। 

রবীন্দ্রনাথের মনে জোর ছিল, বৈদিক যুগে যদি ' তপোবন ' হতে পারে, বৌদ্ধ যুগে যদি 'নালন্দা ' হতে পারে তবে শান্তিনিকেতনে বিশ্ববিদ্যালয় হবে না কেন ?


সতের বছর পর , রবীন্দ্রনাথ-এর বয়স যখন সাতান্ন বছর, তিনি ভিত গড়লেন তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের।


ইতিমধ্যে আঘাতে আঘাতে দীর্ণ হয়েছেন তিনি। বাবার মৃত্যু হয়েছে, স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে, দুই কন‍্যার মৃত্যু হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ছোট ছেলের। কয়েক বছরের মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। কিন্তু মৃত্যুর মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেনি।


নিজের মনের শক্তি নিজেই সঞ্চয় করেছেন, তারুণ্যের কাছে হাত পেতেছেন---


ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা

ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ

আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।।


বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু তারপর ?


হাতি পোষা ও তার যত্ন-আত্তি এবং খাবার জোগানোর দায় তো মালিকের। মালিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছেন, বইয়ের স্বত্ব, নোবেল পুরস্কারের সুদের টাকা, সবই দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। তারপর ভিক্ষার ঝুলি কাধে তুলে নিলেন। ষাট থেকে পচাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত অক্লান্ত ভাবে ঘুরেছেন দেশের এবং পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। গান গেয়ে, নাটক করে, বক্তৃতা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছেন, বই সংগ্রহ করেছেন, ছাত্রদল নিয়ে ঘুরেছেন।


আমি যদি রবীন্দ্রনাথের ষাট থেকে পচাত্তর অর্থাৎ এই পনের বছরের টাকা সংগ্রহের জন্য ভ্রমণের কথা বলতে থাকি, বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যাব, আপনারা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ, তিনি ক্লান্ত হননি। এত পরিশ্রম তাঁর শরীর নিতে চায়নি, তবুও জোর করে বেরিয়েছেন। অসুস্থ হয়েছেন, সুস্থ হয়ে আবার পথে নেমেছেন।


চলুন, একটু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখি :


১৯২০ :

আমেদাবাদ, বোম্বাই, বরোদা, সুরাট, বোম্বাই, কলকাতা।

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, প‍্যারিস, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, প‍্যারিস। আমেরিকা-১৫ দিন নানা শহরে। তারপর ইংল্যান্ড, প‍্যারিস, ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেকোভ্লাকিয়া, কলকাতা।


১৯২২ :

বোম্বাই, পুনা, মহিশুর, বাঙ্গালোর, মাদ্রাজ, সিংহল।


১৯২৩ :

লক্ষ্মৌ, বোম্বাই, আমেদাবাদ, করাচি, পোরবন্দর, কলকাতা। আবার পোরবন্দর।


১৯২৪ :

চিন যাত্রা। সাংহাই, নানকিং, পেকিং, জাপান।


দক্ষিণ আমেরিকা, অসুস্থতার কারণে পেরু যাওয়া হয়নি। আর্জেন্টিনা, ইতালি, ভেনিস, কলকাতা।


১৯২৫ :

ইতালি। রোম, ফ্লোরেন্স, ট‍্যুরিন, সুইডেন, জুরিখ, ভিয়েনা, হাঙ্গেরি ।

জীবনীকার লিখেছেন, ' ভিয়েনা হয়ে কবি যখন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে পৌঁছালেন তখন কবির শরীর সহ‍্যশক্তির শেষ সীমানায়। এই বয়সে এতো ঘোরাঘুরি সহ‍্য হবে কেন । তবু বক্তৃতা দিলেন। '


কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার চললেন --

যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, ইস্তাম্বুল, গ্রিস, মিশর, সুয়েজ হয়ে দেশে।


১৯২৬ :

লক্ষ্মৌ।

ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, আগরতলা, কলকাতা।


১৯২৭ :

ভরতপুর, জয়পুর, আমেদাবাদ, আগ্রা, শান্তিনিকেতন, ।

সিঙ্গাপুর, মালয়দ্বীপ, বালিদ্বীপ, জাকার্তা, ব‍্যাংকক, দেশ।


১৯২৮ :

মাদ্রাজ, কলম্ব, ব‍্যাঙ্গালোর, শান্তিনিকেতন।


১৯২৯ :

জাপান, কানাডা, জাপান, ইন্দোচীন।


১৯৩০ :

আমেদাবাদ, বরোদা, শান্তিনিকেতন।


১৯৩১ :

ভুপাল।


১৯৩২ :

পারস্য (এলাহাবাদ- যোধপুর- করাচি- বুশায়ার- তেহরান হয়ে ) ইরাক, বাগদাদ, কলকাতা।


১৯৩৩ :

শান্তিনিকেতনের ছাত্রদল নিয়ে কলকাতা, বোম্বাই, দক্ষিণ ভারত।


১৯৩৪ :

দল নিয়ে সিংহল।

দল নিয়ে মাদ্রাজ, ওয়াটারলু।

দল নিয়ে কাশি, এলাহাবাদ, লাহোর, লক্ষ্মৌ ।


১৯৩৬ :

নৃত্যনাট‍্য নিয়ে উত্তর ভারত। পাটনা, এলাহাবাদ, লাহোর, দিল্লী।




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য টাকা সংগ্রহের এই পথ পরিক্রমা থামে তাঁর পচাত্তর বছর বয়সে।  মহাত্মা গান্ধী অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন এত পরিশ্রম না করতে। এইসময় শিল্পপতি বিড়লা বিশ্বভারতীর উন্নয়নের জন্য ষাট হাজার টাকা অনুদান দেন।


এতো কিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথ লেখা থামাননি। বরং আরও বেশি সৃষ্টিশীল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-এর লেখাকে যদি তিন ভাগে ভাগ করে দেখা হয়, অপরিনত, পরিনত ও শেষ বয়সের লেখা, তবে সব চাইতে বেশি সৃজনশীল ছিলেন শেষ বয়সে।


আমরা ষাট বছর বয়স হতেই বুড়ো হয়ে যাই, যখন ভারতীয় গড় আয়ু ৬৮ বছর। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ভারতীয়দের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর। তিনি গড় আয়ুকে পিছনে ফেলে নিত্য নতুন উদ‍্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে শারীরিক অক্ষমতাকে পাত্তা না দিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। আর ঝর্নাধারার মত  সৃষ্টি করে চলেছেন।


কী শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের ?

১) বয়স কোন বাধা নয়।

            মূল বিষয় "লক্ষ্য স্থির করা।" রবীন্দ্রনাথ পাখির চোখে দেখেছিলেন বিশ্বভারতী। আমাদেরও তেমনি লক্ষ্য স্থির করতে হবে।


২) লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

             বাধা আসবেই। বাসনা যদি তীব্র হয়, সমাধানের রাস্তা মিলবেই।


৩) ধৈর্য বা সহনশীলতা।

              সফল না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে।


শেষ কথা।

বয়স হয়েছে ? তাতে কী ? আসুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিই। তাঁর উদ্দিপনা, উদ‍্যম, কঠোর অনুশীলন, সহনশীলতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। যতক্ষণ না সফল হই রবীন্দ্রনাথকে নিজের মধ্যে ধারণ ক‍রি। ষাট পেরিয়ে তিনি যদি নবীনতায় সজীব হতে পারেন আমরা কেন পারবোনা ?

Thikana

(A short story on divided Bengal)
“আল্লা, মেহেরবান! তুমি আমারে ক'য়ে দাও—কোনডা আমার দ্যাশ। তোমার বানানো এই জমিনে ক’নে এট্টু শানতিতি থাকতি পারব....” নামাজ শেষে ডুকরে কেঁদে ওঠে বুড়ো। কাঠফাটা রোদে গাছতলায় বসে নামাজ পড়ছিল। বয়সের হিসাব নেই তার। ন্যাড়া মাথা, দাঁতগুলো ঝরে গেছে। রোগা দেহ। ছেঁড়া গামছা পেতে নামাজ পড়ছিল সে।

ঠিকানা নেই বুড়োর। অথচ মেহেরবান আল্লা পয়দা করেছিলেন যখন, ঠিকানা তার একটা ছিল বৈকি। এই বাংলায়-ই। সে ঠিকানায় কোন পূব ছিল না, পশ্চিম ছিল না। পূব পশ্চিমের মাঝে কোন সীমানাও ছিল না। এক আধা গঞ্জে তাঁর জন্ম। বাপের ছিল ছোটখাট ব্যবসা। পাটের ব্যবসা, তিলের ব্যবসা। মরশুমে কিনে জমাত। আবার সুযোগ বুঝে পাইকারী বিক্রি করে দিত সব।

অনেকগুলো দিদির পর জন্মেছিল বুড়ো। খুশীর জোয়ার বয়েছিল দাদা-দাদী নানা-নানীদের মধ্যে। সবার মধ্যে। সেই খুশীর আমেজেই এক এক করে সাদি হয়ে গেল সব কটা দিদির। একসময় ধূমধাম করে বিবি এল তার ঘরে। আবার বাপ হতেও সময় লাগল না তার।

এই সময়ে কি সব ওলট পালট হয়ে গেল। তাদের দেশটা নাকি আর তাদের নেই। ভাগ হয়ে গেছে সেটা। দেশের মধ্যে সীমানা তৈরি হয়ে গেছে। শুধু
সীমানাই তৈরি হয়নি—তাদের পরিচয়ও পাল্টে গেছে। তারা আর বাঙালী নেই—মুসলমান এবং পাকিস্তানী।

দাঙ্গা-হাঙ্গামা হল। বাপ নির্বিকার। খুন-জখম হল। ভয়ে মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। বাপ অনড়। এ মাটি তার, তার বাপের। তার পূর্বপুরুষের। এ মাটি ছেড়ে সে যাবেনা। কারা কোথায় বলল—এ দেশ তার নয়, সে কথা মানবে কেন? তার সারা জীবনের ঘাম, আশা—এই মাটিকে ঘিরেই। সে এটা ছাড়বে না, কিছুতেই না।

দেশ ভাগ হ'ল। এদেশ থেকে মানুষ গেল। ওদেশ থেকে মানুষ এল। দাঙ্গা থিতিয়ে এল। বুড়োর বাপ কিন্তু ভিটে ছাড়ল না। তারপর এল একটা রাত। যে রাতটার কথা সে ভুলতে পারে না। যে রাতটা তার সারা জীবনের হিসেব নিকেশ তচনচ করে দিয়েছে।

বাপ শুয়ে পড়েছিল। শুয়ে পড়েছিল মিয়া-বিবিও। এমন সময় কিছু মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি কানে এল। ক্রমশ সেটা বাড়ল। বাড়তে বাড়তে একসময় জোর ধাক্কা মারল তাদের সদর দরজায়। বেদম ধাক্কা, গালি গালাজ। মানুষেরই তবে অন্য রকম মানুষের। ভয়ে কুঁকড়ে গেল বুড়ো। বুড়োর বাপ কাশতে কাশতে বিছানা ছেড়ে এল বারান্দায়। বুড়ো তার বাপকে চিৎকার করে বলল—দরজা
খুল না—আব্বা।

ওর ভয়ার্ত আবেদনে সাড়া দিল না তার বাপ। এগিয়ে গেল, দরজা খুলল। হুড়মুড়িয়ে ঢুকল কিছু উত্তেজিত মানুষ। অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে আদেশ করল—বাঁচতে চাস্ তো বেরিয়ে যা এখুনি। বাপ সামনে দাঁড়াল তাদের।
দুহাত তুলে বলল—'চলি যাও তোমরা। এ বাড়ি আমার, আমার বাপের, আমার
চোদ্দ পুরুষের। এ ভিটে অমি ছাড়বনি। কোন মতেই না। পরান থাকৃতি না, চলি যাও তোমরা—চলি যাও—” উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল বাপ।

কিন্তু বুড়োর বাপের গলার জোর থেকেও ওদের গলার জোর আরো বেশি। তাই ঢাকা পড়ে গেল তার বাপের গলা। বাপকে জোের ধাক্কা দিল একজন। বারান্দার থামের উপর আছড়ে পড়ল বাপ। লুটিয়ে পড়ল....আল্লা বলে। জ্ঞান
হারাল। সে জ্ঞান আর ফিরল না। নিজের বাপের ভিটে থেকেই সোজা চলে গেল আল্লার দরবারে।

ঠিকানা বদলাল বুড়োর। বিবি ছেলেকে নিয়ে উঠল গাঁয়ের এক আত্মীয়ের বাড়ি। পরের জমিতে আস্তানা গড়ে উঠল নতুনভাবে। কিন্তু নতুন আশায় বুক বাঁধতে পারল না। সব খুঁইয়ে কোন রকমে দিন গুজরান করতে লাগল। তার প্রতিদিনের দীর্ঘশ্বাসে জড়িয়ে গেল একটা দ্বন্দ্ব—এদেশ তার নয়, অথচ এটা তার বাপের দেশ, এটা তার জন্মভূমি!

ছেলে বড় হয় ধীরে ধীরে। বায়না ধরে পাকিস্তানে যাবার। শুধু বায়নাই ধরে না—একসময় কিছু বন্ধুর সাথে চলেও যায়। সে-ই কয়েকমাস পরে আবার ফিরে আসে আরো বড় স্বপ্ন নিয়ে। এবার নিয়ে যাবে সে তার বাবা-মাকে। সেই স্বপ্নের দেশে–যে দেশ একেবারেই তাদের, মুসলমানদের। মুসলমান হিসাবে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পারবে সেখানে। পরের দয়ায় থাকতে হবে না।

ছেলের আব্দারের কাছে পরাস্ত হয় বুড়ো। হারানো আশা ফিরে পেতে চায় সে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে—কিন্তু বাপ, সেখানে গেলে খাব কি? থাকব কোথায়?
সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বন্ধুর চাষের অনেক জমি। উত্তর দেয় ছেলে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুড়োর। আরেকটা নতুন ঠিকানা। আরো একজন মানুষের কাঁধে চেপে।

বুড়ো চলে নতুন আস্তানায়। নতুন কিছু মানুষের সাথে আলাপ হয় তার। তবে কিছুই নতুন লাগে না। নতুন মানুষগুলো কথা কয় তারই মত, একই ভাষায় ৷ দিনে পাঁচবারই নামাজ পড়ে তাঁরা। কিন্তু সবাই নয়। কারণ মুসলমানের পীঠস্থান
পাকিস্তানে সবাই মুসলমান নয়। সন্ধ্যায় উলুধ্বনি ভেসে আসে গাঁয়ের কোন কোন ঘর থেকে। মন্দিরে ঘণ্টা বাজে, দূরে দেখা যায় গির্জার চূড়া।

কখনও একাকী নির্জনে ভাবনায় পেয়ে বসে বুড়োর। মন্দির-গির্জা-মসজিদ সে তো এখানেও আছে, ওখানেও ছিল। ওখান থেকে সবাই তারা চলে আসে নি, এখান থেকেও সবাই ওখানে চলে যায়নি। এখানে হিন্দু যারা রয়ে গেছে— তারা কিভাবে বেঁচে আছে? সে কি তার মতই—যেমন সে ছিল ; ভয়ে আশাহত হয়ে? এরা যদি এদের জন্মভূমি আঁকড়ে থাকতে পারে, যেমন আরো
অনেকে ওখানে রয়ে গেছে, সে কেন পারে না? সে কেন চলে এল তার বাপের ভিটে ছেড়ে?

ধর্ম পেটের ভাবনা থেকে নিস্তার দেয় না। সেটা বুঝতে পারে বুড়োর ছেলেও। দিন-রাত ধান্দায় ঘোরে সে। ইতিমধ্যে সংসার বেড়েছে তার, আর
বেড়েছে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। মুক্তির আশায়, বাঁচার তাগিদে, ছেলের পিছু পিছু আবার সীমানা পেরোয় বুড়ো। আবার সে পা রাখে তার বাপের, তার ছেলের জন্মভূমিতে। বুক ভরে জন্মভূমির বাতাস নিতে নিতে বুড়ো বহু দূরের, ভিন রাজ্যের ঝুপড়ির বাসিন্দা হয়ে যায়। আরো একটি নতুন ঠিকানা। নির্বাসিত মাতৃভাষার মধ্যে বেড়ে ওঠে তার সন্ততিরা।

সংসার চলে যায় ভালোই। খাবার জোটে দুবেলা। ছেলে কাজ করে, ঘরের বউও কাজ করে ধনী লোকের বাড়িতে। লায়েক হয়েছে নাতি। সিনেমার হিরো সেজে ঘুরে বেড়ায়। কাজ কিছু একটা করে সেও—তবে কি কাজ বুড়ো জানে না। কথা শুনে মনে হয় সে তার মায়ের ভাষাটা ভুলেই গেছে। একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছে। তাই বাজিয়ে ধাই-ধাই করে নাচে ঘরের মধ্যে, আর এইভাবে নাচতে নাচতেই একদিন নাত-বৌ ঘরে তোলে সে।

পাকা দাড়ি আর টাক মাথার কথা ভাবতে ভাবতে বুড়ো ভুলেই গিয়েছিল  নিজের পরিচয়। সে ভাবছিল সাড়ে তিন হাত জমির কথা। যেখানে সে শোবে শেষ বারের মত, তারপরে চলে যাবে আব্বা আম্মার কাছে।

কিন্তু সে ভাবনায় ছেদ পড়ল বুড়োর। চাঁপা গুঞ্জন সরব হ’ল একসময়। আবার সে চিহ্নিত হয়ে গেল ‘মুসলমান' হিসেবে। শুধু মুসলমান নয়, সঙ্গে আরো
একটি নাম—‘অনুপ্রবেশকারী'। তার জন্মভূমিতেই সে অনুপ্রবেশকারী !

ধর্মনিরপেক্ষতার পোষাকে বুলডোজারে চড়ে বসল প্রশাসন। হঠাৎ ঝুপড়ি গেল  গুঁড়িয়ে। তার আদরের নাতিটা কাজ থেকে বাড়ি ফেরেনি তখনো। তাকে ছেড়ে পুলিশের গুঁতো খেয়ে গাড়িতে উঠল সবাই। খালি হাতে, তিনদনি পরে—আরো গাড়ি পাল্টে, আরো অনেকের সাথে, আবার তারা চলে এল সেই সীমানায়, স্বদেশের সীমানা, যা বুড়ো এর আগে দু’বার পেরিয়েছে।

চিহ্নিত সীমানা পেরোতে হ’ল চিহ্নিত হয়েই। দাগী চোরের মত সমস্ত বেটা ছেলেদের মাথা অর্ধেক কামিয়ে সীমানার ওপারে ঠেলে দিল প্রশাসন। বাচ্চা বুড়োর আঁকড়ে রাখা শেষ সম্বল কাঁথা-কম্বল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দিল আগুনে।

বন্দুকের বাঁটের খোঁচায় ‘দেশ’ পেরিয়ে ‘দেশে’ ঢুকতে গেল বুড়ো, বুড়োর দল, কিন্তু কিছুটা এগিয়েও ‘দেশে’ ঢুকতে থমকে দাড়াতে হ’ল তাদের। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকদল বন্দুকধারী—একেবারে পিছনে ফেলে আসা ওদের মত, কেবল পোষাক একটু আলাদা। বন্দুক উঁচাল তারা। এদেশও তাদের নয়— অবাঞ্ছিত তারা।

কেটে গেল চারটে দিন। অনাহার, অনিদ্রায়, খোলা আকাশের নিচে পড়ে রইল তারা। একদিকে স্বদেশ—অন্যদিকে স্বধর্মের দেশ,—অথচ কোন দেশেই
ঢুকবার অধিকার নেই তাদের। মাঝখানের আমবাগান-কলাবাগানের সামান্য একটু জমি, যা সরকারি ভাষায়—'নো ম্যানস্ ল্যাণ্ড’। তার গাছ তলায় ছেঁড়া গামছা পেতে দিনরাত আল্লার দরবারে করুণ আর্জি জানাচ্ছে বুড়ো—
আল্লা মেহেরবান! তুমি আমারে ক’য়ে দাও—কোনডা আমার দ্যাশ? তোমার বানানো
এই জগতে ক’নে এট্টু শানতিতি থাকৃতি পারব........?

নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর, '৯৫

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...