বোমাবাজির সময়, সামাজিকতা
১৩ই আষাঢ়, শুক্রবার
আজ কলেজে ভর্তি হলাম। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম পান্তাভাত খেয়ে। ভোরের ট্রেন না ধরলে কলেজে আসতে দেরি হতো। পরের ট্রেন দেড় ঘণ্টা বাদে। সেই জন্যে আগের ট্রেনেই চলে যাই। দেরি হলে যদি ভর্তি না হ’তে পারি, সে ভয় ছিল। তা হলে আবার পরের দিন যেতো হতো। তাতে আরো কতকগুলো টাকা যেতো। টিকিটের যা দাম। সামান্য জমি আর বাবার জনমজুরে সংসার চলে। তারপরে আমার জন্য বাড়তি ব্যয় বাবার পক্ষে জোগাড় করা বেশ কষ্টকর। তবু আমাকে শহরে—এতদূরে গিয়ে ভর্তি হতে হ'ল। পেটের ব্যাথায় বাবা ভোগে সারা বছর। পাশের গ্রামের হাসপাতালে দেখিয়েছি। হাসপাতাল থেকে কোন ওষুধ দেয়নি। কাগজে লিখে দিয়েছে। কিন্তু ওষুধের যা দাম তা বাবার পক্ষে কেনা অসাধ্য। অগত্যা পাশের পাড়ার কাকুকে দেখিয়েছি। আপাতত হোমিও খাচ্ছে বাবা। দু'চারদিন ভাল থাকে, আবার যন্ত্রণা হয়। এভাবে চলছে। মাকেও হাসপাতালে দেখিয়েছিলাম। কোমরে ব্যথা। ডাক্তার বলেছে কোমর ঝুঁকে বা কোমরের উপর বেশি চাপ দিয়ে কাজ না করতে। সে তো হয় না। রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ করতে হয় বসে বা ঝুঁকে। তাতে কোমরে চাপ লাগেই। বাড়ির অন্য কাজ—ঝাঁট দেওয়া, নিকানো, জল আনা, গরু-ছাগল, সবকিছু মাকে দেখতে হয়। ডাক্তারের কথা তাই মানা হয় না, রোগও বাড়তে থাকে দিনের পর দিন।
বাবা আমাকে জোর করেই এতদুর শহরের কলেজে পাঠালো। বাড়ির কাছের কলেজ ছিল, মাইল দুয়েক দূরে। সেখানে পড়া হল না। বিজ্ঞান পড়ানো হয় না সেখানে। অথচ আমাকে তো বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। বাবার স্বপ্ন আমাকে ডাক্তার হতে হবে। আমাদের মত গরীব ঘরের মানুষের ডাক্তার হওয়া শোভা পায় কি না বা সম্ভব কিনা—সেটা বাবা একদম শুনতে চায় না। বুঝতে চায় না। তার এক কথা 'ডাক্তার হতে হবে তোমাকে।" আমি ডাক্তার হ'লে হয়তো বাবার পেটের ব্যথা সেরে যাবে, মা দাঁড়াতে পারবে কোমর সোজা করে। বাবা নিজের অবদমিত ইচ্ছেটাকে হয়তো আমার মধ্যে দিয়েই পুরণ করতে চায়।
এত দূর এসে ভর্তি হলাম, এখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা যাবে কিনা, গেলেও পড়াশুানা হবে কিনা, আবার সে পড়ায় ডাক্তার হওয়া যাবে কিনা—সে সব আমি কখনো ভাবিনি। আসলে আমাদের জীবনটাতো কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগোয় না। জীবন এগোনোর সাথে পরিকল্পনা তৈরি হয়। যদিও দিবা স্বপ্নের মত এখন আমার একটা লক্ষ্য আছে—বাবার স্বপ্ন পূরণ, মানে ডাক্তার হওয়া।
কলেজের অফিস কাউন্টারে টাকা জমা দিতে হবে। লম্বা লাইন পড়েছে। সেই লাইনেই এক দাদার সাথে আলাপ হল। ইউনিয়নের দাদা। আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করল। আমার যা স্বভাব, ভয়ে ভয়ে জবাব দিলাম। দাদা বেশ চটপটে। ফরম ফিলাপ করতে সাহায্য করছিল। নতুন ছেলেমেয়েদের সাথে নিজের থেকেই আলাপ করছিল। কারো কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছিল। কাউন্টারের সামনে এলোমেলো জটলা। মাঝে মাঝে চিৎকার করে অনেককে ডাকছিল।
আমি যখন কাউন্টারের সামনে, দাদা তখন পাশেই ছিল। পকেট থেকে অতি কষ্টে জোগাড় করা টাকা বের করে সামনে রেখে প্রথমে ফর্মটা এগিয়ে দিলাম। যিনি নিচ্ছিলেন তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখছিলাম অফিসের ভিতর এ-টেবিল সে টেবিলের লোক জনকে। তাদের কথা কানে ভেসে আসছিল। কাউন্টারের লোকটি টাকা চাইল। টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম টাকাগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় নেই। আমার কাছ থেকে অনেকখানি সরে গেছে, দাদার দিকে। আমার অন্যমনস্কতায় দাদা হাতের কনুইটাকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করছেন। ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়েছেন। যে মুহূর্তে তিনি কনুইয়ের বদলে তালুবন্দি করতে গেলেন—তখনি লোকটি টাকা চাইল। দাদা ধরা পড়লেন নিজের ব্যবহারেই। বিচলিত হলেন, হঠাৎ একজনের সাথে কি দরকার হল—এই শোন.......... বলে কাউণ্টার ছেড়ে চলে গেলেন। অসম্পূর্ণ ঘটনায় আমি শিউরে উঠলাম। বড় কষ্ট করে এই টাকাগুলি জোগাড় করা হয়েছে, যদি হাতছাড়া হয়ে যেত— কি হত? ভর্তি হতে পারতাম না। আবার টাকা জোগাড় করা ছিল অসম্ভব। বাবার স্বপ্নটা আজই শেষ হয়ে যেত। বড় শহর— প্রথম দিনেই কি সংকেত জানাল আমায়?
#shortstory
২৫ আষাঢ়, বুধবার
কলেজে প্রথম ক্লাস ছিল আজ। কলেজে গিয়ে দেখলাম গিজগিজ করছে ছাত্র-ছাত্রী। এত ছেলেমেয়ে পড়ে এখানে! বাপরে বাপ্! আমার মনে হচ্ছিল বারুণীর মেলা। হৈ-চৈ-হাঁক-ডাক লেগেই আছে। একটা ব্যাপার, এখানে যারা পড়তে আসে—তারা বেশির ভাগই গ্রামের। চেহারা, পোষাকে শহুরে ছাপটা তুলনায় কম। তার মধ্যে দু'চার জনের পোষাক দেখলে কেমন যেন লাগে। কেমন খোলা-মেলা, এ মার্কা। বারবার তাকালে বা বেশিক্ষণ তাকালে মনে হয় ধরা পড়ে যাব। কেউ দেখে ফেলবে আমার কৌতূহল। অথচ তারা দিব্যি গল্প করছে। ইউনিয়নের দাদাদের সাথেই তাদের হৈ-হুল্লোড় বেশি।
যে স্যার প্রথম ক্লাশে এলেন—তার মাথায় একটাও চুল নেই। ক্লাশের টিউব লাইটের আলোয় টাকমাথা চক্ চক্ করছিল। দাঁতগুলি অবশ্য পরিপাটি, ঝক্ ঝকে। এত বয়সে কি করে এত ভাল দাঁত থাকে আমি বুঝতে পারি না। আমার বাবার তো স্যারের থেকে অনেক কম বয়েস অথচ এর মধ্যেই অর্ধেক নড়ে বড়ে গেছে। দাঁতের রং হয়েছে হলদেটে। স্যারের দাঁতগুলি কি সুন্দর। কিন্তু স্যার হাসেন না। বেশ গম্ভীর। খাতা নিয়ে ক্লাশে এলেন। দু'চারটে উপদেশ দিলেন। তারপর আপন মনে পড়ালেন। বাংলা পড়ালেন। আমাদের সবাইকে পাগল ভাবলেন কিনা জানিনা, তবে যা বললেন—সব পাগলদের নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। পাগলরা আছে বলেই নাকি এ পৃথিবীটা এখনো অনেক সুন্দর। স্যার পড়িয়ে গেলেন বা বলে গেলেন। আর ছেলেমেয়েরা গল্প করে গেল নিজেদের মধ্যে। কি অদ্ভুত! এ যেন 'নদী আপন বেগে পাগল পারা'।
আমার আগে যার রোল নাম্বার তার সাথে আলাপ করলাম। মাথার চুলগুলি ছোটছোট করে ছাঁটা। হাফ ফর্সা। রোগা, লম্বা। গ্রাম থেকেই এসেছে। আমি থাকি উত্তরে সে থাকে দক্ষিণে। দক্ষিণের ট্রেনে আসে। আমার মতই হয়তো ডাক্তার হবার স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। ওর সমস্যা বোধহয় আমার থেকেও বেশি। প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করল—স্টাইপেন্ডের ফর্ম দেবে কিনা। দিলে কতদিনে টাকা পাওয়া যাবে, কম পয়সার কোন হোস্টেল পাওয়া যাবে কিনা, ইত্যাদি। আমি তো নিজেই জানি না,—ওকে কি বলব। বলেছি, পরে একদিন ইউনিয়নের দাদাদের জিজ্ঞেস করব। আমাকেও তো খোঁজ নিতে হবে। ওকে আমার বেশ কাছের মানুষ বলে মনে হয়।
আমার পরে যার রোল নম্বর—সে একটি মেয়ে। মেয়েটি সামনের দিকের বেঞ্চিতে এক কোণে বসে ছিল। চুপচাপ। স্যারের ক্লাশে নোট নিচ্ছিল। জিন্সের প্যান্টের সাথে ঢোলা জামা পরা। ও বোধহয় এই শহরেই থাকে। গায়ের রং ফর্সা। লম্বা মুখে নাকটিও একটু লম্বা। ড্যাবডেবে চোখ। আর কারো সাথে আজ আলাপ হয়নি। ছেলেটা আর আমি কথা বলতে বলতে ষ্টেশনে এসেছি। তারপর দু'জন দু'দিকের ট্রেন ধরেছি। বাড়িতে এসে নিজেকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। হাই উঠছে বারবার। এবার ঘুমুতে হবে।
#shortstory
১৪ই আশ্বিন, বুধবার
গতকাল নবীনবরণ উৎসব ছিল। অনেক রাতে ফিরেছি। আশা-হতাশায় কেটেছে সারাদিন। এখানে তিনটে কলেজ। অর্থাৎ এক বাড়ির মধ্যেই তিনটে কলেজ। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যে। তিন শিফটে কলেজ চলে। নবীনবরণ উৎসব হয় একসাথে। বিকাল থেকে শুরু হয় রাত পর্যন্ত চলে। যদিও কাল ক্লাশ ছিল কিন্তু কোন ক্লাশ হয়নি। সকাল থেকেই উৎসব উৎসব ভাব। উৎসব নিয়ে আলোচনা। দৌড়-ঝাঁপ, কাজে বা অকাজে। ইউনিয়নের সেক্রেটারি দাদা সারা বছরের মত কালকের দিনটাও কাটিয়েছে। দোতলার রেলিঙের পাশে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি কেষ্ট ঠাকুরের মত ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দাড়িহীন মুখে হাসি হাসি ভাব। গতকালও তেমনি ছিলেন। কাজ-বাজের জন্যে তাকে কোথাও যেতে হয় না। অঙ্গুলি হেলনেই চলে। কালও চলছিল। পড়ন্ত দুপুরে ক্লাশ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খিদে পাচ্ছিল। ভাবছিলাম রাস্তায় গিয়ে মুড়ি ছোলা কিনব। দক্ষিণের বন্ধুটা তখনো আসেনি। ক্লাশের ভিতর তার নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসেছিল লম্বা মুখের শান্ত মেয়েটি। যেন ওর পৈতৃক সম্পত্তি। সেই শুরুর দিন থেকেই বসছে। ওকে কেউ বিরক্ত করে না অবশ্য। বরং ইদানিং ওর পাশের সিটের লোক পাল্টেছে। আমির খান চেহারার ছেলেটা বসে। সে আবার ইউনিয়নের দাদা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
গতকাল তো দোল ছিল না, অথচ আবির খেলা চলছিল সারাদিন। আবির হাতে ছুটছিল মূলত ছেলেরা। সঠিক বলতে ইউনিয়নের ছেলেরা। তাদের টার্গেট শুধুমাত্র মেয়েরা। সেখানে নতুন, পুরনো কোন ভেদাভেদ ছিল না। অবশ্য ছয় মাস পরে কি কেউ আর নতুন থাকে? সবাই পুরনো। অভাগা আমরা, ছেলেরা। দু'চারজন বাদে সবাই অভাগা। কোন ছেলের মাথায় কেউই আবির দেয়নি।
আমির খান চেহারার ছেলেটি আবির হাতে হঠাৎ ঢুকল ক্লাশে। লম্বা মুখের চকিত আওয়াজ শেষ হবার আগেই দরজায় ছিটকিনি বন্ধ হল ভিতর থেকে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম দরজার দিকে। সেইসময় আমির খান চেহারার ক্লোজড ফ্রেন্ড এল ক্লাশের দরজার সামনে। মাথাভর্তি সবুজ আবীর চাপ দিয়ে একটু সময় দাঁড়ালো, এদিক ওদিক তাকালো, তারপর কি ভেবে চলে । দরজায় গেল। অধঘণ্টা পর আমির খান বেরুলো ঘেমে-নেয়ে। ভিজে আবির লেপ্টে গেছে মুখে। থু-থু ফেলল, থু-থু-র রঙে আবির।
কিছুক্ষণ পর আমি ক্লাশে ঢুকলাম। মেয়েটি তার সিটে বসে। আড়াআড়ি হাতের মাঝে মাথা গুঁজে রাখা। নাম ধরে ডাকলাম। সাড়া দিল না। কাছে গেলাম, ফোঁপানো আওয়াজ পেলাম। হাত রাখলাম ওর আবির মাখা এলো চুলে। ও আমার দিকে তাকাল না, কিন্তু ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর ঢোলা জামার একটা বোতাম তখনো খোলা, সেখানেও আবির।
বিকালে অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি কিছুটা একা হয়ে গেলাম। শান্ত মেয়েটা বাড়ি চলে গেছে। নবীনবরণ উৎসব আমার কাছে নতুন। শহরের অভিজ্ঞতায় সেটা দেখতে ইচ্ছা করছিল আরো বেশি। তাই থেকে গেলাম। বাদাম-মুড়ি কিনে খেয়েছি। এক বন্ধু বলেছিল অনুষ্ঠানে প্যাকেটে খাবার দেবে। এটাও আমার কাছে নতুন। খাবারেরও একটা লোভ ছিল। তাছাড়া ভাল ভাল নাম করা শিল্পীরা আসবে। বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে জেনেও রয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আমাদের অধ্যক্ষ মহাশয় ভাষণ দিলেন। তিনি চেয়ারে বসেই ভাষণ দিলেন। প্রথমে বাংলায়। তারপর হিন্দিতে। সবশেষে ইংরেজীতে। যেভাবে বললেন—মনে হল মুখস্থ বলছেন। তবে তার বলা আমার খুব ভাল লাগল । ভাল ভাল কথা বললেন। অন্যদের কাছে শুনেছি—আমাদের অধ্যক্ষ খুব ভাল লোক, খুব বিদ্বান। আমি এই প্রথম দেখলাম তাঁকে।
তারপর মাইকে ঘোষণা করে নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের বরণ করা শুরু হল। চাঁদপানা মুখের এক নবীনাকে কেষ্ট কেষ্ট হাসিতে একটি লাল গোলাপ তুলে দিলেন ইউনিয়নের সেক্রেটারি দাদা। হাততালি পড়ল অনেক। বেঞ্চতালি পড়ল আরো বেশি। সিনেমার মাস্তানদের মতো তীক্ষ্ণ শিসে ভরে গেল হল। ক্যামেরার আলো জ্বলে উঠল বিদ্যুৎ চমকানোর মতন। নবীনবরণের এ অংশটুকু মঞ্চে হল। বাকি গোলাপ নবীনদের দিয়ে দিতে বলা হ'ল। দাদারা দিলেন, দিদিরা নিলেন। দিদিরা দিলেন, দাদারা নিলেন। আমার মত নবীনদের কাছে সে ফুল পৌঁছাল না। তার আগেই হলময় ছড়িয়ে গেল ফুল। আট-দশজন নবীনা ছাড়া আর সব ফুলই শোভা পেতে লাগল তুলনায় প্রবীন-প্রবীনাদের হাতে বা খোঁপায়।
আমার তো পেটে খিদে। গোলাপের জন্যে অত চিন্তা ছিল না। প্যাকেট পাবার অপেক্ষায় ছিলাম। গোলাপ দেবার সাথে সাথে কয়েকজন প্যাকেট দিচ্ছিল। কিন্তু গোলাপের মত যখন প্যাকেটও শেষ হয়ে গেল আমার কাছে আসবার আগেই তখন আর কিছু ভাল লাগছিল না। চলে আসব ভাবছিলাম। তখন শুরু হলো গানের অনুষ্ঠান। মাইক হাতে নিয়ে সারা মঞ্চের অনেকগুলি বাদ্যযন্ত্রের সাথে গলা মেলালেন শিল্পী। প্রথমেই হিন্দি। নেচে নেচে গাইলেন। হলের ভিতরের ছেলে-মেয়েরাও গলা মেলাল, কোমর মেলাল। আমার সামনে এক দাদা একটা গানের সাথে গলা মিলিয়ে, কোমর মিলিয়ে শেষে আর নিজের ফাঁকা সিটটা খুঁজে পেলেন না, পাশের সিটের মেয়েটার কোলের উপর বসে পড়লেন। হো-হো হি-হি-শব্দে হেসে উঠল চারিদিক।
উৎসবের মেজাজেই চলছিল সব। হঠাৎ গন্ডগোল করে ফেলল আমাদের আমির খান চেহারা। তার বোধহয় নিজেকে দেবদাস-দেবদাস লাগছিল। যদিও টলটলে পায় নাচছিল সমান তালেই। হঠাৎ তার ভিতরে জমে থাকা সমস্ত দুঃখ তরল হয়ে বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। তার দলের কয়েকজনের কাছে—সেটাও যেন এক উৎসবের বিষয়। গা গুলিয়ে উঠছিল। হল থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। সামান্য পয়সায় পেটের খিদের কথা ভুলে একটা আঠার টিউব কিনলাম। খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে লিখলাম—'আমার লজ্জা করে' শিরোনামে যা দেখলাম তাই। আবিরের কথা, গোলাপের কথা, প্যাকেটের কথা, নাচের কথা, মাতলামীর কথা, চটুল হিন্দি গানের কথা। একজন নবীনের আশাহতের কথা। চুপিসারে দোতলায় উঠে আধো অন্ধকারে সমস্ত আঠা ঢেলে কাগজটা লাগিয়ে দিলাম নোটিসবোর্ডে। তারপর শেষ ট্রেনে বাড়ি চলে এলাম।
আজও কলেজে গেছিলাম। সবার আগে। দূর থেকে প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। অফিসের কয়জন দেখল। একমসয় অধ্যক্ষও দেখলেন। মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সেক্রেটারি দাদা একটু দেরিতে এলেন। তিনিও দেখলেন। মুখটা ভারী এবং কঠিন হয়ে গেল। একজনের প্রতি আঙ্গুল হেলালেন। সে বোর্ড থেকে সযত্নে কাগজটা তুলে নিল।
আমি আজ ক্লাশে যাইনি। ইউনিয়ন ঘরের কাছাকাছি ঘুরছিলাম। যা কখনো করিনা আজ তাই করলাম, ছয়-সাতবার ইউনিয়ন ঘরে ঢুকলাম। বসে রইলাম। কখনো মনোযোগ দিলাম আলোচনায়। যেন কত অনুগত সংসদ কর্মী। ইতিমধ্যে আদেশ হয়েছে—সব ছাত্রকে জেরা করবে ক্লাশে ক্লাশে। সন্দেহ হলে হাতের লেখা দেখবে। খুঁজে বের করতেই হবে সেই আদর্শবাদীকে। তারপর যথার্থ সম্বর্ধনা জানানো হবে তাকে। ভাবলাম আপাতত আমির খান চেহারার সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় করা যাক। তাই করতে সচেষ্ট হলাম। এদের মুখোমুখি হওয়া তো আমার সম্ভব নয়। পুরো সমাজটাকে যারা গিলে খেতে বসেছে, সেখানে আমি তো চুনোপুঁটিও নই।
#story
১০ই পৌষ, বৃহস্পতিবার
ক্লাশের শেষে লম্বামুখের শান্ত মেয়েটা আমাকে তার সাথে যেতে অনুরোধ করল। বই বাজারে যাবে কয়েকটা বই কিনতে। ওর সাথে আমি গেলাম। ঝাল মুড়ি খেতে খেতে দু'জনে হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির গল্প শুনলাম। নিজের থেকেই বলল। আমির খান চেহারার বন্ধুকে বলেছে কিনা জানি না। ও বাড়িতে একা। বাবা অফিসের একটা গাড়িতে যাতায়াত করে। ওদের নিজেদেরও একটা গাড়ি আছে। সেটা সব সময়ের জন্যে ওর মা ব্যবহার করে। ও যতটা শান্ত, ওর মা ততটা অশান্ত। উগ্র আধুনিকা, নানারকম পার্টি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ও যখন বাড়ি থেকে কলেজে আসে, ওর মা থাকে বিছানায়। আবার যখন বাড়ি ফেরে—মা তার আগেই বেরিয়ে যায়। যখন রাতে ফেরে তখন স্বাভাবিক মুডে থাকে না। এটা তার নিত্য দিনের ঘটনা। স্বাভাবিক ভাবেই মার সাথে ওর হৃদ্যতা নেই। সে অভাবটা পুরণ করে বাবা। বাবা তাকে খুব স্নেহ করেন। মায়ের অত্যাচারী উগ্রমানসিকতা তাকে যন্ত্রণা দেয়। বাবার প্রতি মায়ের কোন দায়বদ্ধতাই যেন নেই, মায়ের সব হম্বি-তম্বি বাবা নীরবে সয়। বাবা মাকে কড়া ভাবে কিছুই বলে না বা বলতে পারে না। ওর কথা শুনে আমার মায়া হচ্ছিল। ভিতরে ভিতরে কত একা সে।
#shortstory
১৫ মাঘ, মঙ্গল বার
আজ ছিল কলেজের স্পোর্টস্ ডে। ময়দানের বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। খুব বেশি ছেলে-মেয়ে যায়নি। চাঁদপানা মুখের বান্ধবী খুব ভাল। ভাল দেখতে ভাল কথা বলে। ভাল গান গায়। ভাল খেলে। আজ ও তিনটি পুরস্কার পেয়েছে। দৌড়ে দুটো, হাঁড়ি ভাঙ্গায় একটা। ও আজ সারাক্ষণই একটা সর্টস্ ও শ্লিভলেস গেঞ্জি পরেছিল। আমার একটু কেমন লাগছিল ( গেঁয়ো মানুষ তো)। অতবড় একটা মেয়ে প্রায় উদোম হয়ে ঘুরছে। বারবার তার ফর্সা মাংসল উরুর দিকে, কাঁধের আশেপাশে চোখ চলে যাচ্ছিল। আমাদের টাক, গম্ভীর, বয়স্ক বাংলা স্যারও ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। আমির খান চেহারার ছেলেটি কোন খেলায় অংশ নেয়নি। তবে ‘মনের মতো সাজো'তে অংশ নিয়েছিল যৌথভাবে শান্ত মেয়েটির সাথে। ছেলেটি বৌ হয়েছিল, মেয়েটি মাতাল শ্রমিক। বৌটাকে কিল ঘুষি-লাথি মারল কিছুক্ষণ। বৌটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল অর মাতালটা টলতে টলতে মদ খেতে লাগল। ওরাও পুরস্কার পেয়েছে।
আমির খান চেহারা ছেলেটার বন্ধুও ভাল খেলে। চৌকস, বেতের মত শরীর। সেও আজ তিনটে পুরস্কার পেয়েছে। গানও গাইতে পারে। আমিও আজ দৌঁড়ালাম। একশ মিটার। আমি যখন মাঝমাঠে তখন দেখি মাঠে কেউই নেই। দৌড় শেষ করে দেখি সবাই মাটিতে গড়াচ্ছে আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না—এইটুকু রাস্তা দৌঁড়ে এত গড়াগড়ি করার কি আছে। আমাকে তো প্রতিদিনই দুই আর দুই চার মাইল হাঁটতে হয়।
সন্ধ্যার আগে আমি ওদের সাথে গঙ্গার ধারে গেলাম । চাঁদপানা গান করল। চৌকস্ ছেলেটাও। সিগারেট ধোঁয়া ছাড়ছিল আমির খান চেহারা। ওরা বসেছিল পাশাপাশি। আমি একটু দূরে রেলিঙে ঠেস্ দিয়ে গান শুনছিলাম। সব শেষে গান করল শান্ত মেয়ে। অন্ধকার হয়ে আসা গঙ্গার ওপাড়ের বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল। শান্ত মেয়ের গান মনটাকে কেমন ভারী করে তোলে। ওর গানের স্বর অন্য কথা বলে।
ওদের মত আমি গান গাইতে পারি না। খেলতে পারি না। হুল্লোড় করতে পারি না। অথচ এরাই আমার বন্ধু হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যে কোন ব্যাপারেই এরা আমাকে সঙ্গী করতে চায়। আমার কাছে লম্বা মুখের শান্ত মেয়েটির আকর্ষণ বেশি। ওর ডাকে আমি সাড়া না দিয়ে পারি না।
#shortstory
২০শে ফাল্গুন, সোমবার
আগামীকাল দোল পূর্ণিমা। কলেজ ছুটি। ওরা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাবে। ঠিক করেছিল আগেই। কলেজে জীবন-সমীকরণ অনেকটা স্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের ব্যবহারে, প্রকাশ্য অলোচনায় সেটা ধরা পড়ে। আমি বাবার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার স্বপ্ন দেখছি এখনো। মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাঁধা সত্ত্বেও লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছি বা এগোতে চেষ্টা করছি।
ওরা মানে চাঁদপানা মুখ, চৌকস্ ছেলে, আমির খান চেহারা, আর শান্ত মেয়ে। চাঁদপানা কিভাবে বাড়িতে ম্যানেজ করেছে তা জানিনা। তবে শান্ত মেয়েকে সাহায্য করতে হয়েছে আমাকে। ওর বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলতে হয়েছে, ওরা দুই বান্ধবী আমাদের গ্রামে যেতে চায়। ওর মা আমাকে একদম সহ্য করতে না পারলেও ওর বাবা আমাকে স্নেহ করেন। আমার তো তেমনই মনে হয়। ওর বাবা রাজি হয়েছে, দু’একদিন থাকলেও আপত্তি নেই।
বয়স্ক মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলতে একদম ভাল লাগে না। কিন্তু ওর আদুরে আব্দার আমাকে অস্থির করে তোলে। সত্যি মিথ্যার হিসাবটা করে উঠতে পারি না।
ওরা যাবে জোড়ায় জোড়ায়। আমার ভূমিকা গৌণ। আমির খান চেহারা শান্ত মেয়ের অনুমতি মেলার পর আমাকে সঙ্গী করতে আর উৎসাহী ছিল না। আমিও পাশ কাটাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। আমাকে ছাড়া যাবে না। অগত্যা ওদের সঙ্গী।
২১শে ফাল্গুন, মঙ্গলবার সকালে দূর পাল্লার দীঘার বাসে উঠেছিলাম। আমরা পাঁচজন। একদিকে তিনটে সিট। অন্যদিকে দুটো। জিনস্পরা লম্বামুখের শান্ত মেয়েটি আর আমির খান চেহারার ছেলে একদিকের দুটো সিটে বসেছিল। বাকি তিনজন একদিকে। আমাদের দুইজনের মাঝখানে বসে চাঁদপানা মুখ মেয়ে চলন্ত বাসে গান শুরু করল। একটার পর একটা। কখনো হিন্দি, কখনো বাংলা। আশেপাশের অচেনা যাত্রীরা কেউ কেউ সুরের হাত তালিতে যোগ দিল। ইতিমধ্যে জিনস্ পরা মেয়ে চলে এল আমাদের পাশে। আমি তার সিটে গিয়ে বসলাম জায়গা ছেড়ে দিয়ে। ব্যাগ থেকে আবির বের করে আমুদে যাত্রীদের কপালে ছুঁয়ে দিল চাঁদপানা মেয়েটি।
ঘন্টা দুয়েক পর বাস থামল একজায়গায়। আমার পাশে হিরো বন্ধুটিগুম হয়ে বসে ছিল। বাস থেকে নিচে নামবে কিনা জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পেলাম না। শান্ত মেয়েটি উঠে এলে আমি জায়গা ছেড়ে দিলাম। মেয়েটি বসতে গেল হিরোর পাশে, বসে থাকা বন্ধুটি অতর্কিতে কনুই দিয়ে জোর গোত্তা দিল। কোক্ করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল মেয়েটির। টাল খেতে খেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। যন্ত্রণায় নীল হল মুখ। হিরোর মানসিক অবস্থা হয়তো অনুমান করল সে। তিনজনের সিটের মাঝখানে বসে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদপানা মেয়ে হা—আমরা হতভম্ব। ছন্দপতন ঘটল আবার। ছেলেটা সিট থেকে উঠে এল। শান্ত মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে জুতো সহ ডান-পা রাখল মেয়েটির উরুতে। চাঁপা স্বরে ‘নষ্টামী করার খুব সাধ’—বলে উরুর উপর তোলা পায়ের হাঁটু দিয়ে আঘাত করল মেয়েটির থুনিতে। আচমকা ধাক্কায় দাঁতে লেগে জিভ কেটে গেল। চোখে অন্ধকার দেখল মেয়ে। চাঁদপানা মাথাটা চেপে ধরল নিজের বুকে। জিভ থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ঢোক গিলে খেতে লাগল শান্ত মেয়ে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছল রুমালে।
#shortstory
কার্যত বিস্বাদ হয়ে গেল দীঘা। তিনজনে দুইজনে ভাগ হয়ে গেলাম আমরা। দুটো ঘর নিলাম তিনজন আর দুইজনের জন্যে। শান্ত মেয়েটি শান্ত হয়েই রইল। কোন প্রতিবাদ করল না সে। ‘সর্বংসহা' শব্দ বুঝি ওদের জন্যেই তৈরি।
সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরল ওরা চারজন। আমি ঢেউয়ের মায়ায় আটকে গেলাম। চাঁদপানা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম—তিন ঘন্টা জ্যোৎস্নায় স্নান করব আমি। হাসি মুখে খুশী প্রকাশ পেল তার। চলে গেল হোটেলে।
রাতের খাওয়া শেষে ছাদে উঠলাম আমি। চাঁদের আলোয় সমুদ্র পেতেছে তুলোর বিছানা। সমুদ্র শব্দের দিকে তাকিয়েছিলাম নীরবে। চুপিসারে কখন উঠে এসেছিল লম্বা মুখের শান্ত মেয়ে। আমার পিছনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। কপাল ছোঁয়াল আমার পিঠে। ডুকরে কেঁদে উঠল। কান্না ভেজা গলায় অস্ফুটে বলল— বাবা যদি মাকে এমনিভাবে শাসন করতে পারত..........।
দু'টি ভিন্ন জটিল মনের মুখোমুখি আমি।
shortstory#
সংক্ষিপ্ত সংবাদ
আমির খান চেহারার বন্ধুটি পাঁচ বছরের মধ্যে মাথার অর্ধেক চুল হারিয়ে চরের জন্ম দিয়েছে। ইতিমধ্যে সে পাড়ার এক মন্দাকিনীর জলে হাবু-ডুবু খেয়ে ট্যুইশানি করে সংসার চালাচ্ছে। লম্বা মুখের শান্ত মেয়েটি ভালবাসার অপমানে বিতৃষ্ণ হয়ে মা-বাবার পছন্দের ছেলে বিয়ে করে প্রবাসী হয়েছে। চৌকস্ ছেলেটির কোন খোঁজ নেই। দু'বছর আগে চাঁদপানা মুখ মেয়েটির আধপচা দেহ পাওয়া গেছে লবণ-হ্রদ শহরের পাশের খালে। আমি ডাক্তার হবার স্বপ্নকে ছোটভাই বা সন্তানের জন্যে জিইয়ে রেখে হাল ধরেছি সংসারের।
#shortstory