(A short story on divided Bengal)
“আল্লা, মেহেরবান! তুমি আমারে ক'য়ে দাও—কোনডা আমার দ্যাশ। তোমার বানানো এই জমিনে ক’নে এট্টু শানতিতি থাকতি পারব....” নামাজ শেষে ডুকরে কেঁদে ওঠে বুড়ো। কাঠফাটা রোদে গাছতলায় বসে নামাজ পড়ছিল। বয়সের হিসাব নেই তার। ন্যাড়া মাথা, দাঁতগুলো ঝরে গেছে। রোগা দেহ। ছেঁড়া গামছা পেতে নামাজ পড়ছিল সে।
ঠিকানা নেই বুড়োর। অথচ মেহেরবান আল্লা পয়দা করেছিলেন যখন, ঠিকানা তার একটা ছিল বৈকি। এই বাংলায়-ই। সে ঠিকানায় কোন পূব ছিল না, পশ্চিম ছিল না। পূব পশ্চিমের মাঝে কোন সীমানাও ছিল না। এক আধা গঞ্জে তাঁর জন্ম। বাপের ছিল ছোটখাট ব্যবসা। পাটের ব্যবসা, তিলের ব্যবসা। মরশুমে কিনে জমাত। আবার সুযোগ বুঝে পাইকারী বিক্রি করে দিত সব।
অনেকগুলো দিদির পর জন্মেছিল বুড়ো। খুশীর জোয়ার বয়েছিল দাদা-দাদী নানা-নানীদের মধ্যে। সবার মধ্যে। সেই খুশীর আমেজেই এক এক করে সাদি হয়ে গেল সব কটা দিদির। একসময় ধূমধাম করে বিবি এল তার ঘরে। আবার বাপ হতেও সময় লাগল না তার।
এই সময়ে কি সব ওলট পালট হয়ে গেল। তাদের দেশটা নাকি আর তাদের নেই। ভাগ হয়ে গেছে সেটা। দেশের মধ্যে সীমানা তৈরি হয়ে গেছে। শুধু
সীমানাই তৈরি হয়নি—তাদের পরিচয়ও পাল্টে গেছে। তারা আর বাঙালী নেই—মুসলমান এবং পাকিস্তানী।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা হল। বাপ নির্বিকার। খুন-জখম হল। ভয়ে মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। বাপ অনড়। এ মাটি তার, তার বাপের। তার পূর্বপুরুষের। এ মাটি ছেড়ে সে যাবেনা। কারা কোথায় বলল—এ দেশ তার নয়, সে কথা মানবে কেন? তার সারা জীবনের ঘাম, আশা—এই মাটিকে ঘিরেই। সে এটা ছাড়বে না, কিছুতেই না।
দেশ ভাগ হ'ল। এদেশ থেকে মানুষ গেল। ওদেশ থেকে মানুষ এল। দাঙ্গা থিতিয়ে এল। বুড়োর বাপ কিন্তু ভিটে ছাড়ল না। তারপর এল একটা রাত। যে রাতটার কথা সে ভুলতে পারে না। যে রাতটা তার সারা জীবনের হিসেব নিকেশ তচনচ করে দিয়েছে।
বাপ শুয়ে পড়েছিল। শুয়ে পড়েছিল মিয়া-বিবিও। এমন সময় কিছু মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি কানে এল। ক্রমশ সেটা বাড়ল। বাড়তে বাড়তে একসময় জোর ধাক্কা মারল তাদের সদর দরজায়। বেদম ধাক্কা, গালি গালাজ। মানুষেরই তবে অন্য রকম মানুষের। ভয়ে কুঁকড়ে গেল বুড়ো। বুড়োর বাপ কাশতে কাশতে বিছানা ছেড়ে এল বারান্দায়। বুড়ো তার বাপকে চিৎকার করে বলল—দরজা
খুল না—আব্বা।
ওর ভয়ার্ত আবেদনে সাড়া দিল না তার বাপ। এগিয়ে গেল, দরজা খুলল। হুড়মুড়িয়ে ঢুকল কিছু উত্তেজিত মানুষ। অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে আদেশ করল—বাঁচতে চাস্ তো বেরিয়ে যা এখুনি। বাপ সামনে দাঁড়াল তাদের।
দুহাত তুলে বলল—'চলি যাও তোমরা। এ বাড়ি আমার, আমার বাপের, আমার
চোদ্দ পুরুষের। এ ভিটে অমি ছাড়বনি। কোন মতেই না। পরান থাকৃতি না, চলি যাও তোমরা—চলি যাও—” উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল বাপ।
কিন্তু বুড়োর বাপের গলার জোর থেকেও ওদের গলার জোর আরো বেশি। তাই ঢাকা পড়ে গেল তার বাপের গলা। বাপকে জোের ধাক্কা দিল একজন। বারান্দার থামের উপর আছড়ে পড়ল বাপ। লুটিয়ে পড়ল....আল্লা বলে। জ্ঞান
হারাল। সে জ্ঞান আর ফিরল না। নিজের বাপের ভিটে থেকেই সোজা চলে গেল আল্লার দরবারে।
ঠিকানা বদলাল বুড়োর। বিবি ছেলেকে নিয়ে উঠল গাঁয়ের এক আত্মীয়ের বাড়ি। পরের জমিতে আস্তানা গড়ে উঠল নতুনভাবে। কিন্তু নতুন আশায় বুক বাঁধতে পারল না। সব খুঁইয়ে কোন রকমে দিন গুজরান করতে লাগল। তার প্রতিদিনের দীর্ঘশ্বাসে জড়িয়ে গেল একটা দ্বন্দ্ব—এদেশ তার নয়, অথচ এটা তার বাপের দেশ, এটা তার জন্মভূমি!
ছেলে বড় হয় ধীরে ধীরে। বায়না ধরে পাকিস্তানে যাবার। শুধু বায়নাই ধরে না—একসময় কিছু বন্ধুর সাথে চলেও যায়। সে-ই কয়েকমাস পরে আবার ফিরে আসে আরো বড় স্বপ্ন নিয়ে। এবার নিয়ে যাবে সে তার বাবা-মাকে। সেই স্বপ্নের দেশে–যে দেশ একেবারেই তাদের, মুসলমানদের। মুসলমান হিসাবে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পারবে সেখানে। পরের দয়ায় থাকতে হবে না।
ছেলের আব্দারের কাছে পরাস্ত হয় বুড়ো। হারানো আশা ফিরে পেতে চায় সে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে—কিন্তু বাপ, সেখানে গেলে খাব কি? থাকব কোথায়?
সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বন্ধুর চাষের অনেক জমি। উত্তর দেয় ছেলে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুড়োর। আরেকটা নতুন ঠিকানা। আরো একজন মানুষের কাঁধে চেপে।
বুড়ো চলে নতুন আস্তানায়। নতুন কিছু মানুষের সাথে আলাপ হয় তার। তবে কিছুই নতুন লাগে না। নতুন মানুষগুলো কথা কয় তারই মত, একই ভাষায় ৷ দিনে পাঁচবারই নামাজ পড়ে তাঁরা। কিন্তু সবাই নয়। কারণ মুসলমানের পীঠস্থান
পাকিস্তানে সবাই মুসলমান নয়। সন্ধ্যায় উলুধ্বনি ভেসে আসে গাঁয়ের কোন কোন ঘর থেকে। মন্দিরে ঘণ্টা বাজে, দূরে দেখা যায় গির্জার চূড়া।
কখনও একাকী নির্জনে ভাবনায় পেয়ে বসে বুড়োর। মন্দির-গির্জা-মসজিদ সে তো এখানেও আছে, ওখানেও ছিল। ওখান থেকে সবাই তারা চলে আসে নি, এখান থেকেও সবাই ওখানে চলে যায়নি। এখানে হিন্দু যারা রয়ে গেছে— তারা কিভাবে বেঁচে আছে? সে কি তার মতই—যেমন সে ছিল ; ভয়ে আশাহত হয়ে? এরা যদি এদের জন্মভূমি আঁকড়ে থাকতে পারে, যেমন আরো
অনেকে ওখানে রয়ে গেছে, সে কেন পারে না? সে কেন চলে এল তার বাপের ভিটে ছেড়ে?
ধর্ম পেটের ভাবনা থেকে নিস্তার দেয় না। সেটা বুঝতে পারে বুড়োর ছেলেও। দিন-রাত ধান্দায় ঘোরে সে। ইতিমধ্যে সংসার বেড়েছে তার, আর
বেড়েছে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। মুক্তির আশায়, বাঁচার তাগিদে, ছেলের পিছু পিছু আবার সীমানা পেরোয় বুড়ো। আবার সে পা রাখে তার বাপের, তার ছেলের জন্মভূমিতে। বুক ভরে জন্মভূমির বাতাস নিতে নিতে বুড়ো বহু দূরের, ভিন রাজ্যের ঝুপড়ির বাসিন্দা হয়ে যায়। আরো একটি নতুন ঠিকানা। নির্বাসিত মাতৃভাষার মধ্যে বেড়ে ওঠে তার সন্ততিরা।
সংসার চলে যায় ভালোই। খাবার জোটে দুবেলা। ছেলে কাজ করে, ঘরের বউও কাজ করে ধনী লোকের বাড়িতে। লায়েক হয়েছে নাতি। সিনেমার হিরো সেজে ঘুরে বেড়ায়। কাজ কিছু একটা করে সেও—তবে কি কাজ বুড়ো জানে না। কথা শুনে মনে হয় সে তার মায়ের ভাষাটা ভুলেই গেছে। একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছে। তাই বাজিয়ে ধাই-ধাই করে নাচে ঘরের মধ্যে, আর এইভাবে নাচতে নাচতেই একদিন নাত-বৌ ঘরে তোলে সে।
পাকা দাড়ি আর টাক মাথার কথা ভাবতে ভাবতে বুড়ো ভুলেই গিয়েছিল নিজের পরিচয়। সে ভাবছিল সাড়ে তিন হাত জমির কথা। যেখানে সে শোবে শেষ বারের মত, তারপরে চলে যাবে আব্বা আম্মার কাছে।
কিন্তু সে ভাবনায় ছেদ পড়ল বুড়োর। চাঁপা গুঞ্জন সরব হ’ল একসময়। আবার সে চিহ্নিত হয়ে গেল ‘মুসলমান' হিসেবে। শুধু মুসলমান নয়, সঙ্গে আরো
একটি নাম—‘অনুপ্রবেশকারী'। তার জন্মভূমিতেই সে অনুপ্রবেশকারী !
ধর্মনিরপেক্ষতার পোষাকে বুলডোজারে চড়ে বসল প্রশাসন। হঠাৎ ঝুপড়ি গেল গুঁড়িয়ে। তার আদরের নাতিটা কাজ থেকে বাড়ি ফেরেনি তখনো। তাকে ছেড়ে পুলিশের গুঁতো খেয়ে গাড়িতে উঠল সবাই। খালি হাতে, তিনদনি পরে—আরো গাড়ি পাল্টে, আরো অনেকের সাথে, আবার তারা চলে এল সেই সীমানায়, স্বদেশের সীমানা, যা বুড়ো এর আগে দু’বার পেরিয়েছে।
চিহ্নিত সীমানা পেরোতে হ’ল চিহ্নিত হয়েই। দাগী চোরের মত সমস্ত বেটা ছেলেদের মাথা অর্ধেক কামিয়ে সীমানার ওপারে ঠেলে দিল প্রশাসন। বাচ্চা বুড়োর আঁকড়ে রাখা শেষ সম্বল কাঁথা-কম্বল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে জ্বালিয়ে দিল আগুনে।
বন্দুকের বাঁটের খোঁচায় ‘দেশ’ পেরিয়ে ‘দেশে’ ঢুকতে গেল বুড়ো, বুড়োর দল, কিন্তু কিছুটা এগিয়েও ‘দেশে’ ঢুকতে থমকে দাড়াতে হ’ল তাদের। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকদল বন্দুকধারী—একেবারে পিছনে ফেলে আসা ওদের মত, কেবল পোষাক একটু আলাদা। বন্দুক উঁচাল তারা। এদেশও তাদের নয়— অবাঞ্ছিত তারা।
কেটে গেল চারটে দিন। অনাহার, অনিদ্রায়, খোলা আকাশের নিচে পড়ে রইল তারা। একদিকে স্বদেশ—অন্যদিকে স্বধর্মের দেশ,—অথচ কোন দেশেই
ঢুকবার অধিকার নেই তাদের। মাঝখানের আমবাগান-কলাবাগানের সামান্য একটু জমি, যা সরকারি ভাষায়—'নো ম্যানস্ ল্যাণ্ড’। তার গাছ তলায় ছেঁড়া গামছা পেতে দিনরাত আল্লার দরবারে করুণ আর্জি জানাচ্ছে বুড়ো—
আল্লা মেহেরবান! তুমি আমারে ক’য়ে দাও—কোনডা আমার দ্যাশ? তোমার বানানো
এই জগতে ক’নে এট্টু শানতিতি থাকৃতি পারব........?
নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর, '৯৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন