বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৩

গল্পঃ পূর্ণিমার চাঁদ

পূর্ণিমার চাঁদ




মেয়েটির চিৎকারে হকচকিয়ে যায় রেল কলোনীর মানুষজন। সে আর্ত চিৎকারের উৎস খুঁজতে কেউ রেল লাইনের দিকে ছোটে না। সন্তর্পণে ঘরের দরজা বন্ধ হতে থাকে। জানালার পর্দা আড়াল করতে থাকে বাইরের দৃশ্যাবলী। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শুনশান হয়ে যায় রাস্তা-ঘাট।

মেয়েটির ঢেউ খেলানো চুল হাতের মুঠোয় পেঁচিয়ে মহা বিক্রমে দাঁড়িয়ে থাকে একজন। অদূরে মেয়েটির সঙ্গী ছেলেকে ঘিরে আরো তিনজন। মেয়েটির মর্মভেদী চিৎকারে ভ্রুক্ষেপ করে না কেউ। একজনের হাতে দা, অন্য দুইজনের হাতে ছুরি। ছেলেটিকে প্রশ্ন করে তারা, লাথি কষায়, দায়ের কোপ বসায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। খিস্তি দেয়, লাথি কষায়, ছুরি চালায়। রক্তে লাল হয়ে যায় সারা দেহ। ফিনকি দেওয়া রক্ত জমাট বাঁধে রেলের কাঠের স্লিপারে। নিস্তেজ হতে থাকে ছেলেটি। আবার কোপ, আবার ছুরি। আরো রক্ত। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিথর হয়ে যায় দেহ। জ্ঞান হারিয়ে ভারসাম্য হারায় মেয়েটি। ছেলেরা ধরাধরি করে রেল কলোনীর উল্টোদিকে নেমে যায়। উল্টোদিক প্রায় বসতিহীন। সব ধানক্ষেত, পুকুর, বাগান। ক্ষত বিক্ষত ছেলেটি লাশ হয়ে পড়ে থাকে লাইনের উপর।

রেল কলোনীর সারি সারি জমাট বাঁধা টালি বা টিনের ঘর। একটা দেড়তলা টিনের ঘরের কাঠের পাটাতনের উপর থেকে মুলিবাঁশের বেড়া ফুটো করে তৈরি করা জানালা দিয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে দুইজন। ওদের মাঝে লুডো পাতা, লুডোর উপর পড়ে আছে ছক্কা বলে ফেলা ঘুঁটি। কিন্তু মনে আতঙ্ক ছড়ায়। লুডো খেলা আর হয়ে ওঠে না তাদের।

পরের দিন খবরের কাগজে মৃতের খবর খোঁজে রেল কলোনীর মানুষ। সত্তর দশকের সেই দিনগুলিতে মৃত্যু তখন আর বেশি খবর হয় না। আর আগের দিনের মত্যুটা এতই মামুলি যে কোন খবরের কাগজেই খবরটা খুঁজে পায় না তারা।

দুই দশক পেরিয়ে কলোনীর মানুষেরা আর মনে করে না সে সব ভয়াবহ দিনগুলির কথা। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ইতিমধ্যে। সেদিনের সেই অরাজকতা এখন আর নেই। সব কিছুর মধ্যেই একটা ভদ্রস্থ ভাব এসেছে। রেল কলোনীর জল কাঁদাময় এবড়ো খেবড়ো রাস্তা এখন পিচে পাকা হয়েছে। টালির বদলে বেশির ভাগ বাড়িতেই ঢালাই ছাদ, দেড় তলার বদলে পাকা দোতলা বাড়ি।
আলো এসেছে, জল-কল এসেছে। টি.ভি এসেছে, কোন কোন ঘরে ফ্রিজও। মানুষের প্রসাধন বেড়েছে। রেলের দু'পাশের পুরনো বাসিন্দারা অভিজাত হয়ে উঠছে। দুই দশকের বাম জমানায় বা সমাজতান্ত্রিক ভাবনার শাসন ব্যবস্থায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ভালভাবে বেঁচে থাকার পরিবর্তিত পন্থা তৈরি হচ্ছে, মানুষ রপ্ত করছে সে পন্থা।

সময় বদলায়, মানুষ বদলায়। সমাজেরও তো বদলানো প্রয়োজন। কিন্তু সমাজ যেন বদলায় না, পুরনো সমাজটা নতুন জামা পরে অবিকল দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ততঃ কিছু ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। সেদিনের দেড়তলা ঘরের কাঠের পাটাতনের ঊপর লুডো খেলা দুইজনের একজন, ত্রিশ ছুঁই ছুঁই মেয়েটা এই রকমই ভাবে। দেড়তলার বদলে দুইতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আজও রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দু'দশক আগের সময়টাকে দেখতে পায়। সমাজ বৈষম্যের নাটক চলতে থাকে রেল লাইনের উপর। কত কিছু ঘটতে থাকে অথচ একবারও রেলগাড়ি থমকে দাঁড়ায় না। সবকিছু উপেক্ষা করে ধরা-বাঁধা নিয়মে চলতেই থাকে। তার মধ্যেই সে রেল লাইনের উপর ক্ষত-বিক্ষত লাশটা দেখতে পায়। একটি ফর্সা, বলিষ্ঠ ছেলের নিথর দেহ। ছেলেটি তার চেনা, ভীষণ ভাবে চেনা,দু'দশক আগের লুডো খেলার সাথী। 

রেল কলোনীর জমি বলতে দখল করা জমি। মূলতঃ পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষের বাস। এত মানুষের মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম তারা। ছোটনাগপুরের বাসিন্দা ছিল তাদের পূর্বপুরুষেরা। এখনো আছে অনেকে। তবে সে চেনে না। কখনো যায়নি। তাদের নিকট আত্মীয়রা এখন সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দা। সেখানে সে যায়। সামাজিক অনুষ্ঠানে, পার্বনে, নানাবিধ উৎসবে মা-বাবার সঙ্গে যেতে হয়। ছোটনাগপুরের শিকড় এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। ভাষা পাল্টেছে, অব্যবহারে আদিবাসী জীবনের নিজস্ব আচারেও এসেছে শিথিলতা, পরিবর্তন ঘটছে সেখানেও। সময় অনেক কিছু ধুয়ে মুছে দেয়। নোনা জলে ঘেরা দ্বীপ সমূহে তবু নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারাকে যথাসাধ্য বাঁচিয়ে রাখছে সমাজ মোড়লরা।

তার বাবা কাজ করে কর্পোরেশনে। ছোটনাগপুর ছেড়ে যেমন তার পূর্বসুরীরা জীবিকার প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, তেমনি তার বাবাও একটু ভালভাবে থাকবার জন্যে বা শহুরে জীবনের টানে চলে এসেছিল সুন্দরবন ছেড়ে। জুটিয়েছিল কর্পোরেশনে ঝাড়ুদারের চাকরি। দেশী মদের ঠেকে আলাপ হয়েছিল এক বাঙাল বন্ধুর সাথে। সে বন্ধুত্ব এতটাই গলায় গলায় ছিল যে রেল
কলোনীর জমির মালিক হবার সময়ও বাঙাল বন্ধুটি তার বাবাকে ছাড়েনি। দু'জনেই দু'টুকরো জমির মালিক হয়েছিল। আক্ষেপ ছিল একটাই অনেক চেষ্টা করেও পাশাপাশি জমি নিতে পারেনি। দু'জনে দুপ্রান্তে।

পাঁচমিশেলি মানুষের বাস এখানে। শিক্ষিত মানুষ যেমন আছে, তেমনি অশিক্ষিত মানুষও আছে। ভাল মানুষ আছে, খারাপ মানুষ আছে। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের ঠাস্ বুনুনি।

কলোনীর পত্তন হয়েছিল লাল নিশান পুঁতে। নামকরণ হয়েছিল এক মহান বিপ্লবীর নামে। সেই সময়ে দাপিয়ে বেড়াতেন যাঁরা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বেটেদা। ছোটো খাটো কঠিন মানুষ। সবাই সমীহ করতো তাকে। ভয়ও পেতো। সেই বেটেদা আরেকটু বেঁটে হয়েছেন। বয়স কুঁজো করেছে তাকে। তাকে সমীহ করার মানুষ এখন পাড়ায় পাওয়া যায় না। আশে-পাশের বেশির ভাগ টালির বাড়ি পাকা হলেও বেটেদার বাড়ি এখনো টালির। পাঁচ মেয়ের বাবা অসহায় গরীব ব্রাহ্মণকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করেছিলেন নিজে বিয়ে করে এবং সমমানের ছেলেদের সাথে শ্যালিকাদের বিয়ে দিয়ে। জাতপাতহীন, শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন বেটেদা। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছিলেন । চারপাশের অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পারেন নি বলে নিজের বউয়ের কাছেও ‘ছোটজাতের ছোটমন' কটুক্তি শুনেছেন। উপরন্তু ব্রাহ্মণ বাপের সহায়তায় তার স্ত্রী যখন নিজের ছেলের পৈতা-করণ করে বর্ণশ্রেষ্ঠর দলে উন্নীত হয়েছে, বেটেদার প্রতিবাদ দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে ভেসেছে ; বেটেদা আরো বেঁটে হয়েছে। অথচ বেটেদার দীর্ঘশ্বাসের তোয়াক্কা না করেই সমাজ চলছে। পাড়ায় একটাও স্কুল তৈরি না হলেও পাকা পূজামণ্ডপ হয়েছে। চোলাই মদের ঠেক হয়েছে। মিটিং মিছিলে প্রচ্ছন্ন হুমকির বিনিময়ে লরী ভর্তি লোক যাচ্ছে পাড়া থেকে, বাড়ি তৈরির ব্যবসার কমিশনে পেটমোটা হচ্ছে কোন কোন হাফ নেতার, অভিজাত পাড়ার বাসিন্দা হচ্ছে কেউ কেউ ।

এসব পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েই বড় হয়েছে মেয়েটি। লুডো খেলার সাথীর সাথে এক স্কুলে পড়েছে। বাবার গলায় গলায় বন্ধুর ছেলের সাথে তারও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে স্বাভাবিক নিয়মে। পাড়ায় দু'প্রান্তে দু'জনের বাড়ি হলেও ওরা কার্যত বড় হয়েছে যৌথ পরিবারের বাসিন্দাদের মত। বন্ধুর মা নিজের মেয়ের মত ভালবাসে তাকে। খাওয়া-দাওয়া, আচার ব্যবহারে একাত্ম হয়ে ওঠে তারা। 

মাধ্যমিক পরীক্ষায় দুম করে ফেল করে বসে ছেলেটি। সেখানেই পড়ার ইতি ঘটে তার। পড়তে আর উৎসাহ পায় না। অগত্যা তার বাবাও কাজের ধান্দা করতে বলেন ছেলেকে। অবশেষে কাজও জুটিয়ে নেয় সে, বাস কন্ডাক্টরের হেল্পার। নিজের চেষ্টায় ধীরে ধীরে কাজে উন্নতি হতে থাকে। হেল্পার থেকে কন্ডাক্টার এবং কয়েক বছরের মধ্যে বাস চালানো শিখে ড্রাইভার হয়ে যায় বন্ধুটি। পাশাপাশি পড়তে থাকে মেয়েটি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বি.এ। চাকরির চেষ্টাও চালাতে থাকে। সংসারকে আরেকটু গোছগাছ করার জন্যে বাড়তি আয়ের দরকার, দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। রাতদিন খেটে অবশেষে সফল হয় সে। সরকারি সংস্থায় কাজ পায় একটা।

দুইজনের জীবনধারা দুইদিকে চলে গেলেও পারিবারিক বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে না তাদের। পারিবারিক বন্ধুত্ব ওদের পারস্পরিক বন্ধুত্বকে আরো কাছে এনে দেয় । সবাই মিলে দীঘায় বেড়াতে যায় একবার। শীতের আবছা ভোরে সূর্যোদয় দেখার জন্যে হাজির হয় সবাই। পায়ে পায়ে সবার থেকে আলাদা হয়ে যায় তারা। মাঝ সমুদ্রে ভেসে ওঠা লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিরবতা ভাঙ্গে বন্ধুটি —
বিয়ে করতে চাই— একটু থেমে নিজের প্রত্যয় ঘোষণা করে—তোকে।
 সূর্যের দিক থেকে চোখ ফেরায় না মেয়েটি। লাল সূর্যকে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যেতে দেখে।

কি রে কিছু বলছিস্ না যে?—আবার নীরবতা ভাঙ্গে বন্ধুটি।

পাগলামি ছাড়।— -নরম বালির উপর পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে উত্তর দেয় মেয়েটি।

কিন্তু পাগলামি যায় না। কথা বলার সুযোগ পেলেই নিজের কথা জানায় । নানাভাবে এড়িয়ে যায় মেয়েটি। তার অসুবিধার কথা বলে। আদিবাসী সমাজের মেয়ে সে। আদিবাসী ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। সে যদি কোন অ-আদিবাসী ছেলেকে বিয়ে করে, শাস্তি পেতে হবে তার মা-বাবাকে। মিতান-কে বিয়ে করার জন্যে একঘরে করবে তার সমাজ। যতই তারা গ্রামের থেকে দূরে থাকুক, সামাজিক বিধি নিষেধের বাইরে যাবার ক্ষমতা তার বাবার নেই। মেয়েটি বোঝায় বন্ধুটিকে। নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা প্রকাশ করে না। বন্ধুটির উপর্যুপরি প্রস্তাবে বিচলিত হয়। 
অনেক ভেবে একদিন বেটেদার সাথে দেখা করে। তাকে বলে সব কথা। পরামর্শ চায়। বেটেদা জাত-পাত বা হড়-মিতানের দ্বন্দ্বের মধ্যে যেতে চায় না। বরং বলে—এটা দরকার। 
কিন্তু অন্য সমস্যার কথা বলে বেটেদা।

শিক্ষাগত পার্থক্যের কথা, চাকরিগত পার্থক্যের কথা। তাছাড়া বাস বা লরীর ড্রাইভারদের একটা ভিন্নতর সংস্কৃতি থাকে, যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। মদ খাওয়া ও আনুষঙ্গিক বদ-অভ্যাসের কথা বলে। এ সবের সাথে সারাজীবন মানিয়ে চলা বড় কঠিন—জানায় বেটেদা।

পাত্রের খোঁজ করতে থাকে মেয়ের বাবা। স্ব-সমাজের ছেলের খোঁজ। বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় পাত্র পাওয়া। এমনিতে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম আদিবাসী সমাজে। তার উপর ত্রিশ ছুঁই ছুঁই মেয়ের জন্যে শিক্ষিত ছেলে পাওয়া আরো কঠিন। বেশির ভাগ ছেলে-মেয়েরই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তবুও দু'চারটে সন্ধান পায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, নানাবিধ। হয় সামাজিক নিয়মে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, নতুবা দূরের বাসিন্দা বা অন্যকিছু। অবশেষে উপযোগী এক পাত্র পায়। দু'পক্ষেরই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

অস্থির হয়ে ওঠে ছেলেটি। চাঁদের আলোয় রেল লাইনের স্লিপারে সমানতালে পা ফেলতে ফেলতে আবেগপূর্ণ গলায় বলে বন্ধুটি—

তুই কি চাস্ আমি আত্মহত্যা করি?

থমকে দাঁড়ায় মেয়েটি। তার পা আর চলে না। বাবা যখন মেয়ের বিয়ের দিন গুণতে শুরু করেছে, তখন নিজের অস্থিরতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। সব বাঁধা ঠেলে সে মৃত্যুকে ঠেকাতে চায়। বলে—

–তোর মা বাবাকে বলেছিস্ ?

- না ।

–আগে তাদের বল, রাজি আছে কিনা দেখ ।

–তোকে পেলে মা-বাবা হাতে স্বর্গ পাবে।

স্বপ্ন পূরণে আহ্লাদে আটখানা হয় বন্ধুটি। বাড়িতে গিয়ে সরাসরি রান্নাঘরে ঢোকে। মায়ের পাশে গিয়ে বসে। একথা সে কথার পর বলে—

—মা, বিয়ে করব।

—তা হলে আমি তো বাঁচি।
 খুশি হয় মা—তোর বাবাকে মেয়ে দেখতে বলে দেব আজই।

-সে তোমাকে খুঁজতে হবে না। 
সবিস্তারে বলে মেয়ের কথা। মা শোনে। গম্ভীর হয়। কাজের একাগ্রতা যেন বাড়ে। ধীর লয়ে স্বর পাল্টানো গলায় মা বলে—

–ওরা যে ছোটজাত, সে খেয়াল আছে তোর?

অবাক হয় ছেলেটি। হিসাব মেলাতে পারে না সে। তার জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকে এ পর্যন্ত একথা সে একবারও ভাবেনি। তার মা বাবাও বলেনি। তাদের দুই পরিবারে যে ছোটজাত-উঁচুজাত একটা বিষয় হতে পারে, একটা বাঁধা হতে পারে সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। মাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মা বোঝে না। নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে। উল্টে ছেলেকে বোঝায়। মায়ের একান্ত অনুগত ছেলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মায়ের চোখে জল দেখে সে। মেয়ের চোখের জল টলমল করে ওঠে তার মনে। কেমন বোধশূন্য হতে থাকে। নির্বাক হয়ে যাওয়া ছেলের দুর্বলতার সুযোগ নেয় মা। ছেলের হাত নিজের মাথায় নিয়ে প্রতিজ্ঞা করায়— আর কখনো যাবে না সে মেয়েটার কাছে। বিস্মৃতির অতলে ডুবে যেতে যেতে মায়ের মুখের কথা অবিকল উচ্চারণ করে ছেলেটি।

পরদিন সকালে ছেলেকে বিছানায় পায় না মা ।দুপুরেও বাড়ি ফেরে না। রাতেও ফেরে না। পরের রাতেও। চিন্তিত হয় সবাই। আত্মীয় স্বজনদের কাছে খোঁজ যায় । কোথাও পাওয়া যায় না তাকে।

নিদ্রাহীন আরেকটা রাত পোহায়। খুব ভোরে দোতলার বারান্দায় দাঁড়ায় মেয়েটি। এত ভোরেও দু'চারটি মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেল লাইনের উপর। রেল লাইনের ধারে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত দেহ। মানুষগুলো লাশটার দিকে যেমন তাকায়, তার দিকেও তাকায়। বোধশক্তি হারাতে থাকে সে। খবর পৌঁছে যায় কোষে কোষে, দুলতে থাকে তার পৃথিবী। দু'দশক আগের সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে তার মনে। শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের নারকীয় উৎসব। একদল উন্মত্ত মানুষ দা, ছুরি দিয়ে ফুঁপিয়ে মারছে একটি ফর্সা বলিষ্ঠ চেহারার মানুষকে। ছেলেটি তার চেনা, ভীষণভাবে চেনা, তার লুডো খেলার সাথী।

তার পৃথিবী দুলতে থাকে ক্রমাগত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...