বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শিকার । Hunting



বক-বকম -

এঁদের জীবনে শব্দটা খুব মানানসই। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স দু'জনের। সেই  কবে থেকে ক্লাশ ডিঙোতে ডিঙোতে দু’জনের বক্-বকম্ শুরু হয়েছিল।সেই বক্-বকম্ আর থামেনি। চেষ্টা চলেছিল বৈকি। ছেলের বাপ তার রাজপুত্রের মত ছেলেকে থামাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কি যে দেখেছিল সে একটা কালো, নাদুস-নুদুস, কৌলিন্যহীন মেয়ের মধ্যে ! বাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘর বেঁধেছিল তারা।

ঘর বেঁধেছিল বটে তবে ঘর ভরতে পারেনি। কেন যে ঘরে কোন নতুন  অতিথি এল না,— জানে না তারা। তবু বক্-বকম্ তাদের থামেনি। প্রাণের জোয়ার ছিল বড় বেশি। আর সেই জোয়ারে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একদিন গেঁটে বাতে বিছানায় আশ্রয় নিল গৃহিনী। আর সেই সুবাদে দু’জনেরই অফিসের হাজিরা খাতায় ছুটি শব্দটা যোগ হয়ে গেল বেশ কয়েক দিনের।


কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। চলতে পারে না বলেই কাজের মেয়ের খোঁজ করতে হল। এবং খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল—“কোন এক গাঁয়ের বধূ।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল গৃহিনী। আবার হাজিরা খাতায় সই করতে লাগল। সেই সঙ্গে বাড়ির প্রাত্যহিক কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল কাজের মেয়েটা। সে হয়ে উঠল ‘অপরিহার্য। গৃহকর্তা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন –বক বকম  ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয় গৃহিনীকে। সে কাজে সহযোগিতা করার দায় তো তারই। আর সেই জন্যেই স্থায়ী হয়ে গেল কাজের মেয়েটা।

সময় যাচ্ছিল উচ্ছ্বাসেই। বিশেষ করে বাড়ির কর্তার। কর্তার এই উচ্ছাসের রেশ ধরে হিসাব কষলেন গৃহিনী। কর্তার বক বকম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তার বাড়িতে হাজিরা। তার গেঁটে বাতের পর বাড়িটাকে বড় বেশি এঁটে ধরেছে কর্তা। গৃহিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল। বিপদের আঁচ পেলেন তিনি। ঝাকুনি খেল তার মনের সিংহাসন। অস্থির হয়ে উঠলেন। একদিন বক্-বকম্ করতে করতেই পাড়লেন কথাটা। কর্তা কিন্তু অভিযোগ স্বীকার করলো না। গৃহিনীর বড় বাড়াবাড়ি। কয়েক দিনের জন্য নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল সংসার।


কর্তা ভাবলেন কয়েকটা দিন। ফিরে দেখলেন নিজেকে। সত্যিই তো কাদা জমেছে তার মনে! ভাবলেন ধুয়ে ফেলবেন। গৃহিনীর মুখোমুখি হলেন আবার।

--বাবা বলতেন, তুমি কালো। কিন্তু আমি তোমার মধ্যে কোন কালো খুঁজে পাইনি, খুঁজে পেয়েছিলাম মনের সত্যকে। সেই সত্যকে আমি বেছে নিয়েছিলাম। 

গৃহিনীর নিরস মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন। কথার যাদু জানেন কর্তা। সেই যাদুতে স্পষ্ট দলিল লিখতে সচেষ্ট হন 

--কিন্তু আরো এক সত্যের মুখোমুখি আমি। এই বুড়োবয়সেও পথে-ঘাটে তোমাকে খুঁজি, তোমার দিকে লোভীর মত তাকিয়ে থাকি আমি—আমাদের সেই প্রথম জীবনের অষ্টাদশী নাদুস-নুদুস্ তোমাকে।

নীরস মুখে হাসির আভাস মেলে। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে যায় কর্তার পরের কথায়, 

–বাড়ির কাজের মেয়েটা আমার সেই পুরনো লোভটাকে জাগিয়ে দিয়েছে।

কর্তার মনের কাদার ছোপ লাগল গৃহিনীর। স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। আবার থমথমে ভাব। দু’জনের মাঝে চোরকাটা জমে উঠেছে ধীরে ধীরে। বক্-বকম্ আর

জমে উঠছে না কোন মতেই। চেষ্টা করলেন গৃহিনী। সেই চেষ্টার প্রথম ধাপে কয়েক দিনের মধ্যেই কাজের মেয়েকে বিদায় দিলেন।


অভ্যস্ত জীবনটায় টান পড়ল আবার । অফিস ও রান্নাঘরের ঠুন-ঠানের সাথে মানিয়ে নিতে চাইলেন আগের মতন। দু'জনেই প্রাণ খুলে আবার আসর বসাতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে। গোপনীয়তার কাদা উঠে গেল ধীরে ধীরে। আর সেই ধোয়া মনে পরিষ্কার হয়ে গেল কর্তার লোভের দাগটা। নিত্যদিনের আলোচনা - অফিস, বাস, ট্রাম, স্কুলের গেট—সবকিছুর মাঝখানেই একটা বিষয় ঘুরে ফিরে আসতে লাগল; নাদুস নুদুস্ – অষ্টাদশী.... । তবু এই সব প্রাথমিক আলোচনার

মাঝে অপ্রাসঙ্গিক কিছু খুঁজে পাননি গৃহিনী, কিন্তু হঠাৎই একদিন গৃহিনীর ভাবনার আকাশে মেঘ জমল। সেদিন একটু রাত করে বাড়ি এলেন কর্তা। বেশ হাসি

খুশি, টগবগে। গৃহিনী বুঝতেই পারছিলেন বক্-বকমের জোয়ার বইবে আজ।

তাড়াতাড়ি সব কাজ গুছিয়ে মুখোমুখি হলেন কর্তার।

--একটু ঘুর পথে ফিরলাম আজ । নিজেই শুরু করলেন কর্তা।

--কোথায় গিয়েছিলে?-পানে চুন লাগাতে লাগাতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন তিনি।

-- হাটে।

-- হাটে? এই শহরে হাট?

--শুনেছি অনেক দিন—এই শহরেই হাট বসে। বেশ জমজমাট হাট। প্রতিদিন। প্রতিক্ষণ। তবে বিক্রি হয় মাত্র একটাই জিনিস। পুতুল। বিবরণ কেন্দ্রীভূত হয়।

--পুতুল? সে কি গো——কোথায় সেটা, কেমন পুতুল?—উৎসুক প্রশ্ন করে এক নাগাড়ে।

--হ্যা পুতুল। তবে মাটির নয়, প্লাস্টিকেরও নয়। রক্ত-মাংসের।

গৃহিনীর ইন্দ্রিয় সজাগ হয়। বাক্যহারা হয়ে যান তিনি। বলতে থাকেন কর্তা,

--মেলার পুতুল তো দেখেছ-- ছোট, বড়, নানা আকারের। এ মেলায়ও ছেট, বড় নানা আকারের রক্ত মাংসের পুতুল পয়সায় মেলে। তবে বাড়ি আনা যায় না।। যতক্ষণ পয়সার রেশ থাকে ততক্ষণ তোমার। অনর্গল কথা বলে যায় কর্তা।

কিন্তু গৃহিনীর কানে পৌঁছায় না সে সব । শব্দের কোলাহলে নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় গৃহিনী। কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন-- সে প্রশ্ন আর করতে হয় না। বুঝতে পারে অতীতের সেই লোভী মানুষটা আবার জেগে উঠছে। শিকার খুঁজছে সে, নাদুস-নুদুস– অষ্টাদশী।


কিন্তু কি করবে গৃহিনী? কি সে করতে পারে? তার ভালবাসার এই লোভী মানুষটাকে সে কি ছেড়ে দেবে শিকারের দিকে? এই লোেভ মিটাবার সামর্থ্য তো তার নেই। তবে সে কি জোর করে বশীভূত করে রাখবে? সে কি এই স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনায় জল ঢেলে দেবে? কর্তাকে বাধ্য করবে এই সব অলোচনার প্রসঙ্গ না তুলতে? কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? সেকি পারবে তার কর্তার মনের মাঝে বাসা বাঁধা লোভী সত্তাটাকে উপড়ে ফেলতে?

ভাবনায় রাতের ঘুম চলে যায় গৃহিনীর। যে রাজপুত্রকে সে খাঁচায় বন্দী করেছিল—সে তো খাঁচায় আছে এখনো। দরজা খোলা পেয়েও পালায়নি। হয়তো সেও ভালবেসে ফেলেছে এই খাঁচাকে খোলা দরজায় না পালিয়ে বরং সে উঁকি-ঝুঁকি মারতে ভালবাসে। খাঁচায় থেকেই সে অষ্টাদশীর ছোঁয়া পেতে চায়। কি করবে গৃহিনী! সে খাঁচার দরজা শক্ত করে আটকে দেবে? কিন্তু পুরুষের তৈরি খাঁচায় সে কি পুরুষকে আটকে রাখতে পারবে? তাদের যে হাজার দরজা খোলা। ভাবতে থাকে গৃহিনী। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা মাথার মধ্যে ডাকতে থাকে একটানা। যতই সে বন্দী করুক -এ আকাশ পুরুষের, একা পুরুষের। তবু তার ইচ্ছা করে এ পাখি তার একার থাক। সে তার বক্-বকম্ হারাতে চায় না। তার রাজপুত্র তারই, একান্তভাবেই তার।

অফিসে গিয়ে উলের কাঁটা নাড়তে নাড়তে পাশের টেবিলের সহকর্মীকে গিট-বাতের কথা বলে। ঘর মোছার কষ্ট, কাপড় কাচার কষ্ট, সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট। আর বলে একটা মেয়ের কথা। কাজের মেয়ে। একজন অষ্টাদশী চাই তার। নাদুস-নুদুস হলেই ভাল। তার সুন্দর ঘরে, সারা জীবনের সাজানো ঘরের মানান সই একজন মানুষ চাই। পয়সার কথা ভাবে না সে। সে ভাবে ঘরের মানুষের কথা।

যরের মানুষের ঘরে ফেরার কথা।

সহকর্মীর আকুতিতে সাড়া দেয় সহকর্মী। দুর গ্রাম থেকে নিয়ে আসে একজনকে।

বাপ মরা মেয়ে। মায়ের বুক ছিঁড়ে চলে আসে দুটো ভাতের আশায়, ভাল থাকার আশায়। বুড়ো-বুড়ির সংসার । সাজানো সংসার । ভাবনার কিছু না পেয়ে নিশ্চিন্তে সহকর্মীর হাতে তুলে দেয় সহকর্মী।

লাজুক মেয়ের জটা চুলে হাত বোলায় গৃহিনী। গভীর মমতায়। ভালবাসতে চায়। সুগন্ধী সাবান আর শ্যাম্পুতে স্নান করায় তাকে। নতুন জামা পরায়। সুন্দর ঘরের উপযোগী করে সাজায়।

অফিস আবার আগের মত তাড়াতাড়ি ছুটি হতে থাকে। এই শহরের হাটে একজন হাটুরে কমে যায়। বক্-বকম্ বাড়ে। রান্না ঘরে আনা-গোনা বাড়ে। ঝি ঝিঁ পোকার ডাক আর একঘেয়ে থাকে না, চুড়ির শব্দ যোগ হয় তাতে। বক-বকমের মাত্রা বাড়ে, রাত বাড়ে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে গৃহিনী। বাতের ব্যথায় জেগে ওঠে আবার। অভ্যস্ত হাতটা শূন্য লাগে। হাতড়ায় , চোখ মেলে অন্ধকারে তন্ন তন্ন করে খোঁজে । পায় না কিছু। শুধু একটা আওয়াজ ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে—খট্ খট্। গৃহিনী বুকের মধ্যের গৃহটাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। বুকটা কেমন ফাঁকা হতে থাকে। প্রাণপণে বালিশ চাপে বুকে। বালিশে, বিছানায় গন্ধ খোঁজে, সুগন্ধী সাবানের , শ্যাম্পুর; তার নিজের তেরি গন্ধে সতেজ হতে চায়। সুগন্ধ খুঁজে পায় না। চারিদিক থেকে কেবল খট্ খট্ আওয়াজে কেঁপে ওঠে, ইটগুলো খসে পড়তে চায়। দু'কানে আঙ্গুল চেপে শব্দটা আটকাতে চায়; আর জোর করে সে অষ্টাদশী হতে চায়, নাদুস-নুদুস অষ্টাদশী।


ভোর হয়। পাখির পালকের মত বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে যান কর্তা।

কাজের মেয়েটি গাঁয়ের মেয়ে হয়ে দাঁড়ায় গৃহিনীর সামনে। পরনে পুরনো জামা, খালি পা, এলো চুল। সরাসরি তাকায় গৃহিনীর চোখের দিকে। গৃহিনী কিছু বলার আগেই হাত বাড়ায় মেয়েটি। ভাঙা চুড়িগুলি গৃহিনীকে ফেরৎ দেয়। ছোট্ট পুঁটলী হাতে লোহার গেট পেরিয়ে জংলা গাঁয়ের দিকে হেঁটে চলে মেয়েটি।


আবার একদিন কোলের উপর শরৎচন্দ্র পড়তে পড়তে সহকর্মীকে বাতের কষ্টের কথা বলে গৃহিনী। আর বলে বক-বকমের কথা। বক্-বকম করার জন্য একটা মেয়ে চাই তার। কাজের মেয়ে। নাদুস-নুদুস। অষ্টাদশী হলেই ভাল হয়।


চতুর্থ দুনিয়া, '৯৬


2021-9-21 14:13

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...