রবিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৫

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটাতে মন চায় না। তাই জরুরি ভিত্তিতে গেলাম লবনহ্রদের মণিপাল হাসপাতালে। পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষে যখন হৃদয়ের চিন্তা হালকা হলো বাড়ি ফিরতে লিফটে উঠলাম। আমি লিফট থেকে বেরোচ্ছি - লিফটে উঠতে যাচ্ছে কবী ( শ্রদ্ধেয় কণিকা বিশ্বাস ও বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের ছেলে) । জল ছলছল চোখ। ওর লিফটে ওঠা হলনা। আমার তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফেরা হলনা। হার্ট হালকা ছিল, হৃদয় ভারি হল। কবী কান্না চেপে বললো - অলৌকিক ! কি অলৌকিক ঘটনা! মা হয়তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে ! মা - মানে কণিকা বিশ্বাস, আলোর পথিক বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সহধর্মিনী , সহযোগী। আবার লিফটে উঠলাম। বৌদি শুয়ে আছেন, একা। নাকে নল। শ্বাস উঠছে - পড়ছে। এই প্রথম বললেন না, আয়, বোস। তিনি অচৈতন্য। আমার অপেক্ষায় যিনি আছেন, তিনি আমাকে দেখলেন না। তার কিছু পরে তাঁর শ্বাস ওঠা - নামা বন্ধ হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গড়লেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সরকারের একমাত্র হিন্দু মহিলা সাংসদ কণিকা বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হলেন, দেশ ছেড়ে চলে এলেন পশ্চিমবঙ্গে। দেশ ছাড়লেন কিন্তু মানুষের পাশ ছাড়লেন না। দেশভাগের বিষাক্ত ব্যবস্থায় ছিন্নমূল অসহায় উদ্বাস্তু মানুষের জন্য বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের অকাল মৃত্যুতে তাঁর অপূর্ণ কাজের দায় কাঁধে নিয়ে জীবন কাটাবার ব্রত নিলেন কণিকা বিশ্বাস। আজীবন সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। মৃত্যুর কয়দিন আগেও তাঁকে চিন্তিত দেখেছি উদ্বাস্তু মানুষের নাগরিকত্বের যন্ত্রণায়। সাহিত্যিক কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর লিখছেন : " সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা কেবল তাঁর নিজের পরিবারের নন, তাঁকে ঘিরে থাকা সমাজ বৃত্তের, এমনকি একটি গোটা দেশেরও। তাঁদের উত্থান-পতন, সাফল্য ও ব্যর্থতার সঙ্গে মিশে থাকে একটি সমাজ বা জাতির সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাস। তেমন মানুষ সচরাচর মেলে না, মিললেও, ইতিহাস চেতনার অভাবে জীবদ্দশায় তাঁদের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ণ আমরা করে উঠতে পারি না। আমাদের জীবন-সীমায় আমাদেরই ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে এমনই একজন মানুষ ছিলেন-বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। তাঁর অকাল প্রয়াণের পর, তাঁর জীবন-সংগ্রামের এক স্বর্ণোজ্জ্বল সময়ের সহযোদ্ধা, তাঁরই জীবনসঙ্গিনী ও আদর্শের অনুসারী শ্রীমতী কণিকা বিশ্বাস আরও চল্লিশটি বছর থেকে গিয়েছিলেন আমাদের মধ্যে। বীরেন্দ্রনাথকে হারিয়ে এক অস্থির ও ভঙ্গুর সময়ে ছিন্নমূল সমাজের কল্যাণব্রতী মানুষেরা নিরুপায় হয়ে তাঁরই চৌম্বক বিন্দুতে সম্মিলিত থেকে নিজেদের কর্মধারাকে সংহত ও প্রসারিত করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে যতই ভেঙেচুরে যান, আমৃত্যু শ্রীমতী কণিকা বিশ্বাস মহীরুহের মতো নিজেকে প্রসারিত করে, সমস্ত কল্যাণকর্মে সকলকে প্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। " "... কণিকা বিশ্বাস আওয়ামী লীগের ছাত্রনেত্রী হিসেবে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল রাজনীতিতে নজর কেড়ে পৌঁছে যান ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনের দাবি নিয়ে স্ফুটমান জাতীয় গণমুক্তি দল গঠনের মঞ্চে। রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে তাঁর উত্থানের সম্ভাবনাকে নিষ্কণ্টক করতে সমাজনেতারা মহান শিক্ষাব্রতী ও জননেতা বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁকে মিলিয়ে দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একান্ত ইচ্ছায় একমাত্র হিন্দু মহিলা সাংসদহিসেবে তিনি মনোনীত হন। মুজিবোত্তর কালে ভারতে আশ্রয় নেবার পর ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের পাশে দাঁড়ান, সাহায্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। জনতা সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সে ভাতা বন্ধ হয়। তাঁদের সাক্ষী হতে হয় মরিচঝাঁপিতে পুনর্বাস গড়ে তোলা স্বজন উদ্বাস্তুদের ট্রাজেডির। অব্যবহিত পরেই বীরেন্দ্রনাথের প্রয়াণ। ভারতীয় বাস্তবতায় ছিন্নমূল ও দলিত সমাজের মুক্তির আকুলতা নিয়ে তিনি যুক্ত হন মান্যবর কাঁশিরামজীর সঙ্গে। ২০০৩ সালের মুখ্যত বাঙালি উদ্বাস্তু সংহার আইন তাঁর সামনে যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তিনি তাঁর বৃত্তের মানুষদের উজ্জীবিত করতে থাকেন সেই সংগ্রামে। " (আমার ছোট্ট জীবন। কণিকা বিশ্বাস। সম্পাদনা - কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর।) মতুয়া বাঙালির পীঠস্থান ওড়াকান্দি। হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের লীলাভূমি। সেই বাড়ির পাশের বাড়ির মেয়ে কণিকা বিশ্বাস। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেন। তারপর পড়ার মত মেয়েদের স্কুল ছিল না। কিন্তু জেদি মেয়ের পড়াকে কেন্দ্র করে বয়েজ স্কুল পরিবর্তন হয় কো - এডুকেশনে। সে এক ইতিহাস। ঘটনাবহুল কলেজ জীবন রামদিয়া কলেজে যা ছিল বাড়ির কাছেই। তারপর রাজনীতির মাঠে। সেই মাঠেই আলাপ গণমুক্তি দলের প্রতিষ্ঠাতা - নেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মের প্রাক মুহূর্তে, ১৯৭০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। আমি তখন স্কুল ছাত্র। স্কুলের কাছেই এক নির্বাচনী সভা। গণমুক্তি দলের প্রার্থী কার্তিক ঠাকুর। সে সভায় বক্তৃতা দিতে ওঠেন এক গৃহবধূ। লাল পাড় সাদা শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে কোন ঘোমটা ছিল না। তারপর দেখেছি ভারতের বাংলায়। সাদা শাড়ি তবে লালপাড় নয়। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মতই সমাজসেবায় মগ্ন থেকে অযত্নে অবহেলায় চলে গেলেন বীরেন্দ্রনাথ। দুটি অসহায় শিশু নিয়ে একা হয়ে গেলেন কণিকা বিশ্বাস। তিনি আমার বৌদি। কিন্তু আমাদের সবার কাছে, যাঁরা শত ভাগে ভাগ হয়ে আছি, স্নেহশীল মায়ের মত, সবার শীতল আশ্রয়। সে আশ্রয় হারিয়ে গেল কালের আবর্তে।।

শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

সম্পর্কের গাঁটছড়া

সমুদ্রে কিছু ছুঁড়ে দিলে তা আবার ফিরে আসে, লোকে বলে। তেমনি ফেলে আসা অতীত হঠাৎ ফিরে এলো। স্মৃতির ফাঁকে এক চিলতে আলো। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে একটা ছেলে এলো আমার ঘরে। আমি তখন বোহেমিয়ান জীবনের পাঠ নিচ্ছিলাম। অগোছালো ঘর, ছন্দহীন, তার মনে হয়েছিল। এমন অনেকেরই মনে হতো - অগোছালো ঘরে অগোছালো জীবন, যা ছিল আমার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। অল্প আলাপেই সে আমাকে বলল Dearest Dadu. Dearest হয়ে গেলাম dear হবার আগেই। সে তখন কৈশোর পেরোচ্ছে। বললাম, এ দেশে এসে কলকাতার কি ভাল লাগলো তোমার ? অকপটে সে সহজ সরল উত্তর দিল- কলকাতার মেয়েদের দিকে তাকালে আমার বুক ধরফর করে। যাবার আগে সটান গেল আমার বড়দার সামনে। বড়দা- যাকে আমরা অত্যন্ত সমীহ করতাম এবং ভয় পেতাম , সেই বড়দাকে প্রশ্ন করলো, গৌতম দাদুকে এতো অবহেলা করো কেন ? দাদা হতচকিত। সে যেন নির্দেশ দিয়ে বলল- আর অবহেলা করবে না। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী সে। তার জানার আগ্রহে সবাই অস্থির। নাম তার নিউটন। হয়তো তার মা বাবা চেয়েছিল ছেলে বড় হয়ে নিউটনের মত বিজ্ঞানী হোক। কি হয়েছে এখনো জানিনা। তবে সাড়ে তিন দশক পেরিয়ে হঠাৎই তার ফোন পেলাম আমেরিকা থেকে। অজ গাঁয়ের ধূলো কাদা মাখা ছেলেটা এখন আমেরিকা ! আমেরিকার বাসিন্দা। তিন সন্তানের বাবা। তার ঘরনী মেম সাহেব। মেম সাহেব বাংলা জানেন না। আমি বাংলা ছাড়া ঠুটো জগন্নাথ। বুঝলাম নাতবৌয়েরসাথে আমার পটবে না। আমার রাধা নাচবে না। একটানা প্রায় দুই ঘন্টা কথা বললো। মূলত সে ই বললো, আমি একনিষ্ঠ শ্রোতা। মেধাবীরা যখন মেধা কাজে লাগায় তখন কোন একটা বিশেষ অবস্থানে আটকে থাকে না। বুদ্ধিমত্তার সব শাখায় অবাধ বিচরণ করে। যেমন ড. বি আর আম্বেদকর, ড. মেঘনাদ সাহা। আমাদের আলাপচারিতায় উঠে এল বিজ্ঞান- ইতিহাস- ভূগোল- আইন - অর্থনীতি- ধর্ম..... সমস্ত বিষয় , সমস্ত কিছুতেই তার অবাধ যাতায়াত। যদিও আমি আনপড়। আমার বিশেষ উৎসাহ আছে নিজের শিকড় নিয়ে, বাংলার আদি জনজাতি নিয়ে, প্রাগৈতিহাসিকতা নিয়ে। এই স্বল্প সময়ে সে বেশকিছু তথ্য জানাল যা আমাকে উৎসাহিত করেছে। যেমন হরপ্পা সভ্যতার লিপির আজও পাঠোদ্ধার করা যায়নি কিন্তু পাঠোদ্ধার করতে না পারলেও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে হুবহু হরপ্পা/ ইন্দাস ভ্যালীর লিপির সন্ধান দিল যা চমকপ্রদ। যদিও সেই আদিম মানুষের উত্তরসূরী থাকলেও এখনও পাঠ উদ্ধার করা যায়নি। ছবি..... যদি একটু ইতিহাস- ভূগোল ঘাটি তবে দেখবো - দক্ষিণ গোলার্ধের দক্ষিণ মহাসাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপ Rapa Nui বা Easter Island. চিলির অধীন। চিলি থেকে 3500 কি মি দূরে। নিকটবর্তী মানুষের বাস 1900 কি মি দূরে Pitcairn Island. ত্রিভুজ আকৃতির ভূখণ্ড। আয়তন 165 বর্গ কিলোমিটার । জনসংখ্যা মাত্র ছযহাজার। তার মধ্যে আদিম মানুষের সংখ্যা অর্ধেকের কম। আদিম ভাষা রাপা নু ই (Rapa Nui) যা আকতেঁ পারে কিন্তু লিপি পাঠ জানেনা। ফলত ইন্দাস ভ্যালীর ভাষার যে পরিনতি তাদেরও তাই। আর সরকারী ভাষা স্প্যানিশ। তথ্য বলছে, 300( খৃঃ) বছর থেকে রাপাদের অবস্থান ঐ দ্বীপ বা পাহাড় চূড়ায। তাহলে ইস্টার আইল্যান্ডের আদিম মানুষের লিপি আর ইন্দাস ভ্যালীর লিপির মিল হয়েছিল কি করে? কোন যুক্তির উপর নির্ভর করে এটা হতে পারে ? ইন্দাস ভ্যালীর সভ্য মানুষ কি সেখানে গিয়েছিল ? কিভাবে গিয়েছিল ? 300AD তো সময়ের নিরিখে সেদিনের ব্যপার। তখন সমুদ্র আর বরফ যুগের মত শুকনো নেই যে হেটে হেটে চলে যাবে ! আবার হরপ্পা তথা ইন্দাস ভ্যালীর ব্যপ্তি ছিল 3300 খৃষ্ট পূর্ব থেকে 1300 খৃ: পূ: পর্যন্ত। অথচ তার 1600 বছর পরের ইস্টারদের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল কীভাবে ? সম্ভবত- ১) লিপির মিল কাকতালীয়। যেমন, অনেক সময় দুইজন মানুষকে হুবহু এক রকম দেখতে পাই অথচ কোন কারণ খুঁজে পাইনা। এটাও তেমনি। আদিম মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তা ভাবনার সাদৃশ থেকে লিপির গঠন হয়েছে। অবশ্য কাকতালীয়তার পিছনেও কার্যকারণ থাকে। বর্তমান মানুষের আদি ছিল আফ্রিকায়। সুদীর্ঘ জীবন - পথে নানা বাঁক। জিন সমস্ত বৈশিষ্ট গেঁথে রাখে মালায়। সে বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটতে পারে জীবনের যেকোন পর্যায়ে। ২) সূদুর অতীতে যাঁরা ইন্দাস ভ্যালীতে সভ্যতার বিকাশ ঘটিযেছিল তাদেরই আত্মীয়রা তুষার যুগের প্রাক্কালে পৌঁছে গেছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয অঞ্চলে , যেমন আফ্রিকার আদিম মানুষেরা ছড়িয়েছে সমগ্র পৃথিবীতে। আমাদের হাতে আছে তথ্যের ভান্ডার। যখন খৃষ্টপূর্ব 1300 এবং 300 খৃষ্টাব্দের বছরের সমাধান হবে, তথ্য পরিণতি লাভ করবে ইতিহাসের। আশাকরি বিজ্ঞান একদিন বাস্তবের সন্ধান হাজির করবে জনমানসে। ।

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

ধর্মের জন্য

শুধুধর্মের জন্য মানুষ মরছে গাজায়, শুধু ধর্মের জন্য মানুষ মারছে প্যালেস্টাইনে শুধু ধর্মের জন্য মানুষ মারছে ইসরাইলে শুধু ধর্মের জন্য মানুষ মেরেছে হিটলার শুধু ধর্মের জন্য মানুষ মারছে পাকিস্তান শুধু ধর্মের জন্য মানুষ মারছে বাংলাদেশ আমরা ধার দিচ্ছি দাঁতে নখে শুধু ধর্মের জন্যে। English: JUST FOR RELIGION People are dying in Gaza just for religion, People are killing in Palestine just for religion, People are killing in Israel just for religion, Hitler killed people just for religion, Pakistan is killing people just for religion, India is killing people just for religion, Bangladesh is killing people just for religion, We are lending tooth and nail, Just for religion.

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫

হে সিঁধুসারস : এক কাব্যিক নাটক

রবিবার , ০৯.১১.২০২৫, একাডেমিতে থিয়েটার দেখলাম। ইচ্ছে থাকলেও সচরাচর থিয়েটার দেখা হয় না, বেছে নিতে হয়। এদিনের নাটক দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মূলত নাম দেখে। হে সিন্ধুসারস। কাব্যিক উচ্চারণ, কবি জীবনানন্দ থেকে। নামেই মনে হয়েছে উপত্থনাও হবে কাব্যিক। দ্বিতীয় কারণ, সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় আমি ইতিপূর্বে দেখিনি। সেঁজুতিরা বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজে প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমাদের বিদায় জানিয়েছিল। তখনই অভিনেত্রী হিসেবে ওর নাম জেনেছিলাম। এই দুই আগ্রহ নিয়ে যাই একাডেমিতে। এক ভাললাগা নিয়ে হল থেকে বেরিয়েছি। প্রথম অর্ধেকে উসখুস দেখেছি আশেপাশের দর্শকদের মধ্যে। নাটকের নেপথ্য কাহিনী। ভাবনা চিন্তা। শিক্ষণীয়। শুধু নাট্যারসিকদের জন্যে নয়, সৃষ্টিশীল কাজে যাঁরা থাকে তাঁদের জন্যেও। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। বিদেশী নামে তালগোল পাকাচ্ছিল। আমার ব্রেখটের কথা মনে আসছিল। মনে হচ্ছিলো তাঁর ভাবনার প্রয়োগ। যদিও আমি ব্রেখটের কোন নাটক দেখিনি, পড়েছি মাত্র। বিরতির পর আমাদের সারিতে পাঁচ আসন ফাঁকা হয়ে গেল। বুঝলাম তাঁদের উসখুস ভাল না লাগার ছিল। দ্বিতীয় বা শেষ অংশ নাট্য ভাবনার পূর্ণরূপ। মঞ্চ পরিকল্পনা, আলো, আবহ সঙ্গীত, অভিনয় - সবই অসাধারণ ! কাব্যিক ! হল থেকে বেড়িয়ে হাঁটছি - একজন বয়স্ক মহিলা তাঁর সঙ্গীকে বললেন - ক্লাসিক থিয়েটার। আমি বিশারদ নই, অনুভূতি বলতে চেষ্টা করলাম।

সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৫

পঞ্চাশ বছর পর

50 bochhor por.. পঞ্চাশ বছর পর একজন মানুষকে দেখতে গেলাম, কয়েকজন মানুষ দেখলাম। সেদিনের ফুটফুটে পরীর মত মেয়েটি এখন বুড়ি হয়ে গেছে, সেদিনের প্রানচঞ্চল অষ্টাদশী এখন চোখে ঝাপসা দেখে, কানে শোনেনা, কোমর বেঁকে গেছে। স্মৃতি চড়ায় গভীরতাহীন। হাতড়ে হাতড়ে যখন তল পায় তখন চোখের কোনে জল। শহর কলকাতা থেকে কতটুকু পথ? সাকুল্যে সময় লাগলো আড়াই ঘন্টা- অথচ এই পথ পেরোতে কেটে গেল পঞ্চাশ বছর! সব দায় কী নাগরিক জীবনের ? অবসর জীবনে কল্পনার জগত যখন ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে তখন মন উতল হলো পরেশকে দেখার জন্য। বাল্য কৈশোরের খেলার সাথী। থাকে নদিয়া জেলার বগুলায়। পরশুর হিসাব মেলেনা তাই কাল যাব ভাবলাম। পরের দিন চেপে বসলাম গেদে লোকালে। দিন বারটায় পৌঁছে গেলাম বগুলা। কিন্তু কোথায় থাকে? কোন গ্রামে ? মনে করতে পারছি না। এক বন্ধুকে ফোন করে পেলামনা। আরেকজন জানে না। আরেকজনকে বলেও না পেয়ে এক পরিচিতের বাড়ির দিকে হাঁটলাম। ঠা ঠা রোদ্দুরে মাইলদেড়েক হেঁটে গ্রামের নাম জানতে পারলাম। আবার খানিক হেঁটে অটো রিকশা। আমার গন্তব্য সাহাপুর। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে ঘর ছিল কানাইদার। পাড়ার একমাত্র দর্জি। ডাক নাম কেনাই। আমার মত কালো। কিন্তু বৌদি ছিল টুকটুকে ফর্সা। সব সময় হাসি মুখী। বিয়ের বেশ কিছু বছরে বাচ্চা হয়নি বলে নানা জনে নানা কথা বলত। তাতে বৌদির মুখের হাসি পাল্টায়নি। আমার আড্ডার এক প্রিয় স্থান ছিল দাদা বৌদির ঘর। আমার সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্ক ছিল বাপের বাড়ির দিক থেকে - আমার নাতনী। কিন্তু এত ছোট ছিলাম যে ওই সম্পর্ক দানা বাঁধেনি। পঞ্চাশ বছর পর সেই সোনামুখ নেই, তামাটে হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে দুই ছেলের মা হয়েছে, ঠাকুরমা হয়েছে। দাদা নেই। আগে তুমি বলতো এখন তুই বলে। সব হারালেও হাসি হারায়নি। বয়সে যেন পাথর বেঁধে আছে। পান চিবোতে চিবোতে হাসি ঝরিয়ে বলল - গান শুনবি ? - গান গাও ? শোনাও তবে। - দাড়া, হারমোনিয়াম নিয়ে আসি। আমার সময়ের অভাব। বললাম - না না, খালি গলায় গান করো। কিন্তু তিনি তো খালি গলায় গাইবেন না। অবশেষে বললাম - থাক, পরের বারে এসে শুনবো। পরের বার ? সে কি আর হবে ? পঞ্চাশ বছরে আরেক পরিবর্তন, ' আপনি ' ছেড়ে অবলীলায় ' তুমি ' বললাম। বয়স ছেলেমি ত্যাগ করলো আপন খেয়ালে। তবে যথাযোগ্য মর্যাদায়। এই ত্রুটির কথা সবিনয়ে জানালাম বুলবুলি বৌদিকে। তাঁর হাসির ঝর্ণায় সব গ্লানি ধুয়ে গেল। এবার পাশের বাড়ি, পরেশের বাড়ি। ঘুরপথের সময় বাঁচাতে দেয়াল টপকালাম। মনে হলো বুড়োত্ব নিম্নগামী। শৈশব ও কৈশোরের সাথী। শুধু কৈশোর বলা পূর্ণতা পায় না, কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে আমাদের ছাড়াছাড়ি। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যে আমার সামনে এসে দাঁড়াল - না চেনার আবরণ জমে গেছে তার চেহারায়। সেই গাট্টা গোট্টা পরেশ হারিয়ে এক বিধ্বস্ত ক্লান্ত পরেশকে পেলাম। কর্মজীবন কেটেছে আরব দুনিয়ায় নির্মাণ কার্যে। স্ত্রী মারা গেছে। বৌমা হাল ধরেছে সংসারের। আমার পরিচয় দিতে গিয়ে ঠোট কাপলো কয়েকবার। ফিসফিসিয়ে বললো - কত কথা, কত কথা....। আসলে দীর্ঘ পনের ষোল বছরের কথা দু এক কথায় বলা যায় না। সেও বলতে পারেনি আমিও বলতে পারবোনা। যদি কখনো বলার অবকাশ আসে, বলবো হারিয়ে যাওয়া শীতল পাটির গল্প। ছোট ছোট কথায় বেলা হেলে গেল। বুলবুলি বৌদি খেতে বলল, খেলাম না। পরেশ খেতে বলল, খেলাম না। আমার টার্গেট - নিয়তি। নিয়তির হাতের খাবার খাব। কে এই নিয়তি? পাঁচ বছরের এক মেয়ের সাথে বিয়ে হোল জিতেনের। ছোট্ট বৌমাকে কোলে করে, পালা করে পাঁচ/ছয় মাইল রাস্তা হেঁটে নিয়ে এলাম বাড়িতে । নিয়তি সেই বৌমা। জিতেন গ্রাম সম্পর্কে ভাইপো, পরেশের দাদা। সে স্কুলের ছাত্র। তার মা মারা গেছে অনেকগুলো ছেলে মেয়ে রেখে। সংসারের হাল সামলাতে গৃহিণী দরকার। তাই দাদা নিজে বিয়ে না করে ভাইপোকে বিয়ে দিয়ে বৌমা আনলো সঙ্গে বৌমার বিধবা মাকে। সেও অনেক কাহিনী। এবার আর পরের বাড়ি নয়, অনেকগুলি বাড়ি পেরিয়ে খুঁজে পেলাম জিতেনের বাড়ি। ষাট ছুঁই ছুঁই যে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম জিতেনের কথা, সে ই নিয়তি। নিয়তির ফেরে নিয়তি এখন সমঝদার গিন্নি। কেউ কাউকেই চিনতে পারতাম না বলে না দিলে। পঞ্চাশ বছর আগে নিয়তি আমার কাছে পড়তে আসতো সকালে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। সন্তান সম্ভবা। বয়স বারো বছরের আশেপাশে। সে সন্তান বাঁচেনি। কিন্তু ঘটতে পারত উলটো। তাহলে আমাদের এই দেখা কাল্পনিক হয়ে যেত। বেঁচে থেকে তিনটে সন্তানের মা হয়েছে। জিতেন আমার বড় কিন্তু ভাইপো বলে তুমি সম্বোধন করতাম। খুব ভাল ছাত্র ছিল। প্রথম পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে একজন। কমার্স গ্রাজুয়েট। কিন্তু কোন কাজে লাগেনি। দেশভাগ তাঁকে উপড়ে ফেলেছে। সে পড়া কোন কাজে লাগেনি নতুন দেশে। অতএব সেন্টারিং বা কৃষি কাজের মত শ্রম নির্ভর জীবন। জিতেন - নিয়তির দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলের বউ সন্তান ছেড়ে বাপের বাড়ি। এখন নাতি নির্ভর সংসার। নিয়তিকে আমি ছোট থেকেই মা সম্বোধন করতাম। এসেই বলেছি - মায়ের হাতের খাবার খাব, সে যা ই হোক। সে খুব খুশি। যখন শুনলো তার হাতের রান্না খাবো বলে আর কোথাও খাইনি, সে খুশি উপচে পড়লো। মোটা চালের ঠান্ডা ভাত, বেগুন ভাজা, ডাল। চেটে পুটে মহানন্দে খেলাম। মনে হলো - কত যুগ পরে গ্রামের বাড়িতে মাটির দাওয়ায় বসে মায়ের দেয়া খাবার খাচ্ছি। নস্টালজিয়া...। কথা বাড়ে বেলা গড়ায়। ফিরতে হবে বগুলা বইমেলা হয়ে। কিন্তু আরেক বাড়ি যে না গেলেই নয় । সে আমার বৃন্দাবনের সহচরী। সে এক নতুন ভূবন । কত কথা কত হাসি কত ঠাট্টা আমাদের সে বৃন্দাবনের ।তিনি ছিলেন লাজবতী , কথা নয় শুধু লজ্জায় আনত হয়ে ড্যাবডেবিয়ে তাকানো । তার সাথেই দেখা না করলে এ যাত্রা পূর্ণতা পাবেনা। পা চালালাম। কতটা পথ জানিনা । পাকা রাস্তা । দুধারে গাছ গাছালি, বাড়ি ঘর । কিন্তু মনের মধ্যে পাকা রাস্তা নেই, উঠানের পর উঠান- আমি হেঁটেই চলেছি অনন্তকাল । পঞ্চাশ বছর পরেও সেকি তেমনই আছে? সে কি ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আমাকে চিনতে পারবে ? সে কি আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিমান ভরে বলবে- তোমার আসতে এতো দেরী হলো কেন ? হেম পিসির ছেলে অসিত আর পেম পিসির মেয়ে প্রীতি । এই প্রীতির সাথেই আমার পিরিতি। হেম ও পেম দুই বোন। আসলে তারা আমার পিসি নয়, ভাইঝি। বয়সে বড় তাই সন্মানের সাথেই পিসি ডাকি সাথে তুই বা তুমি নয় - আপনি বলে সম্বোধন করি। তাদের ছেলে ও মেয়ের নাম অসিত ও প্রীতি । আর এদের দৌলতে স্কুল বয়সেই আমি দাদু হয়ে গেছি। এই পদমর্যাদায় তখন আমার ধারে কাছে কেউ ছিল না। তখন আমি কলির হিরো। পাকা রাস্তা ছেড়ে কা৺চা রাস্তা, তারপর আমবাগান বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে হাজির হলাম পেম পিসির উঠোনে। পেম পিসি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। কোমরে বাক ধরেছে। মাথা ভর্তি জট । মোটা হয়েছেন। চোখে কম দেখেন । কানে আরো কম শোনেন। পিসির দুই মেয়ে দুই ছেলে। বড় ছেলে দিল্লি থাকে, বৌমা এখানেই। বৌমার এক ছেলে এক মেয়ে । পিসির ছোট ছেলে বিয়ে করেনি, বাড়িতেই থাকে। আমি আশেপাশে তাকাই - তিনি কোথায় ? পঞ্চাশ বছরে অনেক জল গড়িয়েছে। সে বৃন্দাবন নেই , সে রাধাও নেই । পিসি বললেন , প্রীতি আছে এই গ্রামেই- উল্টোদিকে মানে পরেশের বাড়ি ছাড়িয়ে । মনে মনে হতাশ হলাম। বাসনা যতই তীব্র হোক এখন ভাটির সময়, উজিয়ে যাওয়ার সময় হাতে নেই। বাড়ি ফেরার তাগিদ আছে। আমার হতাশা কাটিয়ে দিল এই বাড়ির নাতবৌ। ভারি মিস্টি মেয়ে, হাসি খুশি আলাপী। তারসাথে রসালাপ করে সময় ফুরুৎ করে উড়ে গেল। দাদু ভাইয়ের সাথেও ফোনে কথা বললাম। চা খাওয়ালো জোর করে। তারপর টা টা । কথা দিলাম আবার আসবো। কিন্তু সে সময় কত দিনে হবে ? আমার যে প্রীতি দর্শণ হলোনা !

শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫

ধার্মিক থেকে অধার্মিক হবার গল্প

ধার্মিক থেকে অধার্মিক, আস্তিক থেকে নাস্তিক - এক জীবন ব্যাপী সাধনা। প্রতিপদে থাকে স্খলনের সম্ভাবনা। যুদ্ধে মগ্ন থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। সব চেয়ে বড় বাধা আসে পরিবার এবং সমাজ থেকে। সেই সব কথাই আজকের বিষয়। জন্ম পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের এক অজ গাঁয়ের কৃষক পরিবার। ধর্ম এসেছে লোকাচারের হাত ধরেই। শরীরে প্রবাহিত রক্তের মত ধর্ম ও আমাদের জীবনে প্রবাহিত। মজ্জার সাথে জড়িয়ে সেই বিশ্বাস ভেঙে অবিশ্বাসীর দলে ভেড়া এক কঠিন পথ। লিখবো না- অনুরোধ জানাই ভিডিওটা দেখার জন্য। https://youtu.be/9lgezbRnERU?si=Vm9Ctt4joEBObz1n

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...