বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধূসর ডায়েরীর পাতা। Ashy Diary Page

(short story)

ধূসর ডায়েরীর পাতা

আজ সকালে যে সূর্যটা উঠেছিল সেটা অন্যদিনের মত ছিল না। আমি সকালবেলা যখন জানালার ধারে বসে থাকি ; সূর্য ওঠে। সিদ্ধ ডিমের কুসুমের মত ফ্যাকাসে সূর্য। জানালার বাইরের আকাশে দু-চারটে পাখি উড়ে যায় এদিক সেদিক। কাকের কা-কা, চড়ুইয়ের কিচির-মিচির। এ সবের অনেক আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও পাড়ার মোরগটার ডাক শুনলেই আমি বিছানা ছাড়ি। আজকেও মোরগটার ডাকে বিছানা ছেড়েছি। মা-বাবা শুয়ে আছে পাশের ঘরে।
 প্রতিদিনের মত জানালার ধারে বসে সকালের পাখির ডাক শুনছিলাম। ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছিল চারিদিক। তার মধ্যেই এক সময় সূর্য উঠল। একেবারে লাল। সেই-যে হাসপাতালে যখন সিস্টার আমার হাত থেকে রক্ত নিয়েছিল, সেই রক্তের মত লাল। আজকের সূর্য এত লাল কেন?

কতদিন আমি লালের গল্প শুনেছি। তোমার মুখে। লাল ফৌজের গল্প, লাল নিশানের গল্প। বলেছিলে, আমেরিকার মাটিতে শ্রমিকের রক্তে ভেজা কাপড়ে লাল নিশানের জন্ম। আরো বলেছিলে, লাল মন পাল্টায়, সমাজ পাল্টায়, দেশ পাল্টায়। লাল মুক্তির প্রতীক।

আজকের সূর্য এত লাল কেন? এ সূর্য কি আমার মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে? জানো, আমার জীবনেও লাল পরিবর্তনের প্রতীক। ঠিক তোমার কাছে শোনা গল্পের মত। আমার এই চৌদ্দ বছর বয়সে অনেকগুলি লালের মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিটি লাল আমার জীবনে একেকটা বাঁক তৈরি করেছে।

পাঁচ বছর আগে একদিন এক পড়শি বলল,
- ‘বা! তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস্।'
 আরও কিছুদিন পর ঠাকুমা বলল,
—মোটা না ছাই, খোকা ওকে ডাক্তার দেখা।’ ঠাকুমার কাছে ‘মোটা’র বদলে ‘ফোলা’ শব্দটা এল। বাবা নিয়ে গেল ডাক্তার কাকুর কাছে। হোমিওপ্যাথী ডাক্তার। ছোট ছোট অসংখ্য শিশি। তাতে সব জলের মত ওষুধ। আমায় দেখে শুনে ডাক্তারকাকু বলল,
- ‘ও কিচ্ছু না; ঔষধ দিলাম, সাইরা যাইবো।' কিছুদিন ওষুধ খেলাম। কমল না। বরং ফোলা আরেকটু বেশি হল। ডাক্তার কাকু এলেন আমাদের বাড়ি। চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। গায়ের নানা জায়গায় টিপে টিপে দেখলেন। অবশেষে বললেন, 
- ‘ফোলা যহন বাইড়ছে তহ’ন ঔষধে কাম হইতাছে। ঔষধে রোগ বৃদ্ধি ভাল লক্ষণ।' 
কিন্তু ভাল লক্ষণ আর বেশি দিন ভাল থাকল না। ফোলা বাড়ল। মাথা ব্যথা বাড়ল। মাঝে মাঝে জ্বর শুরু হল। অনিয়মিত প্রস্রাব হতে লাগল। একদিন প্রস্রাব করতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। প্রস্রাবের রঙ রক্তের মত! না রক্তই পড়ল। লাল রক্ত। ভয়ে মাকে বললাম। মা শুনল এবং বলল, 
- 'ও কিছু না।' 
কিন্তু আমার তো ভয় হচ্ছিল, কষ্টও হচ্ছিল। বাবার গলা জড়িয়ে আমার ভয়ের কথা বললাম, কষ্টের কথা বললাম। মা বাবাকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। কিছু বলল বাবাকে। কিন্তু বাবা সেটা মানতে চাইল না। অস্পষ্ট কথা, বুঝতে পারছিলাম না। বাবার একটা কথা কানে এল, বেশ জোরেই বলছিলো, 
- ‘কিন্তু খুকির তো সবে নয় বৎসর, এটা অস্বাভাবিক।'

অস্বাভাবিকতার আশঙ্কায় বাবা ব্যাকুল হয়ে উঠল। হোমিওপ্যাথী ছেড়ে এ্যালোপ্যাথী ধরল। ছোট শহর ছেড়ে বড় শহর, তারপর আরও বড় শহর। ইতিমধ্যে খাবারের পরিবর্তন ঘটতে লাগল। বিধি-নিষেধ জারি হ’ল। পরীক্ষা নিরীক্ষার পরিধি বাড়ল। দেহের রক্ত, লাল রক্ত, ছোট ছোট শিশিতে ভরে পরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে লাগল।

আমাকে নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা—সবই স’য়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। রোগটা যে কি—তাই জানতাম না আমি। পরে জেনেছি— নেফ্রাইটিসে ভুগছি আমি। কিন্তু রোগ তো কত জনেরই হয়, আমারও হয়েছে। তাই ভাবনা ছিল না তত। ভাবনা হ’ল মা-বাবার কথায়, তাদের আচরণে।

বড় শহরের বড় হাসপাতালে ছিলাম তিন মাস। হ্যাঁ, একটানা তিন মাস। তুমি তো জান সে সব। সেখানে ভাল ছিলাম আমি। আমার পাশের শয্যায় যে মেয়েটি ছিল, সেও খুব ভাল ছিল। ডাক্তার পিসিও খুব ভাল, ডাক্তার কাকুও খুব ভাল। আর তিন মাস পরে ভাল হয়েই বাড়ি এসেছিলাম। আমি তো বাবার কাছে ছাড়া ঘুমাতাম না। বাবার গলা জড়িয়ে না শুলে আমার ঘুম আসত না। এক রাত্রে সেই ভাবেই ঘুমিয়ে ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলাম। ঘুম চোখে তাকালাম।

জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় দেখলাম বাবা মা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বাবার গলা জড়িয়ে ধরার জন্যে হাত বাড়াতে গেলাম। কিন্তু কেন যেন সেদিন হাত উঠল না। বাবার গলায় তো মায়ের হাত! আমি ঐ ভাবেই শুয়ে রইলাম। একসময় কান্না ভেজা গলায় মা জিজ্ঞেস করল, - ডাক্তার আর কিছু বলল?
- 'একেবারে সুস্থ না হলেও কিছুদিন ভাল থাকবে যদি নিয়মমত ওষুধ পথ্য দেওয়া যায়,'  উত্তর দিল বাবা।

কিন্তু কতদিন ভাল থাকবে তা কিছু বলে নি? ব্যকুল হ’ল মা।
- বলেছে। দুইবছর, চারবছর বা আরেকটু বেশি। কিন্তু তারপর— 
একটু থেমে বাবা হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল, —- - - -খুঁকি না থাকলে আমরা কি নিয়ে থাকব....। কেঁদে উঠল মাও।

শিশি ভরা রক্ত, লাল রক্ত আমার বাবা মাকে হতাশ করেছে। আর আমি জেনে গেছি আমার সময় সীমা—দুই বা চার বা....।

ভোরের আকাশ লাল মেঘে সেজে আছে। সেই লালের সামনে জানালায় বসে তোমায় এত কিছু বলছি কেন—জান? সেই যে তুমি বলেছিলে—মনের গোপনীয় কথাটিও বলতে হয় প্রিয়তম বন্ধুটিকে। আর সবচেয়ে প্রিয়তম বন্ধু হতে পারে মা।'
 কিন্তু মাকে তো এ কথাগুলি বলা যায় না তাই বলছি দু’টো ‘মা’ এর যোগফলের কাছে অর্থাৎ তোমার কাছে। তুমি আরো বলতে——‘পাকা বুড়ি’। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি বুড়ি হয়ে গেছি। বুড়িদের সামনে যেমন মৃত্যু অহরহ ঘোরা ফেরা করে—তেমনি আমিও তোমাদের অনেক আগেই চলে যাব।

জান, মনের মধ্যে যে ঝড় উঠেছিল সে রাত্রে, সেই ঝড় ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছিল। স্কুলে যেতাম। কামাই করতাম। ওষুধ খেতাম। আবার ভাল থাকতাম । ভালই ছিলাম তিন বছর। তারপর আবার একদিন লাল রক্ত নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। মাকে বললাম। মা বাবাকে বলল। বাবা কিন্তু এবার আর অস্বাভাবিক বলল না। মা আমাকে একান্তে অনেক কথা বলল। আমি শুনলাম। শুনতে শুনতে বার বছর বয়সে আমি বয়স্ক হয়ে উঠলাম।

তোমার ‘পাকা বুড়ি’ এরপর একটা কাণ্ড করল। এটাকে তুমি পাকামিও বলতে পার। আমি তো তখনও বাবার গলা জড়িয়ে শুতাম। অলক্ষ্যে মা বাবার হা-হুতাশও শুনতাম। তাদের একমাত্র সন্তান আমি। তাদের মত আমিও জানি, আর বেশিদিন বাঁচব না। কি নিয়ে কাকে নিয়ে থাকবে তারা? একদিন বাবার কাছে আব্দার করলাম,
-  ‘বাবা আমি পাশের ঘরে একলা শোব।' 
বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কি জানি কি ভাবল। কষ্টই পেল বাবা। কিন্তু কি করব বল— আমারও তো কষ্ট হচ্ছিল। আমি যদি বাবা মার কাছ থেকে দূরে না থাকি, আমার মত আরেকজন তো আসবার সুযোগ পাবে না। শুধু তাই নয়, একদিন বাবার মাথার পাকা চুল তুলতে তুলতে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
-  'বাবা, আমাকে যেমন তোমরা হাসপাতাল থেকে এনেছিলে তেমনি আমায় একটা ভাই বা বোন এনে দাও না। বাড়িতে একটা খেলার সাথী না থাকলে আমার ভাল লাগে না।' 
আমি জানতাম বাবা আমার জন্যে অসাধ্য সাধন করতে রাজি। সেদিন বাবা একটা কথাও বলেনি, কেবল আমায় জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছেছিল।

একা ঘরে থাকি আমি। ভাল লাগে না আমার। বাবাকে ছাড়া প্রথমে ঘুমই আসত না। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়। তোমায় তো বলেছি, বার বছর বয়সেই অনেক বয়স্ক হয়ে গেছি আমি। অন্য একদিনের ঘটনায় বুঝতে পারি আরো বেশি করে। গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়েছিলাম চোখ বুঁজে । কপালে একজন হাত রাখল। জানো, বাবার হাতের থেকে আলাদা ছোঁয়া, আলাদা অনুভূতি এনে দিয়েছিল সেদিন। ওপাড়ার মোরগ ডাকা বাড়ির চাচার ছেলে। আমার থেকে দু’তিন বছরের বড়। বার বছরের লাল আমার জীবনে একরাশ রঙ নিয়ে এল। রঙিন স্বপ্ন দেখতে লাগলাম আমি।

মোরগ ডাকা ভোরে আমি জানালার কাছে আসি। আমি জানি, মোরগ ডাকা ভোরেই আরেকটা মানুষ আমাকে দেখা দেবে। লাল সূর্য দেখলে তোমার কথা ভাবি। তুমি বলতে, 
- ‘লাল পতাকা একদিন সব দেশ একাকার করে দেবে। সব মানুষ একাকার করে দেবে।' 
সব মানুষ যদি এক হয় তবে তো সব জাতি, সব ধর্ম এক হয়ে যাবে। তা হলেই আমার স্বপ্ন সফল হবে। ও পাড়ার চাচার ছেলের ধর্ম আর আমার ধর্ম এক হয়ে যাবে। আমি অসম্ভবকে ছুঁতে পারব। তাই আমি তোমার মত স্বপ্ন দেখি, লালের স্বপ্ন, লাল পতাকার স্বপ্ন।

শরীরের যন্ত্রণা মাঝে মাঝে বাড়ে। সব সময় মা বাবাকে বলি না। কিছুটা নিজেকে আত্মস্থ করতে হয়। আমার যন্ত্রণা প্রকাশ পেলে ওদের যন্ত্রণাও বাড়ে। ইদানিং শরীরটা বাগে থাকতে চাইছে না। আমার দেহের মধ্যে যে ঝাড়ুদার আছে সে ঠিক মত কাজ করতে পারছে না। বর্জ পদার্থগুলি জমে যাচ্ছে রক্তের মধ্যে, দেহের আনাচে কানাচে। প্রস্রাব হয় না ঠিক মত। প্রস্রাবে আবার রক্তের দেখা পাই।

কয়দিন আগে দোল উৎসব হয়ে গেল। রঙ-এর ভাবনায় লাল আবিরে ডুবে গেলাম। শরীরের সব বাঁধা ভুলে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করছিলাম। চাচার ছেলে যখন পিছু নিল পালাতে যাচ্ছিলাম। আর তখনি পৃথিবীটা দুলে উঠল, অন্ধকার হয়ে গেল সব। ফের যখন চোখ মেললাম—আমার চারপাশে অনেক লোক, বাবা, মা, পড়শিরা। ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি।


তারপর থেকে স্কুল বন্ধ আমার। খুব তাড়াতাড়ি সেই বড় হাসপাতালে যেতে হবে। সেই ডাক্তার পিসির সাথে দেখা হবে। ডাক্তার কাকুর সাথে, তোমার সাথেও দেখা হবে। আবার তোমার কাছে গল্প শুনব। আর তুমি যদি মুখখানা হাঁড়ি করে রাখ, তোমাকে গল্প শোনাব আমি। জাতকের গল্প। গল্প শেষে তোমাকে পাঠাব পাড়ায় পাড়ায়, দোরে দোরে। একটা মৃত্যুহীন পরিবারের সন্ধান যদি তুমি পাও তবেই তোমার হাঁড়ি মুখের দিকে তাকাব আমি। তোমরা কষ্ট পেলে আমারও যে কষ্ট হয়। তখন আমার কেবল রোগের কথা মনে হয়। কিন্তু আমার তো ভাল থাকতে ইচ্ছা করে। তোমরা সবাই যদি স্বাভাবিক থাকো, আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে মশগুল থাকতে পারি। যোগ বিয়োগের একটা সাধারণ হিসাব ছাড়া তো অন্য কিছু নয় ; এ পৃথিবীটা তোমরা ছাড়তে, আমিও ছাড়তাম। ব্যতিক্রম এই আমি তোমাদের একটু আগেই ছাড়ব।

যে ডায়েরিটায় তোমাকে লিখছি তার রঙ ধূসর। কিন্তু এর পাতায় পাতায় অনেক রঙ,—তুমি খুঁজে নিও। এই ধূসর ডায়েরির পাতায় একদিন আমি হারিয়ে যাব। কিন্তু আমার স্বপ্নগুলি থাকবে, আমার ভাই অথবা বোন থাকবে, ওপাড়ার চাচার ছেলে থাকবে। যে স্বপ্নগুলি আমি লালন করতাম, তোমরা সবাই মিলে সেগুলি বাস্তবায়িত ক’রো। তোমাদের নিরন্তর চেষ্টায় আমি, আমার মত অনেক মানুষ বেঁচে থাকব।
***

সাগর সংস্কৃতি, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...