মন্বন্তর, মহামারী এবং বাংলা।
"ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়"। করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী তান্ডবের মাঝে আপনি কি সিঁদুরে মেঘ দেখতে পাচ্ছেন ? আমি ভাবছি আর শিউরে উঠছি।
বাংলার মানুষ, বৃহত্তর বাংলার মানুষ, ঘর পোড়া গরুর মত দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর দেখেছে অনেকবার। শাসকদের অবিবেচনায়, উপেক্ষায় না খেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মরেছে, পথেঘাটে জ্যান্ত লাশ হয়ে পড়ে থেকেছে দিনের পর দিন। অবশেষে সত্যিকারের লাশ হয়েছে। অন্তত দুইবার আক্ষরিক অর্থেই শ্মশান হয়েছে বঙ্গভূমি। আর সেই মৃত্যুমিছিলের ছবি আঁকা হয়েছে বাংলার শিল্প সাহিত্যে। #মন্বন্তর
বাংলায় অন্তত দুইবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছে যা বাংলাকে মহাশ্মশানে পরিনত করেছে। একটা হয়েছে ইংরেজদের ভারত শাসনের শুরুতে আরেকটি হয়েছে ভারত শাসনের শেষদিকে।
বাংলা ১১৭৬ সন।ইংরেজ শাসনের শুরুর দিক। সেই সময়ের মন্বন্তরকে ছেয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। ঐতিহাসিক, গবেষকরা বলেন, এক কোটির উপর মানুষ মরেছে তখন যা জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। না, শাসক ইংরেজ কোন দায়িত্ব পালন করেনি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এই গণহত্যার সহায়ক হয়েছে।
তার আগে কি দুর্ভিক্ষ দেখা যায়নি ? হ্যাঁ হয়েছে। তবে দেশীয় রাজন্যবর্গ কমবেশি প্রজাদের পাশে থেকেছে। কিন্তু সাগরপারের বেনিয়া শাসক ছেয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কেবল চোখ বন্ধ করেই কাটিয়েছে। বাংলা মহাশ্মশানে পরিনত হয়েছে।
সর্বশেষ মন্বন্তর হয় ১৩৫০ সনে। ইতিমধ্যে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হয়েছে ১২বার, আকাল হয়েছে অন্তত ২০বার। প্রতিবারই পরিনতি মানুষের দলবেঁধে নাখেয়ে শুকিয়ে মরা।
মন্বন্তর বা আকাল বা দুর্ভিক্ষের জন্য প্রতিবারই কিছু কারণ থাকে। বন্যা, ভূমিকম্প, ঘুর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পঙ্গপালের ফসল নষ্ট, মহামারী, আর্থিক মন্দা, ইত্যাদি কোন না কোন কারণ বিদ্যমান।
#epidemic
১৩৫০-এর মন্বন্তরকে পঞ্চাশের মন্বন্তর বলা হয়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে অনাবৃষ্টি ও কয়েকবছরের ফসলের কম উৎপাদন ছিল। কিন্তু সেসব মূল কারণ ছিল না। গবেষণায় যে সত্য প্রকাশ পেয়েছে, - বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ছিলেন মূল ভিলেন। আর ছিল এদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের অমানবিক স্বার্থপরতা। সরকার দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, অবর্ণনীয় অত্যাচারে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় করেছে, বিশ্বযুদ্ধের সেনাদের নাম করে প্রয়োজনের অনেক বেশি খাদ্য মজুদ করেছে। সেই সঙ্গে দেশীয় জমিদাররা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় করেছে, মজুত করেছে আর দেদার ফূর্তি করেছে।
ইংরেজ সরকার পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করেছে যাতে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা না যায়। তখন নৌকা আর গরুর গাড়ি ছিল মূল পরিবহন ব্যবস্থা। ইংরেজ সরকার নৌকা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং ভেঙ্গে ডুবিয়ে দিয়েছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে গরুর গাড়ি। জাপানিদের বার্মা দখলের ফলে সেদেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এদেশ থেকে বারবার আবেদন যাওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একটুও সাহায্য করেনি এদেশের ভূখা মানুষদের জন্য। উপরন্তু অষ্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা যখন নিজেদের জাহাজে করে খাদ্য দিতে চেয়েছে, চার্চিল অনুমতি দেয়নি।
কত মানুষ মারা গেছে পঞ্চাশের মন্বন্তরে ? গবেষকরা বলছেন, ৩০ লক্ষের অধিক মানুষ শুধু না খেয়ে মারা গেছেন। গ্রামের মানুষ ছুটেছেন শহরের দিকে। ছুটতে ছুটতে চলা থেমে গেছে পথিমধ্যে অসংখ্য মানুষের। কেউ ভাত চায়নি, শুধু একটু ফ্যান চেয়েছেন। ফ্যান দাও, ফ্যান দাও করে এক অতিবিকৃত স্বরে ফ্যাস্ ফ্যাস্ করেছেন। না পেয়ে আস্তাকুঁড়ে খাবার খুজেঁছেন। মানুষ মানুষের মাংস খেয়েছে, বাঁচবার জন্যে মরা মানুষের মাংস খেয়েছেন।
আর সভ্যতার নিকৃষ্টতম প্রাণী হিসাবে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষেরা দরজায় খিল দিয়ে , কখনোবা মরা মানুষের দেহের উপর দিয়ে ফিটনগাড়ি চড়ে সম্ভোগে মেতেছে।
আজ, একবিংশ শতাব্দীতে আমরা ইথিওপিয়া, সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের ছবি দেখে আহা-উহু করি কিন্তু এই বাংলার ইতিহাস ঘাটতে ভয় পাই। কিন্তু সেই ইতিহাস আজ সজীব হয়ে আমাদের সামনে দাড়াতে চাইছে।তবে তা শুধু এই বাংলায় নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে। আর এর পিছনের কারণও সেই উৎপাদনের অপ্রতুলতা, মহামারী।
আমার জন্ম পঞ্চাশের মন্বন্তরের তের/চৌদ্দ বছর পরে। তাই সেই মন্বন্তর দেখিনি।কিন্তু আমার বাবা প্রায়ই চোখের জলে গল্প বলতেন। তবে তা পঞ্চাশের অনেক আগের। যে মন্বন্তর আমার আলোচনায় নেই। বাবা পাতের ভাত নষ্ট, সে একটা হলেও, সহ্য করতে পারতেন না। রেগে যেতেন আর নিজের বহুকথিত গল্পটা বলতেন।
কোন এক দুর্ভিক্ষের সময় পরিবারে খাবার জুটতোনা। কচু ঘেচু খেয়েই থাকতে হতো। যদিওবা কখনো ভাত জুটতো সেটা পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান ই পেত। বাবা বেঁচে গেছেন কিন্তু তাঁর এক দিদি বাঁচেননি। তাঁর দিদি একটু ভাতের জন্যে সবসময় কান্না করত। ভাত ভাত করতে করতেই ১৫/২০ দিনের পর সেই দিদি মারা যায়।
আমি দেখেছি চুয়াত্তরের মন্বন্তর। এটা ঘটে ইংরেজী১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। নিন্দুকেরা বলে , এটা সদ্য তৈরি একটা দেশকে ভাতে মারার ব্যবস্থা, মানুষের তৈরি। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। বিশেষ করে চাল ও নুনের। প্রকৃতির রোষে মাঠঘাট ফেটে চৌচির। গরু ছাগল হাড়জিরজিরে। প্রথমে কচু, শাকপাতা খেয়ে জীবন ধারন। পরে সেসবও অমিল হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে মানুষেরা , বিশেষ করে মেয়েরা বউয়েরা চলে যেত কয়েক মাইল দূরের চান্দার বিলে। ঘেচু, শালুক কুড়িয়ে আনত। ফিরে আসত দিনের আলো ফুটবার আগেই। কারণটা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি শরৎ সাহিত্যে। দিনের আলোয় বেরোবার যথেষ্ট পোশাক ছিল না মেয়েদের। গোদের উপর বিষফোঁড়া, দেখা দিল কলেরা। একজন একজন করে প্রিয়জন মরে যেতে লাগল। মুসলিমরা কবর দেয় ধর্মীয় নিয়মে। কিন্তু হিন্দুরাও কবর দিতে শুরু করল গণহারে। কারণ জ্বালানির অভাব।
আমার বয়স তখন১৪/১৫ বছর। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে বই এনে প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের বই গোগ্রাসে গিলছি। আর সেই দুর্ভিক্ষে শরৎ সাহিত্য প্রত্যক্ষ করেছি নিজের জীবনে। গোয়ালের গরুকে খাবার দেবার মত কিছু নেই, আমি নিজেই তখন গফুর হয়ে গেছি। খেলার সাথী মেয়েরা একসঙ্গে স্নান করতে নদীতে যায় না। ডাকতে গেলে বেড়ার আড়াল থেকে কথা বলে, সামনে আসে না। পরে বুঝেছি, শরীর ঢাকবার মত গামছা বা জামা তাদের ছিল না। দিনের শেষে একটু আটার জাউ (আটা গোলা গরম জল) জুটতো কি জুটতো না। কলেরা ছড়ানোর বিভৎসতা দেখে মনে হত শরৎচন্দ্র বর্ণিত প্লেগ। তরতাজা মানুষ কেমন বমি করতে করতে, হাগতে হাগতে মরে যেতে লাগল।
তবে পঞ্চাশের মন্বন্তরের মত নাখেয়ে শুকিয়ে মরতে দেখিনি। যেটুকু দেখেছি, সে বিভিশিখা মনের মধ্যে দাগকেটে বসে আছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে সজাগ ছিলেন বাংলার কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা। কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন - আর তাঁদের জন্যেই পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে সেই ভয়াবহতা।
১৩৫০ সনের গল্প নিয়ে একটা সংকলন সম্পাদন করেছেন বেলাল চৌধুরী (প্রকাশক :পুনশ্চ)। ভূমিকায় লিখেছেন -
" দুর্ভিক্ষের পঞ্চাশ বছর পর আমার দুর্ভিক্ষের গল্প কেন, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে চোখের সামনে আবার সেই কঙ্কালের মিছিল ফিরিয়ে আনা, শবে শবে আকীর্ণ রাজপথের দৃশ্যাবলী তুলে ধরা, আবার সেই 'ফ্যান দাও ' আর্তনাদে আকাশ ভরিয়ে তোলা, এ কি দুঃখবিলাস নয় ?"
আবার লিখেছেন, -
" তেরোশ পঞ্চাশ বাঙালি নামক জাতির আত্মকথারই একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। দুঃখের, অপমানের, লজ্জার। সেই বিষাদ সিন্ধুর কথা ভুলে গেলে ক্ষুধা এবং মহামারীতে মৃত ত্রিশ লক্ষ নারী পুরুষ শিশুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।"
তসলিমা নাসরিন সম্পাদনা করেছেন " ফ্যান দাও", সেই সময়ের কবিদের কবিতা নিয়ে সংকলন। তিনি ভূমিকায় উদৃত করেছেন শ্রীপন্থের লেখা -
" স্বদেশের মানুষ ভিক্ষাপাত্র হাতে কঙ্কাল হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায় / চাল নয়, ভাত নয়, তারা শুধু ফ্যান চায়।"
লিখেছেন - "....ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং ধানের মড়কের ফলে অনেক ভূমিহীন শ্রমিক বেকার। দুর্ভিক্ষে না খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ দিয়েছিল এই ভূমিহীন শ্রমিক, মাঝিমাল্লা, জেলেরা এবং যাঁরা ধান ভেঙে পেট চালাতেন, তাঁরা। কলকাতার পথে প্রধানত তাঁরাই কঙ্কালে কঙ্কালে লিখে রেখে গিয়েছিলেন সেদিন মানুষের উদাসীনতা আর হৃদয়হীনতার এক কলঙ্ক কাহিনী।... সব যানবাহন তখন যুদ্ধ কবলিত। জাপানিরা পূর্ববঙ্গে হামলা দিচ্ছে শোনামাত্র সেখানকার চারটি জেলা থেকে ধান চাল সরিয়ে নেয়া হয়। নৌকা দখল করা হয়। কয়েক হাজার নৌকো ভেঙ্গে ফেলা হয়।সৈন্যদের জন্যে কিছু রেখে ডুবিয়ে দেয়া হয় বেশকিছু। একদিকে এসব বিভ্রাট, অন্যদিকে মজুত উদ্ধার এবং খাদ্য সরবরাহ নিয়ে প্রহসন। কলকাতায় মৃত্যু মিছিল। ... গ্রাম থেকে শহরে শুরু হয়েছিল ছায়া-মানুষের মিছিল। মহানগরী কলকাতায় ফুটপাতে তাঁদের কঙ্কালেই রচিত হচ্ছিল সেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর আরেক মন্বন্তরের হৃদয়বিদারক বিষাদ সিন্ধু।"
" অমর্ত্য সেন হিসেব করে দেখিয়েছেন, গোটা দুর্ভিক্ষে মানুষ মরেছে প্রায় ত্রিশ লক্ষ। তখন খবরের কাগজে বেরত, বাবা তার মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে বারো আনা কী একটাকায়, স্বামী তার স্ত্রী, কন্যাকে ৫/১০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে।পেটে ভাত নেই, তার উপর জাপানি বোমা, বনে আগুন লাগলে বুনো জন্তু যেমন পালায়, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা পালায়, তেমন করে মানুষ পালিয়েছে একবার গ্রাম থেকে শহরে, আরেকবার শহর থেকে গ্রামে।"
সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন, -
" তেরশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। সে ইতিহাস একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, ঘর ভাঙা গ্রাম ছাড়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে পথে মৃত্যুর ইতিহাস, আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস।"
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন -
"তে্রোশো পঞ্চাশ সালে কার্তিকের ভোর,
সূর্যালোকিত সব স্থান
যদিও লঙ্গরখানা
যদিও শ্মশান..."
কবি অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন -
"ঝিম ঝিম ধরে শিরায় মৃত্যু
শরীর শুকোয়, কন্ঠ শুকোয় : অন্ন নাই।
ভাঙ্গা ভান্ডারে মাটি নিরন্ন।
.....................................................
অন্ন দাও -
প্রাণের ক্ষুধার একটু অন্ন দাও।"
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র -
" নগরের পথে পথে দেখেছ অদ্ভূত এক জীব
ঠিক মানুষের মতো
কিংবা ঠিক নয়,
যেন তার ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রুপ - বিকৃত।
তবু তারা নড়েচড়ে, কথা বলে, আর
জঞ্জালের মত জমে রাস্তায় রাস্তায়,
উচ্ছিষ্টের আস্তাকুঁড়ে বসে বসে ধোঁকে,
-আর ফ্যান চায়।"
তিনি বর্ণনা করেছেন -
"ঘরপোড়া গরু তাই ভয় হচ্ছে। লকডাউনের আগে যে চাল কিনেছি৫০টাকা আজ তা ৮০টাকা। যে আলু কিনেছি ১২টাকায় ইতিমধ্যে তা ২৬টাকা। কিন্তু এখনো যোগান আছে, যদি যোগান বন্ধ হয়ে যায় ? তাই ভাবতে হবে , কী করণীয় । বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু বিত্তবানদের ভালবাসে না, সর্বহারাদের সব চাইতে বেশি ভালবাসে।
খবর বলছে, বিশ্বজুড়ে মন্দা আসছে। উড়োজাহাজ উড়ছে না। জলে ভাসছে না জাহাজ। কলকারখানা চলছে না। মানুষের কাজ থাকবে না। সাধারণ মানুষের কাছে টাকা থাকবে না। মানুষের কেনার সামর্থ্ থাকবে না। প্রকৃতির রোষে এক অনুবীক্ষনিক অনুকোষ , ভাইরাস, মহাবিশ্বে পাড়ি দেয়া সভ্যতার শিখরে ওঠা আত্মম্ভরী মানুষকে ঠুটো জগন্নাথ করে দিয়েছে। মানুষ এবং মানুষের তৈরি ঈশ্বর আজ দিশেহারা। সভ্যতার সংকটকাল।
মহামারীর পর মহামন্বন্তর। অতীতের মত এবারেও কী মরবে লক্ষ, কোটি মানুষ , সাধারণ মানুষ ! ধনীরা সর্বদা ছাড় পায়, এবারও পাবে।
সিঁদুরে মেঘ জমছে। মন্বন্তরের সিঁদুরে মেঘ। করোনাভাইরাস আর লকডাউন এই দুই শব্দের কী অসীম শক্তি , বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে ! একজন আক্রমনাত্মক আরেকজন রক্ষানাত্মক।
আমরা ধর্মঘটে অভ্যস্ত কিন্তু লকডাউনে নই। অথচ দুইয়ের মধ্যে কত মিল। দোকানপাট বন্ধ, গাড়িঘোড়া বন্ধ, স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সব বন্ধ। কিন্তু ধর্মঘটে একদিন রাজ্য বা রাষ্ট্র বন্ধ থাকলে পরের দিন কাগজগুলিতে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশা ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়, হায় হায় রব ওঠে। অথচ করোনাকালে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিশ্বজুড়ে লকডাউন হয়েই চলেছে, সেই ক্ষতির চিত্র কেউ তুলে ধরছেনা। আমার মনে হয়, অন্ধকারের ব্যপ্তি যেমন হিসাবে আনা যায় না তেমনি লকডাউনে ক্ষতির ব্যপ্তিও সাধারণের বোধগম্য হিসাবে আনতে পারছে না। কল্পনাও যেন খেই হারিয়ে ফেলছে।
পৃথিবী যদি পৌঁছে যায় একশো বছর আগের মন্দায়, এক অন্তহীন অন্ধকার সময়ে, যেখানে অর্থনীতি দিশেহারা। কী হতে পারে মন্দায় ? উৎপাদনহীনতা, চাকরি হীনতা, খাদ্যের অভাব। যোগানের অভাব। যার অন্য নাম দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর।
আর দুর্ভিক্ষের নাম শুনলেই বাঙ্গালীর ঘর পোড়া গরুর মত অবস্থা। কারণ বাংলা দেখেছে ১১৭৬-এর দুর্ভিক্ষ, যেখানে বৃহত্তর বাংলার তিনভাগের একভাগ মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। বাংলা বৃটিশদের শাসনে দুর্ভিক্ষ দেখেছে কমপক্ষে ১২বার, আকাল দেখেছে অন্তত ২০বার। আর প্রতিবারই লক্ষ লক্ষ প্রান হারিয়েছে। শেষ মহাদুর্ভিক্ষ হয়েছে ১৩৫০ সনে। যখন মানুষ, লক্ষ লক্ষ মানুষ, একটু ফ্যানের জন্যে হাহাকার করেছে; মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত ও সরকার দরজার খিল খোলেনি সে আর্তস্বরে। আস্তাকুঁড়ে খাবার খুজেঁছে, কিছু না পেয়ে মানুষে মরামানুষের মাংস খেয়েছে। আর মরেছে। সেই দুর্ভিক্ষে ৩০লক্ষ বাঙ্গালী না খেয়ে মারা গেছে।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন, "দুর্ভিক্ষের মৃত্যু বিত্তবানদের ভালবাসে না, সর্বহারাদের সবচাইতে বেশি ভালবাসে।" অতীতের বাংলায় বিত্তবান মানেই উচ্চবর্ণের মানুষ আর সর্বহারা মানেই মূলনিবাসী তথা দলিত শ্রেণীর মানুষ। মৃত্যু তাদের বড়বেশি ভালবাসে।
সরকার আছে। সরকার তখনও ছিল। কিন্তু গরীব মানুষের নিয়তি সিঁদুরে মেঘের সাথে একসূত্রে বাঁধা।
###
#goutamaalee
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন