শনিবার, ৯ জুলাই, ২০২২

আবিষ্কারক বন্ধু

কপিলকৃষ্ণ শাখারী, রাহুথড়
পয়তাল্লিশ বছর পর সহপাঠী কপিলের মুখোমুখি হলাম। সহপাঠী কিন্তু তাকে আমি দাদা বলতাম, আমার কপিলদা। সেও বরাবর আমাকে ভাডি বলে ডাকতো। সেই কপিলদাকে দেখলাম প্রায় অর্ধশত বছর পর। অথচ কতটুকু দূরত্ব এই শহর কোলকাতা থেকে ? কম-বেশি মুর্শিদাবাদ-এর দূরত্ব। অনেকেই নিত‍্যদিন যাওয়া আসা করে মুর্শিদাবাদ থেকে। সেই দূরত্ব আমার আর পেরোনো হলো না, পয়তাল্লিশ বছরেও না। তবু তার মুখোমুখি হলাম।

কপিলদা এখন কপিল মুনির মত চেহারা নিয়েছে। আমি অবশ্য তাঁকে বললাম, মহাভারতের ভীষ্ম। যে ভীষ্মকে বোকা বাক্সে দেখেছি। কপিলদা উচ্চতায় আমার থেকে বেশি, ছয়ফুটের কাছে বা বেশি। ঝাকড়া চুল, পেকে গেছে, কাধেঁর নীচে নেমে পড়েছে। মুখ ভর্তি দাড়ি। গায়ে ফতুয়া। গলায় কাপড় জড়ানো গামছার মত।সৌম্য কান্তি। চোখে জল, মুখে স্মিত হাসি।

কপিলদাকে আমি দেখলাম, প্রাণভরে দেখলাম। কয়েক মিনিট ধরে। শুধু আমিই দেখলাম, তিনি আমাকে দেখতে পেলেন না। তিনি এখন আর দেখতে পাননা। ভীষ্ম এখন অন্ধ, অসহায়। লাঠি হাতে ঘর থেকে বের হলেও রাস্তায় যাওয়া হয় না। অতীতের মেঠোপথ এখন পাকা হয়েছে। এখন নিরন্তর গাড়ি চলে। আরও কিছুদিন বাঁচার আশায়, এই পৃথিবীতে থাকার আশায় বাড়ির পাশের বড় রাস্তায় তিনি যান না। দেখতে পাননা কিন্তু শুনতে পান। শুনে শুনেই পৃথিবীকে আস্বাদন করেন তিনি।

কপিলদা, দপ্তরীকাকার ছেলে। আমাদের স্কুলের দপ্তরী। তাঁর মূল কাজ (আমাদের চোখে) ছিল ঘন্টা বাজানো। সকালবেলায় দূর দূর থেকে তাঁর ঘন্টা বাজানো শুনে জোর কদমে স্কুলের দিকে ছুটতাম । প্রার্থনা সঙ্গীতের আগে পৌঁছাতে হবে, দেরি হলেই তো শাস্তি ! তারপর ক্লাস শুরু। প্রথম ক্লাস ভাল লাগতো না, অংক ক্লাস। প্রথম ঘন্টার শব্দ শোনার জন্য বারবার জানালা দিয়ে তাকাতাম, দপ্তরী কাকুকে খুঁজতাম। কাকুর উপর রাগ হতো, কেন যে এতো দেরী করে ঘন্টা বাজাতে !

তখন তো এতো ঘড়ির প্রচলন ছিল না। ঐ ঘন্টা শুনেই আমাদের সময় গুনতে বা মাপতে হতো। সাধারণত প্রথম দুটো ক্লাস হতো অংক ও ইংরেজী। আর এই দুটো ক্লাসে লো বেঞ্চ, হাই বেঞ্চ এবং জোড়া বেতের মার - আমাদের নিত্য জুটতো। আর এ ব‍্যাপারে আমার যোগ্যতম সহপাঠী ছিল কপিলদা।

কপিলদা বেতের লাঠি আর বেতের মার/বাড়ির ব‍্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি রীতিমতো গবেষণা করতেন কী করে কম ব‍্যথা পাওয়া যায়। আমার বাড়ির কাছে বেতঝাড় ছিল। তাই ক্লাসের শিক্ষকমশায়দের বেত সরবরাহের দায়িত্ব ছিল আমার। আর সেই বেতের মার আমার হাতে বা পিঠে ছপাছপ  পড়তো । কপিলদা বলতেন, সরু বেত আনবি না। সরুবেতের মারে খুব জ্বালা করে, দাগ বসে যায়। মোটা বেত আনবি। মোটা বেতে ব‍্যথা কম লাগে, দাগ সহজে উঠে যায়।  আবার যখন ক্লাস থাকতোনা বা কোন ক্লাস ফাঁকি দিতাম, তিনি আমাদের ক্লাস নিতেন। বলতেন, স‍্যর যখন বেত দিয়ে হাতে মারবেন তখন হাত কীভাবে রাখতে হবে। যেদিক থেকে মারবেন তার উল্টো নীচের দিকে একটু কাত করে হাত মেলে ধরতে হবে। আর হাতের পাতা শক্ত করে রাখতে হবে যাতে বেত হাতে পড়ে পিছলিয়ে নীচের দিকে সরে যায়। অনেকেই ভয়ে, যন্ত্রণায় বেত ধরে ফেলতো। কপিলদা বলতেন, একদম বেত ধরবি না। কারণ বেত ধরলেই স‍্যর রেগে যান, ফলে আরো বেশি কয়েক ঘা মারেন।

হাতে না মেরে যদি পিঠে মারতো ? যখন পিঠে মারতো তখন পিঠের অবস্থান নিয়েও তার যুগান্তকারী আবিস্কার ছিল। স‍্যরেরা বেত দিয়ে যখন পিঠে মারতেন মনে হতো শক্তি পরীক্ষা করছেন। অনেকেই মারের হাত থেকে রেহাই পেতে পিঠ সরিয়ে নিতাম। এতে স‍্যর যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। পিঠের বদলে মাথা চোখ মুখে যথেচ্ছ মারতেন। কপিলদা বলতেন, পিঠে মারতে শুরু করলেই পিঠটা এমনভাবে পেতে দিতে হবে যাতে মাস্টারমশাইয়ের মারতে সুবিধা হয়। তিনি তো অন্ধের মত মারতেন তাই পিঠের অবস্থান ঠিক না হলে চোখে মুখে কানে, বিশেষকরে কানে লাগলে যন্ত্রণা খুব বেশি হতো।

কপিলদার হাত খুব চলতো।আমাদের থেকে বড়সড় চেহারার মানুষ ছিল, সেই সুযোগ তিনি নিতেন। সামান্য কথায়, অকারণে মাথায় চাটি মারতেন, পিঠে চাপড় দিতেন। একদিন তিনজনে অর্থাৎ কপিলদা, বিকাশ ও আমি, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কুলের পিছনের এক হাটুরে চালাঘরের নীচে গল্প করছিলাম। কথার মাঝে বিকাশের মাথায় একটা চাটি মারলো। বিকাশ বললো, ' ' 'খালি খালি মারলি -ভগবান তোরে শাস্তি দেবে।'
সেকথা শুনে কপিলদা আবার একটা চাটি মারলো বিকাশের মাথায়। বললো - ' দেখি তোর ভগবান আমাকে কী করে '- বলার সাথে সাথে একটা হোচট খেল।
বিকাশ বললো - দেখলি তো, ভগবান কেমন শাস্তি দিল !'
কপিলদা এবার ওর পিঠে একটা জোর থাপ্পড় দিল। বললো -' ডাক এবার তোর ভগবানকে।' এই বলে সে একটা চালার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। অমনি খুঁটিটা ওর ভার সইতে না পেরে পড়ে গেল কাত হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে কপিলদাও ধপাস্ । বিকাশ হাততালি দিয়ে উঠলো। কপিলদা ধূলো থেকে উঠে তেড়েফুড়ে গেল বিকাশের দিকে। বিকাশ আর ভগবানে আস্থা রাখতে পারলোনা, ছুটে পালালো।

অনেক স্মৃতির কপিলদাকে ছেড়ে একদিন চলে আসতে হলো। দেশছাড়া যেন আমার ভবিতব্য ছিল। আমার  ছয় ভাই এক বোন, এক এক করে চলে গেছে। বড়দা ছাড়া সবার মাধ্যমিককই জন্মভূমিতে শেষ পড়া। আমার মাধ্যমিক শেষ হতেই দামামা বেজে উঠল, এবার বিসর্জনের পালা। পড়ে রইলো বাবা, জেঠিমা আর আমার কথা বলতে না পারা দিদি। ভাইদের মধ্যে সবার শেষে আমি এলাম। দিদি বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়, এ পৃথিবীতে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই একদিন সে স্বইচ্ছায় পৃথিবীর মায়া ত‍্যাগ করে চলে গেল। ভিটেমাটি ছেড়ে সবার শেষে এলো জেঠিমা ও বাবা। এক অনাথ রাখালবালক বড় হতে হতে, একটু একটু করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে জমি কিনেছিল, তার মায়া ত‍্যাগ করতে লাগল আরো কয়েক বছর। শুধু ভিটের মাটিটুকু রেখে এলেন এই আশায় - আবার যদি ফিরে আসতে হয় ! জন্মভূমি চিরকালের মত আমাদের কাছে পরদেশ হয়ে গেল। আর সেই পরদেশে রয়ে গেলেন কপিলদারা।

প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল কপিলদার কোন খোঁজ নেইনি। একদিন ইউটিউবে বাংলাদেশের গায়ক নকুল বিশ্বাস-এর ভিডিওতে কপিলদার সম্পর্কে জানতে পারলাম। একদা যাত্রাশিল্পী নকুল বিশ্বাসের সহ অভিনেতা ছিলেন কপিলদা। অন্ধত্বের খবর তাঁর কাছেই পেলাম।

বাংলাদেশে বন্ধু ফিরোজকে অনুরোধ করলাম কপিলদার বাড়ি যেতে। ফিরোজ ভিডিও র মাধ্যমে এত বছর পর মুখোমুখি করে দিল আমাদের। কৈশোরের তিনি আজ যোগীর বেশে আমার সামনে। যোগীর চোখে জল, আমি দেখলাম কিন্তু তিনি আমায় দেখতে পেলেন না। তাঁর মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে কেবল আমার শৈশব, কৈশোর।

কৈশোরে যেমন মাস্টার মশাইদের মা'র সইতে হাত পেতে দিতেন, পিঠ পেতে দিতেন, অবলীলায় সব সইতেন আজও তেমনি জীবন পেতে বসে আছেন। ' ছেলে অকালে মারা গেছে। এক মেয়ে বিয়ের পরে সীমান্তের ওপারে।অন্য মেয়ে দূর শশুর বাড়ী।অভাব আছে কিন্তু সব সয়ে যাচ্ছে। তোর বৌদি জমিতে কাজ করে। দুই জন মানুষের চলে যায়। ' শান্ত, ভরাট , ক্লেশহীন কন্ঠে বললেন কপিলদা।

* * * ** * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

আমি দ্বিধাহীন, এই পৃথিবীর বাইরে কোন স্বর্গ-নরক নেই। কপিলদা সেই পর্ব পেরিয়ে এখন কেবল স্মৃতিলোকে। জীবনের শেষ ক'টা দিন কপিলদাকে স্বর্গসুখ দিয়েছেন উদয়ন বিদ‍্যাপীঠের প্রাক্তনীরা। দু'বেলা দু'মুঠো খাবারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন । যদিও  সবার অলক্ষ্যে অনেক আগে থেকে শুরু করেছিল বন্ধু ফিরোজ। প্রতিমাসে ঢাকা থেকে এসে সাধ‍্যানুসারে কপিলদার পাশে দাঁড়াত সে। পরে সেটাই সার্বিক রূপ পায়। সম্মিলিত ভাবে এই স্বর্গ রচনা আমাদের আশান্বিত করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...