মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

কবিতা চর্চা : কাশ্মীর।

কবিতা চর্চা : কাশ্মীর
কাশ্মীর মানে গরম খবর। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী একটা অত্যন্ত জটিল সমস্যার চটজলদি সমাধান করা হল। আমি চাই, সমাধান যথার্থই সমাধান হোক। মানুষ শান্তিতে বসবাস করুক।

কাশ্মীর নিয়ে আমি অন্য যন্ত্রণা অনুভব করি। আমার যন্ত্রণা পাঞ্জাব ভাগের যন্ত্রণা, আমার যন্ত্রণা বাংলা ভাগের যন্ত্রণা। দেশভাগ ভারত উপমহাদেশের এক স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে। কাশ্মীরিদের যে যন্ত্রণা ছিল, সে যন্ত্রণা আরো বেশি তীব্র হল কাশ্মীর আবার ভাগ হওয়ার জন্য। কাশ্মীর যেন লুটের বাতাসা। চিন নিল, পাকিস্তান নিল, ভারত নিল। নিয়েই ক্ষান্ত হল না । একটা জাতিসত্তাকে খন্ডবিখন্ড করে দেয়া হলো। যেমন করা হয়েছে বাংলার ক্ষেত্রে। বাংলা যেন পচা মাংসের আধার। শকুনেরা তাকে টেনেহিঁচড়ে ভাগ করেছে।শুধু পূর্ব আর পশ্চিম নয় সে বিলিয়ে গেছে বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরার মধ্যে। আরো ভাগের চর্চা চলছে।
          বাংলাভাগের কষ্ট নিয়ে আমি কাশ্মীরকে দেখি। বাঙালি জাতিসত্বা বিভাজনের যন্ত্রণা নিয়ে আমি কাশ্মীরকে দেখি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিজের কষ্ট, আনন্দ, যন্ত্রণা শব্দের মাধ্যমে ধরতে। সে চেষ্টা কখনো কবিতার মত দেখতে হয় কিন্তু কোনমতেই কবিতা হয়ে ওঠেনা। তবুও লিখি। তেমনি কাশ্মীর নিয়ে আমার লেখার চেষ্টা।

কারা যেন বলেছিল হিটলারের সমাধী হয়েছিল বাঙ্কে
সভ‍্যসমাজে তার পূনরুথ্থান হবেনা কখনো,
তার নাম উচ্চারিত হবেনা রাজ-অন্তরালে।
তবে এ দামামা কিসের ?
গণতন্ত্রের কফিনে কার উচ্চারণ 
আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া
এই ভারতবর্ষে ? এই বাংলায় ?

সেদিনের জার্মানি ঘোষণা করেছিল-
  জাজ মিউজিক বন্ধ
  হিটলারের ছবি থাকবে রাস্তায়, কোনে কোনে
  নাজির বিরুদ্ধাচারী সব বই ধংস হবে
  ইতিহাস হবে নাজির চিন্তার বাহক।

আজকের ভারত জানান দিচ্ছে-
   "এখন গনতন্ত্র একটা দলের জন‍্যে,
   এখন স্বর হবে একজনের, এক ধারনার"
   হুবহু হুঙ্কার এক, এক রক্ত-চারা !

এ স্পর্ধিত স্বর আমার গনতন্ত্র নয়;
হে মানুষ, তুমি গনতন্ত্রের সশস্ত্র প্রহরী,
তোমার আঙ্গিনায় রোপন করলাম
আমার স্বর, বিরুদ্ধ উচ্চারণ
বেঁচে থেকে হোক মহীরুহ
মানুষের জন্য।।

লেখার পরে পড়লাম। একি হলো ! কী বলতে চাইলাম আর কী লেখা হলো ! কোথায় দেশভাগের সে জ্বালা, যন্ত্রণা ? 
আবার কলম ধরলাম।

     আসলে এটা উৎসব।

     সেই কবে রবীন্দ্র-রানী প্রজাদের বাড়ি ঘর
     পুড়িয়ে উৎসবে মেতেছিল
     সেই ধারা চলছে, অহরহ।

     রাজারা সাতভাই।
     ক্ষমতার পিঠে ভাগ করতে গিয়ে
     পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করল।
     প্রজা   সেতো পরজীবী,
     কিবা যায়-আসে মহারাজাদের ?
     জন্মস্থান, ভাষাস্থান, ধর্মস্থান
     আবেগের শিকড়ে কুঠার হানলো তারা।
     অথচ এখনো, শতবর্ষের পথে এগিয়ে চলা
     স্বাধীনতাকে শুনতে হয় দীর্ঘশ্বাস, 
     মিলখা সিং ঋত্বিক ঘটকের হা-হুতাশ !

     আবার উৎসব। আবার মহোৎসব।
     আবির মিষ্টি বাজি
     নাচ গান আলোর রেশনাই ।
     পাঞ্জাব বাংলা্য পর এবার কাশ্মীর,
     ভেঙ্গে দাড়া এবং শির
     খন্ড খন্ড করে একটা জাতিসত্বা ; বিলীন !

     আসলে এটা উৎসব,
     এক দেশ, এক ভাষা, এক জাতি গড়ার
     অনন্য প্রয়াস।

     কবে আর হাড় থেকে জন্ম নেবে
     তোমার আমার মুক্ত পাহাড় ?

কাশ্মীর আছে ধর্ম থাকবে না ? স্বাধীনতার পর থেকে ধর্মই তো শাসকদলের বর্ম। নির্বাচন এলেই এ বর্ম আটোসাটো হয়ে ওঠে, অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায় দুটো নাম- পাকিস্তান আর কাশ্মীর। দেশাত্মবোধের অনুপ্রেরণায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় লিপ্ত হই। নিজের অন্তরে বিদ্বেষের বিষ লালন করি। সে বিষে অন‍্যের ধর্ম, অন‍্যের দেশ বিদ্বেষের লক্ষ্য হয়ে যায়।
          সন্ত্রাসীদের অনেক ক্ষেত্রেই শাসক তৈরি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। প্রতিবেশী রাষ্ট্রও তাই করছে। কিন্তু তাদের থেকে রক্ষা করার দায় সরকারের। তার জন্য সমগ্র রাজ‍্যবাসী সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না। নাগরিক যদি গনতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়ে তার জন্য সন্ত্রাসী তকমা পেতে পারে না। 
           কাশ্মীর ভাগ মেনে নিতে পারেনি কাশ্মীরের আমজনতা। তাইতো খবরে ছাপা হয় কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত পন্ডিতদের আন্দোলনের কথা। সেই পরিক্রমায় যদি সন্ত্রাসবাদীদের দেখি তবে ভগৎ সিং, সুভাষচন্দ্র, মাও সে তুং, চে, মেন্ডেলা... সবাই সন্ত্রাসী, যাঁরা পরবর্তীতে দেশপ্রেমিক যোদ্ধা।
          
ধান ভানতে শিবের গীত ?  আবার কলম ধরি।

   পরাধীন ভারতে একদল মানুষ
   মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল,
   মানুষ মারছিল, নিজেরা মরছিল।
   ইংরেজ শাসক বলল, ওরা সন্ত্রাসবাদী।
   ওদের ধরলো, মারলো।
   সন্ত্রাসবাদী দুই প্রদেশ ভাগ করে দিল,
   তৃপ্তির ঢেকুর উঠল মুখে।

স্বাধীনদেশে সন্ত্রাসবাদের তকমা গেল পাল্টে,
তাঁরা হলেন দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী,
অগ্রপথিক, প্রণম‍্য।

   ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হল,
   পরাধীন হল কাশ্মীর।
   প্রবল প্রতাপ মুঘল বা বানিয়া ইংরেজ শাসনে
   যাঁরা ছিল উচ্চশির, তাঁরা খন্ডিত হল
   তিনটি প্রতিবেশী দেশ তাঁদের খাবলে খেল,
   পরাধীন হল কাশ্মীর।

   পরাধীন কাশ্মীরের একদল মানুষ
   মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য লড়লো
   মানুষ মারলো, নিজেরা মরলো ।
   শাসক বলল, ওরা সন্ত্রাসবাদী।
   ওদের ধরলো, ওদের মারলো।
   সন্ত্রাসবাদী কাশ্মীরকে আবার ভাগ করে দিল,
   তৃপ্তির ঢেকুর উঠল মুখে।

   স্বর্গ যদি কখনো স্বাধীনতা পায়
   ওঁরা কি তখনো দেশপ্রেমিক হবে ?
   ওঁরা কি হবে স্বাধীনতা সংগ্রামী ?
   অগ্রপথিক এবং প্রণম‍্য ?

কথিত আছে আদি কবি বাল্মীকির যাত্রাপথে এক ব‍্যাধ একটি পুরুষ পাখি তীর দিয়ে মারে। স্ত্রী পাখির করুন কান্নায় বাল্মীকি বিচলিত হন। ব‍্যাধের উপরে রেগে যান এবং অভিশাপ দেন --

   মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
   যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমভধীঃ কামমোহিতম্ ।

সংস্কৃত ভাষায় এটাকেই প্রথম কবিতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যেকথা বলার, এক্ষেত্রে বাল্মীকি নিজের মুখের ভাষায় নিজেই অবাক হয়ে যান, তাঁর মুখ দিয়ে অন্তর থেকে যে ভাষা বেরিয়ে এলো- তা স্বতস্ফূর্ত, আরোপিত নয়। আমি বাঙালি হয়ে কাশ্মীরিদের অন্তরের কথা লিখতে চাইছি যা আরোপিত। তাই সে যন্ত্রণা আমার নেই যা তাঁদের আছে। কাশ্মীরের মানুষের যন্ত্রণা বোঝার অন্তর্স্থিত ক্ষমতা আমার নেই।আমি যতবার লিখতে চেষ্টা করছি, সেটা আমার ব‍্যথা, আমার রাগ বা আবেগ প্রকাশ পাচ্ছে। সংস্কৃতির নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অন‍্যের ভাষা-সংস্কৃতি-দেশ হারানোর যন্ত্রণায় মরচে ধরেছে।।


     


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...