জেদ
জেদ কি ভাল ?
সব ছোটদেরই শুনতে হয়, অত জেদ ভাল নয়। একবার রাত তিনটের সময় আমার ভাইঝি হঠাৎ ঘুম ভেঙে দাবী করল তাকে চকলেট দিতে হবে। ঐরাতে চকলেট কোথায় পাবে। কিন্তু তার অবিরাম চিৎকার এবং কান্না, তার চকলেট চাই -ই চাই। #insistence
ইতিহাসের হিটলার জেদ ধরল- ইহুদী শুন্য জার্মানি চাই। সেই সঙ্গে পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়ার জেদও প্রবল হল। মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধ। আর জেদের সমাপ্তি তার মৃত্যুতে।
তবে জেদের কি ভাল দিক নেই ? ভারতীয় পূরানে জেদের ছড়াছড়ি। রামায়নের শম্ভুক শিক্ষার জন্য জেদ ধরেছিল, মহাভারতের একলব্য অস্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য জেদ ধরেছিল। দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের মহানায়ক মাও সে তুঙের জেদ ছিল চিনের মুক্তির জন্য, সুভাষচন্দ্র বসুর জেদ ছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য।
জেদ না থাকলে ভাল কিছু, নতুন কিছু হয়না। জেদ ছিল বলেই বিধবা বিবাহ আইন সম্ভব করতে পেরেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ করতে পেরেছিলেন। জেদের জন্যেই আমরা রানী রাসমণিকে পেয়েছি।
জেদের সুফল যেমন আছে, কুফলও আছে। দেশভাগ- সেওতো কিছু মানুষের জেদের ফসল, যা এখনো অশ্রু ঝরায়, রক্ত ঝরায়।
আমার জীবন যতই ক্ষুদ্র হোক, জেদের একটা ভূমিকা আছে। জীবনের নানা স্তরে জেদ উত্তরণ ঘটিয়েছে।
স্কুলে ভাল ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলাম না।ক্লাশে কম-বেশি পঞ্চাশ জনের মত ছাত্র-ছাত্রী থাকত। আমার ক্রমিক নম্বর ছিল পঞ্চাশের কাছাকাছি। ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত দুটো বিষয়ে আমি কখনোই পাশ করতে পারতাম না। অংক আর ইংরেজী।
স্বাধীনতা দিবসে (দিন নয় দিবস হিসাবে চর্চিত ) স্কুলে দিনভর অনুষ্ঠান হত। নানা প্রতিযোগিতা হত।আবৃত্তি, গান, বক্তৃতা, খেলা ইত্যাদি। তেমনি একদিন। বক্তৃতার বিষয় আগে থেকে ঠিক ছিল।বিষয় - স্বাধীনতা। গ্রামের এক দাদা একটা পাঁচ মিনিটের ভাষন লিখে দিলেন। কয়েকদিন ধরে ঠোঠস্থ করলাম আর নির্দিষ্ট দিনে ঝেড়ে দিলাম।হলঘর হাততালীতে ভরে গেল। বেশ গর্ব হল , আমিও পারি !
কিন্তু আরও অবাক হলাম ফলাফল দেখে । আমি প্রথম ! ফার্স্ট প্রাইজ আমার ! সবচেয়ে বড়কথা - কাদের হারালাম ? দুটো ক্লাশের দুইজন ফার্স্টবয়কে। আমাদের ক্লাশের আর নিচের ক্লাশের দুইজন সবচেয়ে ভাল ছাত্রকে, যারা কখনো দ্বিতীয় হয়না। তাদের হারিয়ে প্রথম ! #persistence
নিজের মধ্যে এক আত্মবিশ্বাস জন্ম নিল, আমিও পারি। হ্যা আমি, ফেল করে যে প্রতিবছর ক্লাশে ওঠে, সেই আমিই কখনো কখনো অন্যদের ছাপিয়ে যেতে পারি !
এর কিছু পরের ঘটনা। আমাদের স্কুলের পাশে একটা বিল, সারা বছর জল থাকে। সেই বিলে স্নান করতে কয়েকজন বন্ধু গেলাম। আমাদের ফার্স্ট বয় ( মনিলাল বিশ্বাস, সম্প্রতি করোনা তাকে গ্রাস করেছে। কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে স্মরণ করি।) একটা প্রতিযোগিতার কথা বলল। কে বেশিক্ষণ জলে ডুবে থাকতে পারে। পুরষ্কার নেই, কিন্তু মর্যাদা আছে। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজও ওকে আমি হারাবোই। যদিও জানতাম ওকে হারানো খুব কঠিন। চৌকশ ছেলে। খেলা, পড়া, বদমাহিশী - সবকিছুতে ও সেরা, যাকে বলে অলরাউন্ডার। #insistence
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। একজন বাদে সবাই ডুব দিলাম। মাটি আকড়ে পড়ে রইলাম। কান সজাগ, কয়জন জলের উপর ওঠে সেই শব্দ শোনার জন্য। অনেকক্ষন নীরব। তারপর এক এক করে জল ভাঙ্গার শব্দ। এক... দুই... তিন...
ফুসফুসের অক্সিজেন কমে আসছে, আর টিকে থাকা যাচ্ছে না জলের তলায়। শরীর বিদ্রোহ করছে। কিন্তু একটা শব্দ এখনো বাকি। প্রতিটি মুহূর্ত বেশ লম্বা মনে হচ্ছে।... অবশেষে শেষ শব্দটি পেলাম। আরো একটু সময় দাঁত কামড়ে থেকে আস্তে আস্তে জলের উপর ভেসে উঠলাম। ভাবখানা এমন, এসব আমার কাছে জলভাত !
সেদিন আমাকে বিজয়ী মনে হয়েছিল। ক্লাশের এক নম্বর আর পঞ্চাশ নম্বরের ফারাক মুছে গিয়েছিল। আবার মনে হল, আমিও পারি, অসম্ভবকে সম্ভব করতে আমিও পারি।
আরেকটি ঘটনা। আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
অষ্টম শ্রেণী। তখন অংকের রক্তচক্ষুর ভয় আর পাইনা। বীজগণিত আর জ্যামিতিকে কব্জা করে ফেলেছি। কিন্তু ইংরেজী মাষ্টারমশাইয়ের রক্তচক্ষু আর জোড়াবেত এড়াতে পারছি না। তেমনি এক ইংরেজী ক্লাশে শিক্ষকমশায় (শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ কর্মকার ) জিজ্ঞেস করলেন, পারলাম না। একপা বাড়িয়েই ছিলাম, বাকি পা তুলে হাইবেন্চের উপর দাড়ালাম। আরো কয়েকজন দাড়ালো। প্রতিক্ষা করছি জোড়াবেতের মারের জন্য।
কিন্তু প্রত্যাশিত ঘটনা সেদিন ঘটলো না। স্যর মাঝপথে আমাকে বসিয়ে দিলেন। অন্যরা দাড়িয়ে রইল। আমি অবাক হলাম।
স্যর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু সময় চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রইলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, "আমার লজ্জা করে তোকে পড়া না পারার জন্যে বেঞ্চের উপর দাঁড় করাতে। আমার লজ্জা করে এটা ভাবতে যে তুই আমার স্যরের ভাই।"
তারপর স্যর ক্লাশ ছেড়ে চলে গেলেন।
হঠাৎ আমি একটা ধাক্কা খেলাম। যে ধাক্কা হাই বেঞ্চ বা ডবল বেতের মার দিতে পারেনি। সেই ধাক্কা পেলাম আমার দাদার ছাত্রের অভিমান থেকে। আমি কি তবে দাদার কুলাঙ্গার ভাই ! কিছুই পারিনা ! আমার বড়দা এই স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে পড়েছেন । এই স্কুলের মেধাবী, সৎ ছাত্র একদা এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন ! আমার জন্যে সেই দাদার ছাত্র, আমার শিক্ষক মহাশয়, লজ্জা পান ?
আমার জীবনের সেই এক বাঁক। একটা পরিবর্তন এলো নিজের মধ্যে। একটা জেদ চাপল নিজের মধ্যে। আমার জন্যে আমার দাদাকে, স্যরকে আর লজ্জা পেতে দেবনা। যদিও গোড়ায় গলদ, তবুও চেষ্টা করতে লাগলাম। অষ্টম শ্রেণীতে আমার ক্রমিক নম্বর ছিল বিয়াল্লিশ, নবম শ্রেণীতে হল সতের। মাধ্যমিক যখন পাশ করলাম, নম্বরের ভিত্তিতে আমার ক্রমিক নম্বর তিন। জেদকে চাগিয়ে দেবার জন্য আমি শিক্ষক মহাশয় এবং দাদার কাছে আমরন ঋণী।
জীবন যুদ্ধে নানা কারণে হতাশা আসে। হতাশায় ভেঙে না পড়ে পথ খুঁজতে হয়, হতাশা কাটিয়ে উঠতে হয়। আমার মত ফেল করা ছাত্র যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে আপনি কেন পারবেন না ? পারবেন। বিকল্প পথ খুঁজুন। হতাশাকে জেদে পরিনত করুন। সাফল্য আসবেই। নিজের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে - আমি পারবো, পারবোই।
মনে রাখতে হবে : জীবনটা এক যুদ্ধক্ষেত্র, সে যুদ্ধে লড়তেই হবে।
#goutamaalee, #motivation, উৎসাহ, #insistence
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন