জীবন যুদ্ধ(short story)
The Battle of Life.
বাগদার চারা পোনা ধরছিল মেয়েটা। বছর তেইশ বয়স, পিঠে-বুকে আড়াআড়ি কাপড় কোমরে প্যাচ খেয়ে নেমে এসেছে হাঁটু অবধি। শক্ত-পোক্ত করে পরা যাতে জলের মধ্যে চলাফেরা করতে অসুবিধা না হয়। জট পাকানো চুলে শক্ত খোঁপা বাঁধা। মশারির মত নাইলনের তিনকোনা জাল দিয়ে নোনা নদীর কিনার ধরে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরছিল। সরু সূতোর মত পোনা, স্বচ্ছ, প্রায় চোখে দেখা যায় না। এই প্রায় অদৃশ্য প্রাণীটাই তাদের প্রাণের উৎস এখন। জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ—এ প্রবাদটা যথার্থই এ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ডাঙ্গা হলেই বাঘ থাকে না, কিন্তু বাঘের মত মানুষের অভাব হয় না, সাপের মত ছোবলের অভাব হয় না। তেমনি আক্ষরিক অর্থেই কুমীর কামটের অভাব হয় না জলে। তবু তাদের জলে নামতে হয়। আবার ডাঙ্গায় উঠতে হয়।
সেই সাত সকালে দুটো পান্তা খেয়ে জলে নেমেছে মেয়েটা। জলের এধার ওধার দু’চার পাক দিয়ে মাঝে মধ্যেই বাঁধের উপরে উঠছে। মাটির উপরে ছোট কূয়ার মত করে তার মধ্যে পোনা মিশানো জল ঢালছে। সেখানে বসে নয় বছরের ছেলেটা ঝিনুকের খোলা দিয়ে একটা একটা করে পোনা তুলে হাড়িতে রাখছে। হাড়ির মুখ ভিজা গামছায় ঢাকা।
ছেলে-নদী-বাগদার পোনা, বৃত্তের মধ্যে চলতে থাকে মেয়েটার জীবন। সকাল সন্ধ্যে এর বাইরে আর কোন ভাবনা কাজ করে না। স্বপ্ন তো দেখেই। কিন্তু কঠিন বাস্তবে সে স্বপ্ন উড়তে পারে না। ছেলে একদিন বড় হবে, নাতি-পুতি আসবে ঘরে। সে তো অনেক দূরে। আপাতত বেঁচে থাকাটাই তার একমাত্র কাজ । নদীতে কুমির আছে, কামট আছে। যে নদী তাক প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে—সেই নদী যে কোন দিন তার প্রাণটা নিয়ে নিতে পারে। অথবা অঙ্গহানি হতে পারে। তবু তাকে নদীতে নামতে হয় আরও অনেকের মত। জীবনের হাতছানি সবার আগে।
নরম কাদা-মাটিতে পা ফেলে ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে মনের অলিতে গলিতে চলে যায় মাঝে মধ্যে। পাশের বাড়ির ঠাকুমা তাকে বলে পাষাণি। অথচ সে তো পাষাণি হতে চায়নি। কিছু না চাইতেই এগারো বছর বয়সে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। আইবুড়ো মেয়েটার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল সে ছিল বছর দশেকের বড়। শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর ঘর একদিন করেই সে পালিয়েছিল
বাপের বাড়ি। বছর দুয়েকের মধ্যে যম সদৃশ্য স্বামীর বাড়ি সে যায়নি। তারপরে তাকে যেতেই হয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ীর ভালবাসা, অনুশাসন; উঠোনের ধান, গোয়ালের গরু, উনুনের আঁচ আর স্বামীর সোহাগের মাঝেই – ছেলেটা এসেছে তার কোলে।
আর পাঁচটা বউয়ের মত বুকের দুধ ফুরোবার আগেই আরেকটা বাচ্চা এসে কোল ভরেনি তার। বাঁজা না বললেও পাড়ায় মাসিমা-খুড়িমা-ঠাকুমাদের কাছে কথা শুনতে হয়েছে। নিরক্ষর মায়ের ছেলে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখনও কোল তার শূন্য থাকে। শূন্য থাকে মেয়েটার জন্যেই। এর জন্যে স্বামীর সোহাগে বৃত্ত রেখা টানতে হয় তাকে। কাজটা সহজ হয় না একটা লেখাপড়া না জানা মেয়ের পক্ষে। হাসপাতাল থেকে যে সব দিদিরা আসে তাদের গ্রামে—তাদের সাথে গল্প করে সে।
--ভগমান যদি দেয় আমরা কি কত্তি পারি বাপু। দেবেন যিনি, বাঁচাবেন তিনি।
-শোন, একটু ভাব। আমরা, মেয়েরা না চাইলে ভগবান কখনো দিতে পারে না। ছেলে মেয়ে দুজনের মিলনেই সন্তান হয়। একা একা কেউ সন্তানের জন্ম দিতে পারে না।ভগবানও পারে না।
ভগবান যেমন সন্তান দেন না—ভগবান বাঁচানও না। মা-বাবাকেই বাঁচাতে হয়। খাওয়াতে হয়, বড় করতে হয়, লেখা পড়া শেখাতে হয়। তোমার ছেলের খাবার কি অন্য কেউ জোগাড় করে দেয়? – তা তো বোঝলাম। কিন্তুক বেটারা যদি চায় আমরা কি কত্তি পারি? আমরা তো তাগে আটকাতে পারি না।
—আটকাতে পারি, সত্যি সত্যিই পারি। আমরা না চাহলে সন্তান হবে না। শুধু একপাল জন্ম দিলেই তো হবে না—তাদের ভাল-মন্দর কথা ভাবতে হবে, তাদের লেখা-পড়া শেখাতে হবে, তাদের মানুষ করতে হবে।
পরামর্শ নেয় দিদিদের কাছে। স্বামীর সাথে আলোচনা করে। দিদিদের কথা বলে। ছেলের প্রসঙ্গে বলে। ছেলের ভবিষ্যতের কথা বলে। সম্ভবের কথা বলে, অসম্ভবের কথা বলে। জীবনটা নিয়ে একটা পরিকাঠামো তৈরি করে।
নদীর পাড় থেকে বিকট গলার আওয়াজ আসে তার কানে। সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে। হাতের জাল ছুঁড়ে অতি দ্রুত চলে আসে উপরে। হাড়িটা উল্টে আছে, ছেলেটা পড়ে আছে মাটিতে। ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে তার দেহ। দাঁতে দাঁত লেগে আছে। খিঁচুনী সারা দেহে। হতভম্ব ভাবটা কেটে যায় মুহূর্তেই।
নিজের হাত-পা-মাথা দিয়ে মাটির সঙ্গে সজোরে চেপে ধরে ছেলেকে। ওইটুকু ছেলের গায়ে অসুরের মত অত শক্তি কোথা থেকে আসে সে বুঝতে পারে না। হার মানতে মানতে সব শক্তি উজাড় করে চেপে রাখে। চোখ উল্টায়, ভয় পায় মেয়েটা। মুখে গাজলা বেরিয়ে আসে, আরো অস্থির হয়ে ওঠে মা।–ও বাবাগো.……... কে কোথায় আছগো....আমি এখন কি করি....আমার বাবার কি হল গো।.. বুঝে উঠতে পারে না কি করবে এখন। ধারে কাছে কেউ নেই। ফাঁকা নদীর পাড়ে দিন-দুপুরে ভয় তাকে নিশ্চল করে দিতে চায়। বেশ কিছু সময় ধস্তাধস্তির পর নিস্তেজ হয়ে আসে ছেলেটি। হাঁপাতে থাকে, জড়িয়ে ধরে মাকে।
তারপর বেশ কয়েকদিন আর নদীতে যাওয়া হয় না। ছেলের এ অবস্থা চলতে থাকে মাঝে মধ্যে। গাঁয়ের সবাই বলে ভূতে ধরেছে। ছোটরা বলে, বুড়োরা বলে। গুণিনের খোঁজ দেয় অনেকে। কেউ কাছের গুণিন, কেউ দূরের। সঙ্গে সত্যি থেকে সত্যিতর গল্প চলতে থাকে। শক্তিশালী থেকে মহাশক্তিশালী গুণিনের সন্ধান মিলতে থাকে। মেয়েটা সবাইকে নিরাশ করে হাসপাতালের দিদিদের সাথে কথা বলে। দিদিদের কথায় ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ওষুধ লিখে দেন। কিছু ভিটামিনের বড়ি ছাড়া কিছুই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। ‘নেই’—তাই বাইরে থেকে কিনতে বলেন। দায়মুক্ত হয়ে যান ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্মীরা। মেয়েটা দায়মুক্ত হতে পারে না। এর-ওর কাছে যায়। দু’চারজনের কাছে কিছু ধার পায়। কিন্তু যাদের দেবার সামর্থ বেশি তাদের গরীব মানুষকে ধার দেবার অক্ষমতা আরো বেশি। তাই মেয়েটার দৌড়-ঝাপ দু’চারদিনের বেশি ওষুধ দিতে পারে না। ঘরের চাল ফুরিয়ে যায়। বেঁচে থাকার দায় অনেক বেশি বলেই জাল নিয়ে আবার নদীর পাড়ে যেতে হয়। ডাক্তারি চিকিৎসা সামর্থের বেড়া টপকাতে পারে না। অগত্যা গুণিন আসে। মন্ত্র-টন্ত্র। হাতে তাবিজ ওঠে, কোমরে তাবিজ ওঠে, গলায় তাবিজ ওঠে। ছোট গুণিন থেকে বড় গুণিন। কাছের গুণিন থেকে দূরের গুণিন। সবার শ্রেষ্ঠত্বকে অসার করে ছেলেটা হেসে-খেলে, অজ্ঞান হওয়া ভূতের রোগটাকে অভ্যাসের দাস-এর মত বয়ে বেড়ায়। মায়ের মন তো মানে না। তার সামর্থের সবটুকু সে করে। ছেলেকে একদম চোখের আড়াল করে না। ছেলেকে নদীর পাড়ে বসায়। সে চিংড়ির পোনা ধরে। আর চোখে চোখে রাখে। জীবন নিয়ে একটা পরিকাঠামো সে তৈরি করেছিল। সে ভেবেছিল একগাদা সন্তানের মা যেমন সে হবে না, তেমনি তার সন্তান একটু আলাদা হবে। জমির ধান, ঘরের ভাত আর জন্ম দেবার বাইরের পৃথিবী তাকে হাতছানি দেয়। কিন্তু নোনা ঝড় সব পরিকল্পনা তছনছ করে দেয়।
চৈত্রের মেলায় যাত্রার আসর বসে দুটো নদী পার হয়ে। দল বেঁধে সব যায় যাত্রা শুনতে। ফিরেও আসে আবার। তার স্বামীও যায়। কিন্তু ফেরে না। পাঁচদিনের যাত্রার আসর ভেঙ্গে গেলেও ফেরে না। পাড়া-প্রতিবেশীদের দু’একটা কথা কানে আসে। সে বিশ্বাস করে না সে সব। কিন্তু সব জল্পনা শেষ করে আরো দু’দিন পরে বাড়িতে ঢোকে তার স্বামী। রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পাষাণ হয়ে যায় মেয়েটা। সে দেখে সোহাগের স্বামী ঘোমটা পরা এক সোহাগিনীকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। কোমরে আঁচল জড়ায় মেয়েটি। ছেলে এসে পাশে দাঁড়ায়। উনুনের উপরের টগবগ ভাতের হাড়ির আগুনটা নিভিয়ে দেয় সে। ছেলের হাত ধরে। উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে আসে। পিছন ফিরে তাকাতে ঘেন্না হয় তার।
গ্রামের বিচার ব্যবস্থা সজাগ হয়। সভার মাঝে বিনীত হয় তার স্বামী। বিনয়ের অবতার হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে। করজোড়ে গ্রামের বিচার মাথা পেতে নেবার অঙ্গীকার করে। বলে, ভুল হয়ে গেছে। বলে—আপনারা দশজনে আছেন, যা বলবেন তাই হবে। একটা ঘোরের মধ্যে ভুল করে ফেলেছি, বনবিবিকে স্বাক্ষী রেখে সিঁদুর দিয়েছি এক জনের সিঁথিতে: স্ত্রী বলে স্বীকার করেছি। এখন আপনারা যে শাস্তি দেন, মাথা পেতে নেব।
তার স্বামীর এই আত্মসমর্পণ মোড়লদের খুশী করে। সেই খুশীতে বনবিবিকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না। বিধির বিধান মেনে নেবার রায় দেয়। মেয়েটার কাছে মাথা নত করে বাড়ি ফিরে যেতে বলে তার স্বামী। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তেইশ বছরের মেয়ে।
পরের দিন বাপের বাড়ি থেকে পা বাড়ায়। স্বামীর ঘরে যায় না। হাসপাতালে দিদিদের কাছে যায়। দিদিরা নিজেরা আলোচনা করে। অবশেষে আরো এক দিদির ঠিকানা দেয়। গাঁয়ের মেয়েটা জল-কাদা পথ ভাঙ্গে। মেঠোপথ থেকে মোরাম দেওয়া রাস্তায় আসে, সেখান থেকে রাজপথে। হিতৈষী দিদির সহাযোগিতায় জেলা সদরের আদালতে সোজা পায়ে দাঁড়ায় সে। নালিশ জানায় মহামান্য বিচারকের কাছে।
বর্ষা আসে বর্ষা যায়। স্বামী মিটমাট করতে চায়। কিন্তু স্বামীর আবেদনে মন ভেজে না মেয়েটার। চার বছর পর অইনি নির্দেশে জমি লিখে দেয় তার স্বামী। ভুল করে ফেলা স্বামীর ঘরে আর কোনদিন ফেরে না।
ইতিমধ্যে জীবনের ধারাও পাল্টে যায় একটু একটু করে। বিশ্বাসী স্বামীর হঠাৎ ঘাতক হয়ে ওঠা মেনে নিতে পারে না। এত কিছুর পরও সে আর গ্রামে ফিরতে পারে না। সে ভুলতে পারেনা—ওই গ্রামেই থাকে তার সন্তানের বাপ। এই কঠিন বাস্তবকে সে এড়াতে চায়। এড়াতে চায় বলেই কাজ খোঁজে শহরে। নিরক্ষর মহিলা। শহুরে চাহিদায় কাজ সে পেয়ে যায়। বাড়ির কাজ। বিচিত্র মানুষের মুখোমুখি হয় সে। মানুষ যে এত রকম হয়, মানুষের ভাষা এত রকম হয়— সে জানতে পারে ধীরে ধীরে। কখনো নিজের প্রয়োজনে বাড়ি পাল্টায়, কখনো অন্যের কারণে বাড়ি পাল্টাতে বাধ্য হয়।
দুর্বল মনের সাথে শরীরও দুর্বল হয়। প্রায়ই অসুস্থ হতে থাকে। গৃহকর্তা সজাগ হয়। অতি সচেতনভাবে সযতনে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। অর্ধেক বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ওঠে মেয়েটি। আবার ফিরে আসে শহরে।
পুরনো বাড়িতে জায়গা না পেয়ে আবার নতুন বাড়ি। নতুন গৃহকর্তা, নতুন গৃহকর্ত্রী। অশক্ত দেহ ধীরে ধীরে পোক্ত হয়ে ওঠে। ভাল মানুষের সংসারে সেও ভাল হয়ে ওঠে। স্নেহময়ী গৃহকর্ত্রী। সুখ দুখের খোঁজ নেয়। সুখ দুখে অংশ নেয়। সেই সাহসেই মেয়েটি তাদের গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। চৈত্রের মেলা দেখার অমন্ত্রণ। স্নেহময়ী গ্রহণ করে সে অমন্ত্রণ। চৈত্রের মেলায় হাজির হয় নোনা জলের গাঁয়ে।
মাকে কাছে পেয়ে আঁচল ছাড়তে চায় না ছেলেটি। মায়েদের সাথে মেলায় যায়৷ বাঁশি কেনে। গ্যাস বেলুন কেনে। মেলা থেকে ফিরে আসতে আসতে গ্যাস বেলুনটি হঠাৎ আলগা হাত থেকে বেরিয়ে যায়। কুঁকড়ে মাটিতে পড়ে। বেঁকে যায় শরীর, দাঁতে কপাটি লাগে। খিঁচুনী ওঠে সারা দেহে। গ্যাঁজলা বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে। অভ্যস্ত হাতে মা সামলায়। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে স্নেহময়ী। করুণার ধারা নেমে আসে। সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ছেলের জামা-প্যান্ট গোছাতে গোছাতে আশায় বুক বাঁধে মা। আর তুক-তাক্ নয়। এবার বড় শহরের বড় ডাক্তারের চিকিৎসা পাবে ছেলে। তার একমাত্র সন্তান আবার ভাল হয়ে যাবে। সে আবার স্কুলে যাবে। মানুষ হবে। স্বামীর অমানবিক ব্যবহারের জবাব দেবে ছেলেকে দিয়ে। ভাবে সে। এবং শহরে আসে ছেলেকে নিয়ে।
আন্তরিকতার অভাব থাকে না স্নেহময়ীর। পরিবারের একজনের মতই ছেলেটাকে রাখেন। ডাক্তার দেখান। ওষুধ কেনেন। ভাল ডাক্তারের জন্যে ভাল ফি দিতে হয়। ভাল ওষুধের জন্যে ভাল পয়সা ব্যয় হয়। কঠিন একটা রোগকে ভাল করতে ভাল সময় লাগার কথা বলেন ডাক্তার। ভাল ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনের কথা জেনে যান স্নেহময়ী। স্নেহের রসদের কথা ভাবেন।
দু’চারদিনের মধ্যেই আগ্রহে টান ধরে গৃহকর্ত্রীর। অন্যকাজে বড় বেশি জড়িয়ে পড়েন তারা। ডাক্তার দেখাবার সময় পান না। ছেলের খবর নেবার সময় পান না। মেয়েটি বুঝতে পারে তাদের মানসিকতা। ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় সময়ের লেখা পড়তে পারে। জোড়া লাগা আশায় ফাটল ধরে আবার। পাশের বাড়ির কাজের বুড়িটা এক সাধুর খোঁজ দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের অবসরে ছেলেকে নিয়ে সাধুর কাছে যায়। গ্রাম থেকে আসবার সময় ছেলের হাত থেকে, কোমর থেকে, গলা থেকে সমস্ত তাবিজ সে খুলে ফেলে দিয়েছিল নদীর জলে। সেই হাতে আবার তাবিজ ওঠে। কোমরে তাবিজ ওঠে। গলায় তাবিজ ওঠে। তার ছেলে হাসতে থাকে ; খেলতে থাকে। তারই মাঝে কখনো ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, মাটিতে পড়ে ধনুকের মত বেঁকে যায়। সর্বাঙ্গে খিঁচুনী আরম্ভ হয়, মুখে গ্যাঁজলা আসে। ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটির দিকে চোখ যায়। পরিত্রাতা দেবতার ছবি। হাসি মুখে তাকিয়ে। তার একমাত্র সন্তান, আশা-ভরসা এখন মৃত্যুর মুখে মাটিতে। দেবতা হাসছে দেওয়ালে। চোখে জল আসে না মেয়েটির। হাসি মুখের দেবতার ক্যালেন্ডারটা মুহূর্তে এক টানে ছিঁড়ে ফেলে, টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়। কোমরে আঁচল জড়ায় শক্ত করে। চোয়াল শক্ত করে ঝুঁকে পড়ে ছেলের দিকে। বিড় বিড় করে সে—
—ঘাবড়াস্ না বাপ। মুখের ফেনা মোছে আঁচল দিয়ে।
—তোকে আমি ভাল করবোই। দাঁতের ফাকে ভিজে ন্যাকড়া গুঁজে দেয় যাতে দাঁতের চাপে জিভ না কেটে যায়।
—তোর বাপ যদি যাত্রার মাগীর জন্যে সব খোয়াতে পারে, তোর জন্যে আমি কেন পারব না? পারব-পারব—কি হবে ছাই যক্ষের ধন রেখে?......... তোর জন্যে আমি সব দেব...... যত কষ্টই হোক...... ভাল ডাক্তার দেখাব...... ভাল তোকে করবই।.....
ঝাপসা চোখ কচলিয়ে পরিষ্কার করে। আরেকটা যুদ্ধ জয়ের জন্যে প্রস্তুতি নেয় ছেলের মা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন