হোন্নাইয়া কেম্পা ও বোবাদিদি।
কাগজে একটা খবর পড়লাম। কর্নাটকের একজন অন্ধমানুষ ভারতের সর্বোচ্চ পরীক্ষা, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করেছে। তাঁর নাম কেম্পা হোন্নাইয়া। তাঁর প্রথম কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ। তিনি এই রাজ্যে প্রথম অন্ধ আই এ এস।
অন্ধমানুষের কথায় হেলেন কেলারের কথাই মনে আসে। শুধু অন্ধ নন, তিনি কথা বলতে পারতেন না, কানেও শুনতে পারতেন না। তা সত্ত্বেও অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। অন্ধজনে আলো দান করেছেন।
একজন হেলেন বা কেম্পা এমনি এমনি হয়না। চারাগাছ যত্ন চায়। উপযুক্ত যত্ন পেলে সে মহীরুহ হবার সুযোগ পায়। হেলেন যেমন পেয়েছিলেন মা-বাবার কাছে তেমনি কেম্পা পেয়েছেন তাঁর জীবন সঙ্গীনির কাছ থেকে। কিন্তু এই উপযুক্ত যত্ন নেয়া যে কত কঠিন, ধৈর্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা, তা একমাত্র যাঁদের ঘরে এমন মানুষ আছে তাঁরা জানেন। কেম্পা হোন্নাইয়া যথাযথ বলেছেন তাঁর সম্বর্ধনায়, " এ সম্বর্ধনা, পুরষ্কার আমার প্রাপ্য নয়, আমার স্ত্রীর প্রাপ্য।" তাঁর স্ত্রীর নাম অচিন্তা। দুই সন্তানের মা।
আমার শৈশব ও কৈশোর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এমনি একজন মানুষ। আমার বড়দি, যাঁকে সবাই 'বোবা' নামে ডাকতো। যদিও সে ডাক সে শুনতে পেত না। তাঁর একটা নাম ছিল, যে নামটা সে লিখতে শিখেছিল দাদা বা ভাইদের অনুকরণ করে। সে নামে কেউ তাঁকে ডাকতো না। ডাকলেও কানে শুনতে পেত না।
আমরা সাতভাই, দুই বোন। দিদি তৃতীয়। পরিবারে প্রথম অক্ষর জ্ঞান বড়দার। একে একে সবাই কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে। শুধু বড়দি বা বোবাদি বাদে। অজপাড়াগাঁয়ে নিরক্ষর প্রধান গ্রামবাসীদের মধ্যে আমাদের পরিবার বিরলতম। যথার্থই গোবরে পদ্মফুল।
বোবাদি বড় হয়েছে অনাদর ও উপেক্ষায়।চৌদ্দ পনের বছর বয়সে এক বৃদ্ধের সাথে বিয়ে হয়। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দিদিকে ঘরে নিলেন। আমাদের দয়া করলেন। কিন্তু দিদি স্বামীর ঘর করতে চাইলনা, স্বামীর ঘরে থাকলোনা। সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এলো বাড়িতে। বারবার জোর করে নিয়ে যেত, আর দিদি চলে আসতো। ছোটবেলায় অসহায় ভাবে দেখতাম দিদিকে টেনেহিঁচড়ে লাঠিপেটা করে নৌকায় তুলতে। বছর খানেকের মধ্যেই দিদির বর ক্লান্ত হয়ে গেল। হাল ছেড়ে দিল। তার কয়েক বছরের মধ্যে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। মরার খবর পেয়ে দিদি প্রথমবার স্বইচ্ছায় শশুরবাড়ি গেল।শ্রদ্ধাদি করে ফিরে এলো বাপের ঘরে। অবহেলা, অত্যাচার তাঁর চিরসাথী হয়ে গেল।
আমরা, ভাইয়েরা, এক এক করে পূর্ববঙ্গের থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে লাগলাম। দিদি প্রমাদগুনতে থাকলো। সর্বশেষ এলাম আমি। ভিটে আঁকড়ে রইলো বাবা, জেঠিমা, দিদি। এবার বাবা ও জেঠিমাকে আসতে হবে। অবহেলার মর্ম বুঝেই দিদি আর আমাদের গলগ্রহ হতে চাইলনা। আগে কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে, সফল হয়নি। এবার সফল হলো। খাঁচা ছেড়ে পালালো, আমাদের মুক্তি দিয়ে গেল।
আমার দিদি হেলেন বা কেম্পার দলের মানুষ ছিল।তাঁরা যে যত্ন পেয়েছে, তার এক কণাও দিদি পায়নি। অধিকাংশ এমন মানুষেরা সে যত্ন পায়না। যদি পেতো তবে সেই সব মানুষদের জীবনও প্রাণবন্ত হতে পারতো, সফলতা পেতে পারতো।
শারীরিক অক্ষম মানুষদের উত্তরণের কত কাহিনী আমরা জানি। আমার দিদির জীবন, অসফল জীবন। এমন অসফল জীবনের ছড়াছড়ি আছে। কিন্তু কেম্পা হোন্নাইয়ার মত সফল জীবনও আছে। যেমন কৃত্রিম পা নিয়ে সুধাচন্দ্রন বিখ্যাত ডান্সার, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী মাসুদুর রহমান বৈদ্য। এরা প্রত্যেকে অসাধ্য সাধন করেছেন কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য মনের জোরে। এদের জীবনসংগ্রাম থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারি ?
কোন বাধাই বাধা নয়। লড়াই করলে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়। মনে রাখতে হবে -
যে পারে তাকেই লোকে মনে রাখে।
#motivation, #inspiration, #lifestyle
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন