একাকিত্ব । Loneliness
আমার একাকিত্ব।
জোয়ার ভাটার জীবন। বিজ্ঞজনেরা তাই বলেন। শুধু সুখ বা দুঃখ দিয়ে জীবন তৈরি হয় না। কিন্তু জীবনে যখন অবিরাম ভাটা চলতে থাকে, একটার পর একটা বিপদ আসে, মানুষ দিশাহীন হয়ে যায়। সেই অবস্থাকে বলে দুঃসময়। মা মাসিরা বলে- শণির দশা।
#goutamaalee
শণিরদশা তো ঢাকঢোল পিটিয়ে আসে না। সে অতি নগন্যের হাত ধরেই আসতে পারে।
বেশ সময় কাটছিল। খাচ্ছিদাচ্ছি, বাজার করছি, ছবি তুলছি, পড়ছি, লিখছি। এর মধ্যেই অতি সামান্য বিষয় নিয়ে হেসে হেসে খটাখটি। কথার পিঠে কথা। জল একটু অন্যদিকে গড়াল। দুচার কথার পর যার যার মুখে কুলুপ। এটা আমাদের অনেক দিনের স্বভাব। আটদশ দিন নিন্মচাপ থাকবে। তারপর ধীরে ধীরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাব।
কিন্তু এবার অন্য রকম হলো। যেটুকু কাজ ছিল সারাদিনে তারা ছুটি নিতে থাকলো। আর আমি ক্রমান্বয়ে একা হতে থাকলাম।
এক - সারাদিন বকবক করি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা-ঝগড়া করি। সেটা বন্ধ হলো।
দুই- মাঝে মাঝে হেড়েগলায় কবিতা বলি, গান করি। সেটা বন্ধ হলো।
তিন - বাজারে যেতে হবে কিনা বুঝতে না পেরে বাজার যাওয়া বন্ধ হলো।
চার - বই পড়তাম, সেটা বন্ধ হলো।
পাঁচ - সবার সাথে টিভি দেখতাম, সেটা বন্ধ হলো।
ছয় - সকালে দুইজন হাটতাম, সেটা বন্ধ হলো।
সাত - শরীরচর্চা করতাম, বন্ধ হলো।
আট - ছবি তুলতাম, এডিট করতাম, বন্ধ হলো।
নয় - ফোনে বন্ধুদের খোঁজ নিতাম, বন্ধ হলো।
দশ - খাই খাই কমে গেল।
জীবনটা অচল হয় গেল। মন ভারি, সারাদিন এঘর ওঘর করছি। মনের মধ্যে শুধু আজেবাজে চিন্তা। নিজের উপর বিরক্তি তৈরি হলো। আরো বেশি আবেগময় হতে থাকলাম। নিজের দোষ খুজতে লাগলাম। তুল্যমূল্য বিচার করতে লাগলাম।
রাতে ঘুম হলনা। প্রায় সারারাত জেগে কাটালাম। মনের অস্থিরতা বাড়ল।
মনের সাথে শরীরও অচল হতে থাকল।হাটাচলা ছন্দহীন। কেমন বোঝা মনে হল নিজেকেই। অবসাদ মনকে দ্রুত টানতে থাকে। সে যেন অন্ধকারের দূত। রাতের দিকে মনে হল, কী লাভ এ জীবন বয়ে বেড়ানোর ! মনের উপর এতটাই চেপে বসলো যে ভয় পেয়ে গেলাম। মৃত্যু ভয় । যদি হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে যায় ! যদি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় ! দুশ্চিন্তা থেকে এই দুটো রোগই বেশি হয়। অনেকগুলো বন্ধু ইতিমধ্যেই হঠাৎ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমার বড়দা এইভাবে মারা গেছেন। পাশের বাড়ির দাদা চলৎশক্তিহীন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। আমার যদি তেমন হয়? আমি তো বোঝা হয়ে যাবো পরিবারের ! সেতো এক অনাদরের জীবন !
ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।ঘুমাতে গেলেই ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করে। না ঘুমাতে পেরে টিভির সামনে বসেছি। রাত দুইটা, তিনটা, চারটা.. ঘুমাতে পারছি না। ঘুম আসছে না।
এক দুঃসহ সময় আমাকে গ্রাস করেছে। প্রাণবন্ত, হ্যা প্রাণবন্তই তো ছিলাম।। সেই আমি কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছি। একা হয়ে গেছি। নিজে কারো সাথে কথা বলিনা, আমার সাথে কেউ কথা বলে না।
এই একাকিত্ব, নিদ্রাহীনতা আমাকে। আরো অস্থির করে তোলে। আশাহীন করে তোলে। ইতিমধ্যে আরেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। রাতের থেকে হঠাৎই বাহাতের পেশীতে তীব্র ব্যথা। যন্ত্রণায় বা হাত তুলতে পারিনা। পঙ্গুত্ব পেয়ে বসলো। পোষাক পরতে পারিনা। এক হাতে সব সামলাতে হয়। ওরা কি বুঝতে পারেনা ? ওরা বুঝবে কী করে , আমি তো কিছুই বলিনা। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিই।
হতাশা বাড়ে। অবসাদ আরো গ্রাস করে। মনে হয়, আমি তো বোঝা হয়ে গেলাম। কাদের জন্য বাঁচবো ? কী লাভ বেঁচে থেকে ? মা- বাবার ছবির সামনে যাই। বড়দার ছবির সামনে দাঁড়াই। ওঁরা কি আমাকে ডাকছে ? আমি কি ওঁদের কাছে চলে যাব ?
কিন্তু এদের ফেলে কোথায় যাব ? মেয়েটা এখন পড়ছে। আমি চলে গেলে ওর পড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে ? সংসার কি অচল হয়ে যাবে ? ওদের বিপদের মধ্যে ফেলে পালিয়ে যাব ? সে তো এক পরাজয়, হেরে যাওয়া ! মা-বাবা-দাদার ছবির সামনে থেকে সরে আসি। মনে মনে বলি -না, আমি তোমাদের কাছে যাবনা। আমি পালাবোনা।ওদের জন্যই আমায় বেঁচে থাকতে হবে।
কিন্তু রাতে ঘুমাবো কি করে ? আজও যদি ঘুম না আসে ? চেনা ওষুধের দোকানে গেলাম। দুটো বড়ি দিল। শোয়ার আগে একটা খেতে হবে।
রাতে শোয়ার আগে ওষুধ খেতে গিয়ে অন্য ভাবনা এলো। যদি ঘুমের মধ্যে এ্যটাক হয় ? ওষুধের প্রভাবে ওদের ডাকতে পারবো না। তাই ওষুধ খেলাম না। দরজা বন্ধ করলাম না। আমার তীব্র বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভয়ও করছে। এতো দুশ্চিন্তা যদি শরীর নিতে না পারে ?
ঘরের আলো নিভিয়ে অভ্যস্ত বজ্রাসনে বসলাম। বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন ছবি মনের মধ্যে এনে মনে মনে বলতে থাকলাম - আমাকে বাঁচতে হবে। পরিবারের জন্য। মেয়ের পড়ার জন্য। আমাকে সুস্থ থাকতেই হবে। মেয়ের বিএসসি, এমএসসি, পিএইচডি, চাকরি, স্বদেশ, বিদেশ ভ্রমণ.... কল্পনায় ভাসতে লাগলাম। অন্য ভাবনাকে দূরে সরাতে লাগলাম।
একসময় ঘুম এলো।
#lonelines, #writings, #goutamaalee
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন