মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ধা ধিন ধিন ধা (Short Story)



শ্যামলা রঙের অষ্টাদশী মেয়েটি যখন পাশ ফিরে বিছানা ছাড়বার কথা ভাবে তখন ভোর হয় হয়। এই সময়ে তাকে উঠতেই হয়। পাখি ডাকা ভোর তার নিত্য সঙ্গী। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে এক চিলতে ছাদে দাঁড়ায় সে। শান্ত সকালের পূব আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হ’তে থাকে। দু'চারটে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ, দু’চার জন মানুষের আনাগোনা, কাকের কা-কা, চড়ুইয়ের কিচির মিচির, দূর রেল লাইনে গাড়ি চলার শব্দ, ব্যস্ত দিনের সূচনা করতে থাকে। আলো বাড়ে, মানুষ বাড়ে। তারই মধ্যে আপনাকে গুছিয়ে নেয় সে। শুদ্ধ মনে ধূপ কাঠি জ্বালে। এক পায়ে ঘুঙুর বাঁধে। ওড়নাটা কোমরে জড়িয়ে গিঁট দেয়। মেঝেতে পা ঠুকে ঘুঙুরের তালে তালে নিজেকে দোলাতে থাকে। পায়ের শব্দের সাথে মুখের শব্দ একাকার হ’তে থাকে। ধা-ধিন-ধিন-ধা——

সেই তালে তালে সময়ের কাটা এগিয়ে চলে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে কপালে, গলায়। সাড়ে ছ'টার মধ্যেই তাকে থামতে হয়। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্টোভ জ্বালে। চায়ের জল চাপিয়ে পাশের ছোট্ট ঘরটায় ঢোকে। অসুস্থ না থাকলে তার বাবা এর মধ্যেই প্রাত্যহিকী সেরে নেয়। তার প্রিয় বহু পুরানো বেহালাখানা হাতে নিয়ে বসে। ছড়ের পরশ লাগায় বেহালার তারে। জীবনের সব ছন্দ হারিয়ে বেহালার ছন্দ খোঁজে তার বাবা।

বাবার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে ভাইয়ের কাছে যায়। গায়ে হাত বোলায়, আলতো করে ডাকে। তাকে তোলে। বোনদের নামে হাঁক-ডাক পাড়ে। তারা উঠতে থাকে, সেও ব্যস্ত হ’তে থাকে। ভাইয়ের টিফিন, বোনদের টিফিন, ভাইয়ের স্কুল, বোনদের স্কুল। ভাইয়ের আব্দার, বোনদের আব্দার। সব তাকে সামলাতে হয়। মা থাকলে করতে হ’ত না। মায়ের অভাবটা তাকেই মেটাতে হয়। মা-বাবার প্রথম সন্তান সে। তার জন্যে কতটা কামনা ছিল সে জানে না। কিন্তু ভাইয়ের জন্যে বাবার কামনা ছিল বড় তীব্র। ভাই না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি তার মা। ভাই এল। বাবা স্বস্তি পেল। মাও স্বস্তি পেল, চিরতরে। ভাই ঘরে ফিরে এল, মা আর এল না। সারির প্রথমে সে, সব শেষে ভাই।

ভাই-বোনদের প্রাথমিক পাঠ চুকতে চুকতে তার খুদে শিক্ষার্থীরা হাজির হ’তে থাকে। তাদের ঘুঙুর বাঁধা পায়ের তাল তুলতে তুলতে তাকে বলতে হয়,
তবলার তালে নাচতে হয়—-ধা-ধিন-ধিন-ধা....।এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রায় ঘন্টা দুয়েক। জীবিকার প্রয়োজনটাই এখানে প্রধান। জীবিকার প্রয়োজনে এদের বিদায় দিতে দিতে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই সময়ে রান্না ঘরের দায়িত্ব থাকে বোনদের উপর। স্নান সেরে নাকে মুখে দুটো গুঁজে ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রেন ধরতে ছোটে।

একটি বেসরকারি সংস্থার বিপণন বিভাগের কর্মী সে। নির্দিষ্ট অফিসে বসে কাজ করার সুযোগ তার কম। বাইরেই কাটাতে হয় বেশির ভাগ সময়। এলাকা ভিত্তিক লোকের দোরে দোরে হাজির হতে হয়। দোকানে দোকানে হাজির হ’তে হয়। তার সংস্থার তৈরি পণ্য বিক্রির জন্যে, জনপ্রিয় করার জন্যেই সময় কাটে। তার সুঠাম শরীর দোরে দোরে ঘোরার কষ্ট সইতে সাহায্য করে। তার শ্যামলা গায়ের রঙ রোদে পুড়ে কালো হওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। তার দীঘল কালো চোখ, তার মিষ্টি হাসি, তার কথার ছন্দ তাকে বিপণনে সাহায্য করে, তার প্রতিষ্ঠানের কাছে অপরিহার্য করে তোলে।

অফিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে আসে না সে। সান্ধ্য কলেজের ক্লাসে থাকতে হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। সময় পেলে লাইব্রেরীতে ঢোকে। পড়ে। বই নেয়। বাড়ি আসে। রান্নাঘরে ঢোকে। ভাই-বোন-বাবাকে খেতে দেয়। নিজে খায়। থালা-বাসন ধোয়। সবার বিছানা করে, মশারি টাঙায়। ঘরের আলো নিভিয়ে মশারির মধ্যে ঢোকে।

অষ্টাদশী মেয়েটার সকাল-সন্ধ্যের জীবনচক্রটা এ রকমই। ব্যতিক্রম তো হয়ই। একটার প্রয়োজনে অন্যটা বাদ যায়। তবু সময়ের বেড়াজালে ধরা পড়েও সময়কে হার মানাতে চেষ্টা করে সে। তার দায় তাকে বাধ্য করে, তার আশা তাকে উজ্জীবিত করে।

কারো জীবনে লক্ষ্য থাকে, কারো থাকে না। অষ্টাদশী মেয়েটার লক্ষ্য আছে। ঘুঙুর পায়ে অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখে সে। তার আদর্শ ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি পৌঁছাতে চায় সে। কিন্তু সে লক্ষ্যের পথ বড় অমসৃন। সংসারের দায় তার কাঁধে। ভাই-বোনের সংসারের সব বোঝা নিয়ে তাকে লক্ষ্যের দিকে এগোতে হয়। বাবা কাজ করত একটা কারখানায়। অনেক দিন ধরেই ধুঁকছিল। কারখানার সাথে পাল্লা দিয়ে বাবাও ধুঁকতে শুরু করে। ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন অচল হয়ে যায় কারখানা। বাবার সাথে সংসারটাও ধুঁকতে থাকে কিন্তু একদম অচল হয়ে যায় না। প্রথম সন্তান হিসাবে একটু একটু করে কবে যে সংসারের পুরো দায় তার উপর চেপেছে, সেটা হিসাবে মেলাতে পারে না। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা বাবার কর্মক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। একমাত্র বেহালার ছড় ছাড়া সবই তাকে ছেড়ে গেছে। সংসারের দায়, নিজের নাচের চর্চা—সবই তার ধরা-বাঁধা কাজ। যন্ত্রের মত একটার পর একটা তাকে করতে হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল সব। মাঝে মধ্যে নিজের পাড়ায়, অন্য পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। কখনো নিজের নাচের অনুষ্ঠান থাকে, কখনো অন্যদের নাচ পরিচালনা করতে হয়। এমনি এক অনুষ্ঠানের দিন কয়েক পরে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা স্কুটারের শব্দ যেতে আসতে থাকে। প্রথম দিকে ব্যাপারটায় আমল দেয় না সে। কিন্তু দু’চারদিন জানালা দিয়ে বাইরে দেখার পর সন্দেহ হয় তার। বিশেষ একটা স্কুটার, আরোহীও নির্দিষ্ট একজন। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসে, চলে যায়। সুঠাম, সুপুরুষ, রোদ চশমার ছেলেটা একবার করে বাড়ির দিকে তাকায়। যেতে এবং আসতে। এমনি কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয় স্কুটারের শব্দ। কিন্তু আবার দেখা যায় ছেলেটিকে। হঠাৎ একদিন অফিসে যাওয়ার পথেই রেল ষ্টেশনে তাকে দেখে। আবার একদিন। আবার। দেখাটা যখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, সহাস্যে ছেলেটি বলে—

–কেমন আছ?

--ভাল। আপনি?

কথা হয় তাদের। মাঝে মাঝেই হয়। অতঃপর প্রায়ই। প্রাসঙ্গিক কথা। ট্রেনের কথা। সময়ে আসবার কথা, অসময়ে আসবার কথা। ট্রেন আসে, ট্রেন যায়। ওরা যায়। যার যার গন্তব্যে।

একদিন ছাই রঙের শাড়ী পরে সে। তার চাপা রঙের সাথে সুন্দর মানিয়ে যায়। লম্বা বেণী। অলঙ্কারের বালাই নেই। শাড়ীতে আরো তন্বী মনে হয়। ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়। ভাল লাগা মন নিয়ে ছেলেটি বলে

-বাঃ! দারুণ!

হাসিমুখে তাকায় মেয়েটি। তৃপ্তির হাসি। সে হাসিতে ধন্যবাদ প্রকাশ পায়। আবার একদিন হালকা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। দূর থেকে আসতে দেখে ছেলেটি। শান্ত পুকুরে ঢিল ফেলা ঢেউ তীরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, ছেলেটা প্রশংসা করে তার রুচির, সে আপ্লুত হয়।

দিন এগোয়। ছেলেটি এগোয়। অতি সতর্কতার সাথে এগোয়, কথা বলে মেপে। প্রয়োজনীয় কথাটুকু প্রয়োজনের সময় বলে সে।


অচেনা অষ্টাদশী মেয়েটি অচেনাই থাকত ছেলেটির কাছে। পাশের পাড়ার ছেলে সে, তবু সাধারণ মেয়েটা সাধারণের মধ্যেই মিশে ছিল। ওদের পাড়ার অনুষ্ঠানে সেদিন যখন অষ্টাদশীর নামটা মাইকে ঘোষণা করে, সাধারণের মতই না শোনার মত শোনে তার নাম।

ধা-ধিন-ধিন-ধা -
নাচতে শুরু করে। বিড়ি-সিগারেট-খৈনী সহযোগে আগত মহিলাদের ভাবনায় যখন তার বন্ধুরা মগ্ন, সে মগ্নতায় হঠাৎ ভাগ বসায় ধা-ধিন-ধিন-ধা।

ধ্যানমগ্ন ঋষি। তার কঠোর তপস্যায় দেবতার মন টাল-মাটাল। কিন্তু ঋষির প্রার্থিত বর দেওয়া যাবে না। তাই বিপথগামী করা দরকার ঋষিকে। স্বর্গ থেকে নেমে আসে অপ্সরা। ঋষিকে ঘিরে নাচতে থাকে , ধা-ধিন-ধিন-ধা....। ঋষি অনড়। মগ্ন। নাচতে থাকে অপ্সরা। দ্রুত থেকে দ্রুত হতে থাকে লয়। শৃঙ্গাররসে পরিপূর্ণ মোহময় ছন্দে পরিব্যাপ্ত হতে থাকে চারিদিক। শরীরী উন্মাদনায় ষড়রিপু চেতন হতে থাকে। কেঁপে ওঠে ঋষি,  ধ্যান ভাঙতে থাকে। কামনার হাতছানি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সৃষ্টির অমোঘ আকাঙ্খা সজীব হতে থাকে।

কেঁপে ওঠে ছেলেটিও। ধ্যান ভাঙছিল তারও। নৃত্যের অপ্সরা তার দীঘল কালো চোখ, ছন্দের শরীরী ভঙ্গিমায় সমস্ত দর্শককে এককেন্দ্রিক করে তোলে। সেই থেকে ছেলেটির অন্তরে নাচতে থাকে অপ্সরা। নিজের আকুতিতে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে ধ্যানভঙ্গ ঋষির উদ্ভ্রান্ত ভাব নিয়ে অষ্টাদশীর পাড়া দিয়ে, বাড়ির সামনে দিয়ে চক্কর দিয়েছে কয়েকদিন। অবশেষে লক্ষ্য পুরণের আশায় নিজেকে সংযত করেছে। সতর্ক হয়েছে ছেলেটি। আস্তে আস্তে নিজের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মেয়েটি। ছেলেটার অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছা করে, জানাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মনের দরজাটা হুট্ করে খোলে না। নিজের ইচ্ছেটাকে একদম প্রকাশ পেতে দেয় না। যেটুকু সময় ছেলেটি পায়, মনোযোগী শ্রোতা হতে চায়। অতি ব্যস্ততার সময়ও শান্ত শ্রোতা। অপ্রাসঙ্গিক হলেও মেয়েটাকে প্রাধান্য দিতে কার্পণ্য করে না। সময়ের অপক্ষা করে।

প্রাধান্য পায় মেয়েটি। মেয়েটির ভাব ভাবনার অংশীদার হয় ছেলেটি, সব ভাবনার অংশীদার হতে স্বতঃস্ফূর্ত হয়। তার কষ্টটাকে, বাড়ির প্রতি দায়বদ্ধতাকে বড় করে দেখে, তার দায়িত্বশীলতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। তার শিল্প সাধনায় উৎসাহী হয়ে ওঠে। মেয়েটির আগ্রহের বিষয়গুলি একান্তে রপ্ত করতে সচেষ্ট হয়।
তার ভাল লাগা রঙে চমৎকারিত্ব প্রকাশ করে। মেয়েটি উৎফুল্ল হয়, তার মনকে অবারিত করার সুযোগ পায়।

ভাল লাগার রেশ একদিন ছেলেটাকে মেয়েটার কলেজের সামনে দাঁড় করায়। কলেজ থেকে কলেজ স্ট্রীট। বই কেনে, গল্প করে, ফিরে আসে। আবার একদিন কলেজ থেকে কলেজ স্ট্রীট। বইয়ের দোকান। কফি হাউজ। পার্কের বেঞ্চ। দু’জন দু’জনের কাছে প্রকাশ হয়। সময় দৌড়ে পালাতে থাকে। বিনা নোটিসে ছেলেটার হাজিরা খাতায় লাল দাগ পড়ে মাঝে মধ্যে। কলেজের হাজিরা খাতায় দাগ পড়ে মেয়েটির। বিনা নোটিসে নাচের ক্লাস নেওয়া হয় না। বাবার চায়ের জল ঠিক সময়ে চাপান হয় না কোন কোন দিন। ভাই-বোনদের প্রতি দায়টা যেন আলগা হ’তে থাকে। সময়ে টান ধরে তার। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় কখনো। বাবার বেহালার সুর করুণ হয়ে ওঠে আরো। অপরাধ বোধে ভোগে সে। ছাত্রীদের দিকে অমনোযোগিতা পীড়া দেয়। নিজের নাচের .প্রতি অবহেলায় রুষ্ট হয় নিজেই। ছক করে নিজে। আবার আগের মত তৈরি হবে সে। এক সকালে ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে কোমরে ওড়না জড়ায়। আড়ষ্ট মনটাকে প্রসারিত করতে সশব্দে হাত-পা ক্রিয়াশীল করে সে—

ধা/ ধিন/ ধিন/ধা—

ছেলেটার মিষ্টি হাসি হাতছানি দেয়।
 ধা/ ধিন/ ধিন/-ধা/ধা/ ধিন/ ধিন/-ধা—

গঙ্গার পাড়, দোয়েলের স্বর, হাতে হাত–
ধা/-ধিন/-ধিন/-ধা/ধা/-ধিন/-ধিন/-ধা--

পার্কের বেঞ্চ, আবছা-আঁধার, স্বর-হীন মুখ, দ্রুত-হৃৎস্পন্দন

—ধা।

থেমে যায় সব। শাসন মানাতে পারে না মনকে। হতাশ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আত্মসমর্পিতের মত নিজেকে তৈরি করে সে। নির্ধারিত সময়কে অনুসরণ করে।

কিন্তু নিজের উপর গ্লানি বাড়তে থাকে তার। একদিন নিজের প্রতি রুখে দাঁড়াতে চায়। নির্ধারিত সময়ে নিজেকে ঘরে আটকায় সে। জানালা-দরজা আবার বন্ধ করে। পায়ে ঘুঙুর বাঁধে। বাজনার তালে তালে অভিমন্যু হয়ে ওঠে সে। ছোট্ট অভিমন্যু বিরাট দায়বদ্ধতার সামনে পড়ে। কুরু-পান্ডবের মহারণে জয়-পরাজয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। এ মহাযুদ্ধে পাণ্ডবের মর্যাদা রক্ষার দায় আসে তার উপর। সে দায় সে নিতে পারে, নাও নিতে পারে। কিন্তু প্রকৃত যোদ্ধার মত দায়িত্ব মাথা পেতে নেয়। চক্রব্যুহে ঢোকার কৌশল সে জানে। পিতার অনুপস্থিতিতে তাই অপরিণত বয়সেই মহারণে অংশ নিতে হয়।

-ধা-ধা৷ ধিন-তা।.....

দ্রুত থেকে দ্রুত হ’তে থাকে ঘুঙুরের শব্দ—

—ধা-ধা/ধিন-তা/কত— তাগে—

ঘামে ভিজে উঠতে থাকে সারা দেহ, 
ধিন-তা/তেটে কতা/গদি-ঘেনে——

অভিমন্যু একটার পর একটা ব্যুহ ভেঙ্গে এগোতে থাকে। মুখোমুখি হয় সপ্তরথীর। সপ্তরথীর সাথে অসম যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়তে থাকে সে। ষড়-রিপু সহস্র রিপু হয়ে আক্রমণ করতে থাকে। ভেঙ্গে পড়ে অষ্টাদশী ;
তেটে-কতা/গদি-ঘেনে/ধা।.... ;

নিজের মনের কাছে হেরে যায়। থেমে যায় সে।

ধরা দেয় ছেলেটির কাছে। নিজেকে সমর্পণ করে। সব বাধা ভুলে সে আশ্রয় নেয় ছেলেটির মাঝে।

রাখাল জানে খোঁয়াড়ে গরুর ক্ষমতা। পৌরুষ প্রকাশ পায় ছেলেটির। এক দিন প্রশ্ন তোলে,
—কাল এলে না কেন? 
-তোমায় তো বলেছিলাম, না-ও আসতে পরি।
—কিন্তু আমি যে আসতে বলেছিলাম। 
আদেশের সুর কঠিন হয়ে ওঠে।
-- আমার নাচের অনুশীলন ছিল। অপরাধ স্বীকার করে মেয়েটি। 
–তোমার নাচুনী হবার স্বপ্ন না দেখলেও চলবে। ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত দেয় সরাসরি।

আবার একদিন ছন্দ হারায় মেয়েটি। ছেলেটি ফরমান জারি করে,
—নাচের ছাত্রীদের বিদায় দাও। ও কটা টাকা আমি তোমায় দেব। 
–কিন্তু নাচের ক্লাশ তো শুধু টাকার জন্যে নয়, নিজের অভ্যাসের জন্যেও দরকার। 
নিজের অবস্থান বোঝাতে চেষ্টা করে সে।
 –কি হবে ও ছাই করে, ঠিকানা তো সেই রান্নাঘর আর নার্সিং হোম।

খোঁয়াড়ের গরু কি খাবে সেটা তো একমাত্র খোঁয়াড়ের মালিকই জানে। সতর্কতার আর প্রয়োজন নেই জেনে ভবিষ্যৎ বাতলে দেয় মেয়েটির। প্রথমে একটু আমতা আমতা করে মেয়েটি। সব কিছু কেমন গোলমাল হয়ে যেতে থাকে তার। একটু একটু করে চেনা মানুষটি বদলে যেতে থাকে, অচেনা হয়ে যায়। সে বুঝে উঠতে পারে না কি বলা উচিত, কি করা উচিত। অসহায় মানুষের মত বাক্যহীন হয়ে যায় প্রথমে। ধীরে ধীরে আত্মস্থ হতে থাকে সে।

পরদিন পাখী ডাকা ভোরে বিছানা ছাড়ে সে। ঘুম জড়ানো চোখে ছাদে দাঁড়ায়। কতদিন পর সে আবার পাখী-ডাকা ভোরে ছাদে এল! মনে হয় এক যুগ। তৃপ্তির নিঃশ্বাস নেয় বুক ভরে। প্রাত্যহিকী সেরে ধূপকাঠি জ্বালে। ঘুঙুর বাঁধে ৷ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেয়। অভিমন্যু যা শেষ করতে পারেনি, সে কাজ শেষ করতে সচেষ্ট হয়। কুরুক্ষেত্র দাপিয়ে ফেরে ঘুঙুর। মনের জানালায় বিনয়ী ছেলেটা উঁকি দেয়, সুন্দর সুঠাম ছেলেটা উঁকি দেয়, উৎসাহী-উদ্যমী ছেলেটা উঁকি দেয়। যুদ্ধের দামামা বাজে ঘরময়। বাবার বেহালার সুর করুণ থেকে করুণতর হতে থাকে। মেয়েটার হৃৎপিন্ড রক্তাক্ত হতে থাকে। উদ্ধত রূঢ় ছেলেটি ভেসে ওঠে। চোখের জল বাষ্প হয়ে উবে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। তূণের তীর ধনুকে লাগায় মেয়েটি। 
ধিন-ধিন। ধাগে-তেরেকেটে। থুন-নানা। কৎ-তা।

ধাগে-তেরেকেটে। ধিন-ধাধা।....

সপ্তরথীর লোভের তীর, নিরাপত্তার তীর, কপট মুখোশের তীর প্রতিহত করতে করতে চক্রব্যুহের বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে অষ্টাদশী মেয়েটি।

নীড়, জানুয়ারী, ৯৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...