রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ছোটগল্প : আলোর পথিক


আলোর পথিক


সুনাম ছিল। দূর্নামও ছিল। ছোটবেলা থেকেই। পাড়াপ্রতিবেশী, সমবয়সীদের মধ্যে একডাকে চিনত সবাই। রাজপুত্তুর ছিল না মোটেই। লেঠেল খুড়োর ব্যাটা। মাটির দাওয়া, খড়ের ঘর। একগাদা ভাইবোন। কে যে ছোট, কে যে বড় হঠাৎ বাইরে থেকে বোঝবার উপায় ছিল না মোটেই। ধূলো-বালির মাঝে গড়াগড়ি দিতে দিতেই একসময় প্যান্ট পরেছে। তার মত তার ভাই-বোনেরাও। লেঠেল খুড়োর সামর্থ ছিল না যেমন, তেমনি প্রয়োজনও ছিল না তেমন। এটাই হাল চাল। ওদের যেমন, আশে-পাশে দশ ঘরেরও তেমন। সবাই রাজা। যে যার মতো চলে। খায়, না খায়। মাছ ধরে, জন বিক্রি করে। আয়ের ঠিক নেই, ব্যয়ের ঠিক নেই, খাবারেরও ঠিক নেই। ঝগড়া করে, মারামারি করে। ভালবাসে। সব বিভেদের মধ্যেও ভালবাসা আছে। আছে বটে। অন্য কিছু দেবার মত নেই বলে ভালবাসা দিতে কার্পণ্য করে না। যদিও তা নিয়ে গর্বে নাক ফুলিয়ে চলে না। খোলা আকাশের নিচের এই মানুষগুলি আকাশের মত বড় হৃদয় নিয়ে বড় হয় আপনা থেকেই।

সে এককান্ড বটে। কটা দিন জন-মজুরী করতে পারে না লেঠেল খুড়ো, ধার করা সামান্য চাল বা আটা দিয়ে দিব্যি চালিয়ে দেয় অতগুলো মানুষ। যা সামান্য ভাগে পায়—চেটে পুটে খেয়েও খিদে ঢাকতে হয় অফুরন্ত জল খেয়ে। খিদে যখন আনাচে কানাচে ঘাপটি মেরে আছে, সেই সময় মাংসের ব্যবস্থা করে লেঠেল খুড়ো। টাটকা মাংস। বাড়ির উঠোনে ফাঁদ পেতে নিরীহ চড়ুই ধরে। গোটা দশ বারো চড়ুই কিচির-মিচির করতে থাকে হাঁড়ির মধ্যে। গামছা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বাঁধা। ফুরুৎ-ফারাৎ করে কিছুক্ষণ বাহাদুরি দেখায় হাঁড়ির ভিতর। তারপর নিস্তেজ হতে থাকে। ধুকপুক করতে থাকে তারা। মরনের ভয় যেন পেয়ে বসে চড়ুইদের। আর সে ভয় সঞ্চারিত হতে থাকে খুড়োর ব্যাটার মনে।

মাংসের স্বপ্নে সবাই যখন বিভোর, ব্যাটা তখন পেটের খিদের কথা ভুলে যায়। মনের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়ের বিরোধ চলতে থাকে। তাদের খিদের জন্যে কতগুলি নিরীহ প্রাণীর প্রাণহানি! মানতে পারে না। টানা-পোড়েন চলে মনে। অবশেষে যথাসময়ে জল্লাদের দায়িত্ব পায় সে। হাঁড়ি থেকে একটা চড়ুই বের করে। ভয়ে জড়-সড় চড়ুইটা। সে যেন তার ভবিতব্য জেনেই গেছে। হাতের চড়ুইটা দেখতে থাকে সে। কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় তার। সবকিছু দুলতে
থাকে। টালমাটাল হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। হাঁড়িটার উপরই পড়ে। হাঁড়িটা ভেঙ্গে যায়। দাঁতে দাঁত লেগে যায় লেঠেল খুড়োর ব্যাটার। দেহটা বেঁকে যায় ধনুকের মত। ছুটে আসে মা। ছুটে আসে বাবা। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ছেলেকে সুস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই। চোখে মুখে জল দেয়। তালপাতার পাখার হাওয়া করতে থাকে। সবার আশংকা কাটিয়ে অবশেষে ধাতস্থ হয় সে। আড়চোখে হাঁড়ির দিকে তাকায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ভয়ার্ত পাখিগুলি ততক্ষণে ফিরে গেছে তাদের আকাশের ঠিকানায়।  লড়াইটা জেতার আনন্দে পাশ ফেরে।

 ছোট গাছের মাঝে দু'চারটা বড় গাছ থাকে। সবকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আনন্দে তারা বড় হ’তেই থাকে। অনেক উঁচু, অনেক আলো, অনেক বাতাস। গরীব গুরোব  মানুষের কুঁড়ে ঘরের মাঝেও আছে বড় বাড়ি। লক্ষ্মী তাদের ঘরে বাঁধা। বাপের বোঝা হাল্কা করতে লেঠেল খুড়োর ব্যাটাও বাঁধা হয়ে যায় লক্ষ্মীবাসীর ঘরে। ছক বাঁধা জীবন—একদা বাপ ছিল এখন সে। খায়-দায় গরু চরায়। ঘরে ফেরে। ফাই-ফরমাস খাটে। ভাত যেমন খায় তেমনি মারও খায়। কিন্তু তাতে তার কষ্ট হয় না খুব। কষ্ট হয় অন্য কারণে। লক্ষ্মীবাসীর ঘরে আরো দু'জন লক্ষ্মী ছেলে মেয়ে আছে। তার মতন। তারা খায় দায় তবে মাঠে যায় না। স্কুলে যায়। সাধ হয় তার। সুযোগ পেলেই তাদের ধারে কাছে থাকে। তাদের পড়া শোনে, লেখা দেখে। মনে রাখে আর অক্ষরগুলো আঁকতে চেষ্টা করে। কখনো গাছের পাতায়, কখনো মাটিতে। সময়ের সাথে সাথে একদিন আবিষ্কার হয় সে লিখতে পারে, পড়তে পারে। লক্ষ্মীবাসীর ছেলে-মেয়ের মত। যদিও দুইজন স্কুলে যায়, সে যায় গরু চরাতে।

খিদে পাগল প্রাণীর মত খাবার খোঁজে সে। অজানার অন্ধকারে আলো ঢুকে পড়ে। আলো ঢুকে যায় হুড়মুড় করে। অস্থির হয়। সে অস্থিরতা লোভ দেখায় তাকে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবার লোভ। আলো তাকে টানে। সেই টানে একদিন গ্রাম ছাড়ে। দিগন্ত রেখা পেরিয়ে, হেঁটে গাড়িতে পৌঁছে যায় ইচ্ছাপূরণ শহরে। শহরের ইট-কাঠে ঠোক্কর খেতে থাকে। অবশেষে আস্তানা জোটে। তারই মত আরেক জনের সাথে। রাতের প্লাটফর্মে হাঁটুমুড়ে শীত কাটাতে কাটাতে আলাপ হয়। বাঁচার তাগিদে জোড় মানিক হয়ে ওঠে তারা।

ব্যস্ত প্লাটফর্ম ঘিরে বেড়ে ওঠে লেঠেল খুড়োর ব্যাটা। খাবার জুটে যায় নানা ভাবে। কত মানুষ আসে, কত মানুষ যায়। আর তাদের ঘিরেই কত বিচিত্র জীবিকা। কেউ ভিক্ষে করে, কেউ হকারী, কেউ দালালি, চুরি করে, পকেট কাটে, মুটে বয়। দলাদলি করে, মারামারি করে। তার মধ্যেই পরগাছার মত বেঁচে থাকতে চায়।

প্রথমে ভিক্ষে করতে চেষ্টা করে। বেড়ে ওঠা তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেকে কেউ ভিক্ষা দিতে চায় না। বাড়তি উপদেশ দেয় কিছু। কাজ করার কথা বলে। কিন্তু কাজ কেউ দেয় না। ভিক্ষে করতে তার ইচ্ছে করে না একদম। তবু করতে হয়। ধরণ পাল্টায়। গলায় চাবি ঝুলিয়ে জীবনের চাবি খুঁজতে চেষ্টা করে। বাপ মরা ছেলের মত দুই বন্ধু হাত বাড়ায়। আজ এখানে কাল ওখানে। প্রথম কিছুদিন ভালই জোটে। কিন্তু চাবি হঠাৎ আটকে যায়। অসংখ্য মানুষের মাঝে কিছু মানুষের চোখ ক্যামেরা হয়ে যায়। তাদেরই কারো কারো কাছে ধরা পড়ে। জেরা করে তারা। পয়সা দেয় না। কিন্তু নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে –      - কটা বাপরে তোর......
- কত নম্বর বাপ মরলরে............ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ কাজ ছাড়তে হয়। কিন্তু বেকার তাদের থাকা হয় না। কাজ এসে হাজির হয়। এক দাদার নজরে পড়ে। দাদা কাঁধে হাত রাখে দুইজনের। ডাকে -' আয়'। তারা যায়।
বলে—'খা'। তারা খায়।
বলে—‘দেখ’। তারা দেখে।
 বেশ ফুর্তিতে কাটে তাদের কয়েকটা দিন। দাদার ছায়া হয়ে ঘোরে। খায়-দায় দেখে। দিনে দেখে। রাতে দেখে. পোষাক পরা মানুষ দেখে। পোষাক ছাড়া মানুষ দেখে। আর এর মাঝেই দাদা কিছু কাজ শেখায়। মানুষের মনোযোগের আড়ালে সরে যাওয়া। আসল কাজটা দাদাই করে, তারা শুধু বমাল সরে যায়। চলন্ত বাসে, ট্রেনে বা মানুষের ভিড়ে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে একদিন। হাল্কা ভিড়ের ট্রেনে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। দাদা ছিল দরজার কাছে। দাদার ফিচকে হাসিকে অনুসরণ করে তাকাল সামনের দিকে। দশ-বারো বছরের মেয়ে। তেলহীন মাথায় এলোচুল। মাথায় একটা পুঁটলি। গায়ে পিঠ খোলা ফ্রক। হাত তোলা বগলের কাছে সেলাই খোলা। দাদার ফিচকে হাসির ইঙ্গিত বোঝে সে। কিন্তু অনুভূতির তারতম্য ঘটে হঠাৎ। অন্য সময় থেকে আলাদা হয়ে যায়। এক ঝলকে নিজের এক দঙ্গল ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে। অগোছালো পিঠ খোলা মেয়েটার মধ্যেই যেন তারা মিলে মিশে আছে।

পিঠ খোলার সঙ্গে আরো দুইজন। বয়স্ক মানুষটি হয়তো বাবাই হবে। ইতিমধ্যে ট্রেন দাড়াল প্লাটফর্মে। সবাই নামতে সচেষ্ট হয়। জ্যাম তৈরি হয় নামার মুখে। ঠেলাঠেলির মধ্যে হাতে পায় কিছু। দাদার হাত থেকেই। অভ্যেসমত নিজেদের পকেটে চালান দিতে দিতে ভিড়ের থেকে পিছনের দিকে সরে যায়। অন্য দরজা দিয়ে নেমে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। দাদাও এতক্ষণে হাওয়া।

যার পকেট থেকে গেল, বুঝতে পারল না তক্ষুনি। কিন্তু ভিড় হালকা হতেই হাহাকার করে উঠল পিঠ খোলার বাবা। গাঁয়ের মানুষ। সামান্য সম্বলটুকু চুরি যাওয়ায় সন্তানহারা যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠল। তার হাহাকারে অচল হয়ে গেল লেঠেল খুড়োর ব্যাটার পা। মেয়েটার মধ্যে যে ছায়া দেখেছিল, সেই ছায়া দেখতে পেল বয়স্ক মানুষটির মধ্যে। যেন কঁকিয়ে উঠছে তার বাবা। দিনের শেষে কিছু চাল বা আটা কেনার সামর্থ্যটুকু হারিয়ে ফেলেছে। আর সেই সামর্থ্যটুকু অনায়াসে জমা পড়ে আছে তার পকেটে। অস্থিরতা স্থিরতায় পৌঁছায় অকস্মাৎ। বয়স্ক মানুষটাকে ঘিরে জটলার দিকে এগিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া সম্বলটুকু মেলে ধরল মানুষটার সামনে। কৃতজ্ঞতায় সজল চোখ চক্‌ চক্‌ করে ওঠে। কিন্তু ভিড় করা মানুষগুলি চঞ্চল হয়ে ওঠে অন্য প্রাপ্তিতে। একজন অধঃপতিত নাগরিককে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তৎপর হয়।

‘পকেটমার................ মাথায় গোত্তা দিল একজন।
“শুয়োরের বাচ্চা.... থাপ্পড় দিল আরেকজন।
‘পালের গোদা কোথায় বল্  ........... পিঠে পড়ল দুম করে।
খাঁচায় পোরা পশুকে খুঁচিয়ে মারতে ব্যস্ত সবাই। কৃতজ্ঞ বয়স্ক মানুষটা কিছু বলতে চাইল, বলতে পারল না। মানুষের ভিড়, চিৎকারে চাপা পড়ে গেল।
‘বান্ চো .............মুহূর্তের মধ্যে বজ্র নিনাদে বজ্রমুষ্ঠি নেমে এল তার মুখের উপর। অন্ধকার হয়ে এল চারিদিক। জ্ঞান হারাবার আগে দেখল বজ্রমুষ্ঠির মালিক তাদের দাদা—এক থেকে বহু, বহুতর হয়ে তেড়ে আসছে তার দিকে।

জ্বরে, ব্যথায় কয়েকদিন প্রায় বেহুশ থাকার পর বুঝতে পারল সে শুয়ে আছে একটা ঘরে। রেল লাইনের ধারে কালো পলিথিনের দোচালা ঘরে। ঘরে এককোনে একটা পুরনো টিনের সুটকেস্। কিছু জামা-কাপড়-কাঁথা এখানে সেখানে। স্যাঁতসেঁতে ঘরে খেজুরের পাতার মাদুরের উপর সে শুয়ে। ঘরে যাওয়া-আসা করছে যে, তাকে সে চেনে। আধকানা মেয়েটা। কালো। দেখতে ভাল না। আগে কথা বলেনি কোনদিন। যদিও ওর চিকন গলায় বেসুরো ‘সাধের ময়নারে - গান শুনেছে কখনো সখনো।

গরীব মানুষ। কথার ফুলঝুরিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। লেঠেল খুড়োর ব্যাটা একটু চলার মত হলে বন্ধুর হাত ধরে আবার ফিরে যায় আগের আস্তানায়। আশ্রয়দাতার সামনে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে নিজের বড় হয়ে ওঠা নখের ময়লা খোটে। 'আসি' বলে চলে আসে। আপদ-বিপদে প্রতিবেশীই তো পাশে দাঁড়ায়, ভাবখানা তেমনই। শীতের সকাল সহজে আসে না। কিন্তু শীতের সন্ধ্যের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না, সে তাড়াতাড়ি আসে। তারপর রাত, সে যেন বরফের তৈরি এক দানব। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। ছেঁড়া কাঁথা কম্বলগুলি যেন জমে যেতে থাকে। অগত্যা খোঁজ করতে হয় ঘুপচির, যেখানে বাতাস সহজে ঢোকে না। অথবা মানুষের জটলা —মানুষের গরম নিঃশ্বাস, গায়ের ওম, কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকা—শীতকে দূর রাখে কিছুটা।

পৌষসংক্রান্তি এসে গেছে—এ খবর তাকে দিতে হয় না। ক্যালেন্ডার দেখারও দরকার হয় না। সে বুঝতে পারে মানুষের ঢল দেখে। দলে দলে সাধু সন্ন্যাসী যখন ট্রেনে করে ষ্টেশনে নামে, দল বেঁধে যেখানে সেখানে বসে থাকে, গাঁজার ধোঁয়ায় ম-ম করে, উৎসব উৎসব ভাব এসে যায় সারা ষ্টেশন চত্বরে। আর এই সব দেখতে দেখতে প্রতিবৎসরের অভিজ্ঞতা তাকে জানান দেয় পৌষসংক্রান্তির কথা।

হাড় কাঁপানো শীতকে সামাল দিতে মাঝ রাতে এমনি এক সাধুদের জটলায় ঢুকে চুপ চাপ বসে থাকে সে। অবাক হয় এক সন্ন্যাসীকে দেখে। বা হাতে গাঁজার কল্কেয় টান দিচ্ছে। গাল ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ছে. মাঝে মাঝে 'ব্যোম-ভোলা..... বলে চিৎকার করছে। সাধুর ডান হাত উপরের দিকে তোলা। সে হাত যেন স্বর্গে যেতে সদা ব্যস্ত। একবারও নিচে নামছে না। বাঁ হাতটা শক্ত, সবল, ডান হাতটা রুগ্ন যেন দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভোগা কোন শিশু।

কৌতূহল না মেটা পর্যন্ত শান্তি পায় না। তার পাশে বসা না সাধু এক বাবাকে তার সাধ্যমত হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে—ও হাত উপর দিক্‌মে কিউ ?

—বিশ সাল পহেলে ও হাত ভগওয়ান কেদারনাথকে লিয়ে উৎসর্গ কিয়া হ্যায়। আউর বিশ সালসে ও হাত য়্যায়সেই উপর করকে খাড়া হ্যায়।

—বিশ সাল! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। সে আরো জানতে পারে ভগবান কেদারনাথ সাধুবাবার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন। তিনি সাধুবাবার ভেট গ্রহণ করেছেন। কারণ সাধুবাবার ডান হাত এখন আর নিচে নামান যায় না।
ইচ্ছে করলেও হাত নামাতে পারেন না, হাতে কোন শক্তি পান না। ভগবান কেদারনাথ ভক্তের দান গ্রহণ না করলে এমনটা হবে কেন ? যদিও ছেলেটি অবাক হয় কিন্তু একটা কথা বোঝে তার নিজের মত করে। সে বোঝে সাধুবাবার ডান হাতে জং ধরে গেছে, যেমন ব্যবহার না করতে করতে ধরে জানালা দরজার কব্জায়। 
আবার একটা সহজ আয়ের খোঁজ পায় সে। খবর যে বন্ধু দেয় সে যেন আর তর সইতে পারে না। টাকার খনির খবর দেয় সে। গঙ্গার ঘাটে নাকি অঢেল পয়সা। তীর্থ যাত্রীরা, ভক্তরা নাকি মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে মুঠো মুঠো পয়সা ফেলছে গঙ্গার ঘাটে— শুধু তুলে নিলেই হল। অতএব এক উত্তেজনাময় রাত পোহানোর পর দুই বন্ধু সকালের ট্রেনেই হাজির হল মায়ের থানে। মায়ের মন্দিরে লম্বা লাইন—সাপের লেজের মত। প্রচুর লোক গঙ্গার ঘাটেও। স্নানের ভিড়, মানুষের ভিড়। তার মত অসংখ্য ছেলেমেয়ের ভিড়ও সেখানে। তারা সব জলে কিলবিল করছে। ঘাটের কাছে আসা প্রতিটা মানুষের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছে। জরিপ করছে প্রত্যেককে কার মুঠো আলগা হতে পারে। প্রত্যাশিত মানুষটি চোখে পড়ে গেলে একলব্যের একাগ্রতায় তাকে অনুসরণ করা। মুঠো আলগা হলেই যাতে ক্যাচ ধরা যায়। কিন্তু মুঠো আলগা করার লোক সংখ্যায় বড় কম। আবার মুঠো মুঠো শব্দটা কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে এখানে। গল্পের কাঁঠাল মাটিতে দেখে বন্ধুটি কেমন হতাশ হয়ে গেল। সে বলল—চল্ বে নেমে পড়া যাক।

জলের মধ্যে কয়েকগন্ডা সিঁড়ি নামল ওরা। অন্যদের সঙ্গে মিশে যখন মাটিতে হাতড়াতে লাগল, তাদের থেকে ছোট একটা মেয়ে একটু দেখল ওদের। তারপর কি ভেবে উপরে উঠে গেল। একটু পরে মেয়েটি আবার ফিরে এল। সঙ্গে একটা লোক— হাফ সাধুবাবার মত, চোখ লাল, ভাঁজ করা লুঙ্গি পরা। মেয়েটি আঙ্গুল দিয়ে ওদের দেখাল। লোকটা হাতের ইশারায় ডাকল তাদের। নিমপাতা মেশান গলায় জিজ্ঞেস করল –কে এনেছে তাদের, কোত্থেকে এসেছে। ভয়ে ভয়ে জবাব দিল সে। নিমপাতা গলা দু'চারটে ধমক দিয়ে অবশেষে গাট্টা মারল মাথায়, বলল—ভাগ ছালা—

ভিজে প্যান্টে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরল তারা। ফেরার পথে দেখল কত বিচিত্র সব মানুষকে। এক অদ্ভুত ঘাড় বাঁকানো মানুষ দেখল। ধড় থেকে মাথাটা যেন পিছন ফিরে আছে। হড়হড়ে গলায় কথা বলে ভিক্ষে চাইছে। ঘাড় বাঁকানোর রহস্য খানিকটা উদ্ধার করল সে পাশের খাবারের দোকানের বাসন ধোঁওয়া ছেলেটার কাছ থেকে। সোজা ঘাড় বাঁকিয়ে ভিক্ষে করা রপ্ত করেছিল লোকটি। ভিক্ষে শেষে আবার সোজা হয়ে বসত সে। কিন্তু এখন আর পারে না। দীর্ঘদিন বাঁকাতে বাঁকাতে এখন আর সোজা করতে পারে না।

নতুন কাজের কথা ভাবে আবার। পেটের খিদে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় তাড়াতাড়ি।

হকারী করবে দুইজন। বন্ধু করবে লজেন্স, আমলকি, বাদাম —যখন যেটা সুবিধা । অল্প মূলধনের ব্যবসা। আবার স্টেশনের দোকানে ধারও পাবে। বিক্রি করে টাকা দিতে হবে দিনে দিনেই।
 সে নিজের ব্যবসার কথা ভাবে। তার ইচ্ছে পূরণের রাস্তা খোঁজে, দেখে শুনে যেটুকু লিখতে-পড়তে শিখেছিল সেটুকুকে আরেকটু ঘষে নিতে ইচ্ছা করে। নানা ধরনের বই বিক্রির কথা ভাবে। কিনতে পারবে বেচতে পারবে, মাঝখানে পড়তে পারবে। নিজের মত করে পড়বে। আদিম কাল থেকে জমে থাকা অন্ধকার চুঁইয়ে যে আলোটুকু আসছে— সেটুকু সযত্নে লালন করবে সে। 
এমনি করেই পুরো অন্ধকারকে চিরতরে হঠিয়ে দেবার স্বপ্নে বিভোর হয়। 
পরিকল্পনামত ব্যবসা শুরু করে। দু'জনে একসঙ্গেই থাকে। এক কামরায় ওঠে, একসঙ্গে নামে। এই ওঠা নামায় বাধা আসে শুরুতেই। সবকিছুই যখন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, ব্যতিক্রম হলেই বিপদ। ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে ওরা। এখানেও যে দাদা আছে—জানত না। জানে এবং জানিয়ে দেয় শিকলে বাঁধা মানুষগুলোই। এক নয় একাধিক দাদা আছে এখানে। রং-বেরংয়ের। যে কোন একটা রঙে ছোপ লাগাতে হবে গায়ে। গোলামির মাসোহারা ভেট দিতে হবে কোন এক দাদাকে। দাদা-মানে ঈশ্বরের সমান শক্তিমান। কোন এক রঙের কোন এক দাদার আশ্রয় নিতেই হবে। এই অচলায়তনের বাইরে গেলেই পৃথিবীটা সচল থাকবে না। সচল যে থাকে না—সেটা বুঝেছিল একটু দেরিতে। বড় বেশি বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে। আঠারোর দূর্বার সাহস বুকে নিয়ে অস্বীকার করতে চেয়েছিল নিয়মকে। কয়েকদিনের মধ্যেই দুঃসহ হয়ে উঠল তাদের কর্মপ্রয়াস। যে কামরায় ওঠে সেখানেই কেউ না কেউ তাদের বাধা দেয়। তাদের বিক্রি করতে দেয় না। একমাত্র অপরাধ কোন রঙের দ্বারা স্বীকৃত নয়, লাইসেন্স নেই। তারা বোঝাতে চায়—তুমি হকারী করছ পেটের ধান্ধায়। আমিও তাই। তুমি কষ্ট করছ, আয় করছ, আমিও কষ্ট করে আয় করছি। আমাদের কষ্টের পয়সা অন্যকে দিতে যাব কেন? তাছাড়া তোমাকে আমি বাধা দিচ্ছি না—তুমিও আমাকে বাধা দিও না। কিন্তু কাজ হয়না কিছু। উল্টে ভীমরুলের চাকে যেন খোঁচা পড়ে। পরের স্টেশনে আবার কামরা পাল্টায়। আবার কারো মুখোমুখি হয়। প্রতিবেশী হয় তারা। প্রথমে ঝগড়া, পরে হাতাহাতি। কামরাভর্তি মানুষগুলি কেমন কলের পুতুল হয়ে যায়। ন্যায়-অন্যায় কিছুই তাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে না। অঘটন ঘটে মুহূর্তে। বন্ধুকে বাইরের দিকে জোর ধাক্কা দেয় একজন। টালমাটাল অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করা থেকেও লজেন্সের বোয়েমটি রক্ষা করতে বুকে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে। কিন্তু টাল সামলাতে পারে না। চলন্ত ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে বন্ধুটি। ট্রেন থামতে ঘোর কাটে তার। মুহূর্তে সব পালিয়ে যায়। রঙের লাইনে বন্ধু আর কখনো ফিরে আসে না। চিরতরে হারিয়ে যায় সে।

বন্ধুকে হারিয়ে বড় অসহায় হয়ে যায় লেঠেল খুড়োর ব্যাটা। আলো তাকে আর টানে না তেমন। আবছা অন্ধকারের ঘোরে ডুবে থাকে। খিদে তো মানে না কিছু। তাই ধান্দা একটা করতেই হয়। এটা ওটা করতে চেষ্টা করে, আবার ছেড়ে দেয়। কোন কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না।

একচোখা মেয়েটার বাবার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় ওর। কখনো ঘরে কখনো বাইরে। অনেক কথা হয়। অশক্ত হয়ে আসা হাতে সংসার চালাতে হয় মানুষটাকে। কয়েকটা পেটের দায় তার। জীবনটা যতই কঠিন হোক তা ভেবে সময় কাটায় না। বরং মোকাবিলা করে। প্রকৃতির শাসন, প্রশাসনের শাসন— সবকে পাশ কাটিয়েই বাঁচতে হয়। আর বাঁচার কথাই কানির বাবা শোনায়। ডালসেদ্ধ ভাত মাখতে মাখতে একদিন বলে—কিন্তুক বাপ্, দুখ্খরি ধোর‍্যা থাকলি তো আমাদের চলে না। কস্টো তো আমাগে চাদ্দিক, তার মদ্দিই বাঁচ্‌তি হয়।’ নানা টানা-পোড়নের মধ্যে লেঠেল খুড়োর ব্যাটা বাঁচার কথাই ভাবে। ভাবতে ভাবতেই একদিন কানা মেয়েটাকে অবাক করে বিয়ে করে তাকেই।

একচোখা মেয়েটার সঙ্গে থাকতে থাকতেই সমস্যার চাপ অনুভব করে সে। একা থাকার চেয়ে দোকা থাকার সমস্যা অনেক বেশি। চারিদিক থেকে দায় এসে হাজির হয়। বউকে বালিশ ভাবতে গিয়েও স্যাতসেঁতে মাটি তাকে নাড়া দেয়। আয় করার চোরাগলিতে সে হন্যে হয়ে ওঠে, বরের চিন্তাটা বউয়ের মধ্যেও ঘুরপাক খায়। বউয়ের চিন্তা এগিয়ে যায় আরো। দুইজন থেকে তিনজন হতে সময়তো লাগে না। যদি তেমন কিছু হয়ে যায়? কি হবে তখন? অভাব তৃতীয় সত্তার সুখ-স্বপ্নের ও ফুরসত দেয় না। শীতের রোদে বরের মাথার খুসকি ছাড়াতে ছাড়াতে বলে—
 - আমি এট্টা কথা কব ?
- ক। অনিচ্ছার উত্তর।
- আমারে এট্টা কালো চশমা কিন্যা দেবা? — উপায় খোঁজে বউ। 
- ক্যান?—উৎসুক সে।
- আমি তো আদ্ধেক কানা। চশমা পরা কানাগে মতন গান গাব আর ভিক্ষা করব। 
পরিকল্পনা বাতলায়। নড়ে চড়ে বসে। বউয়ের দিকে তাকায়। অসম্মতির সুরে ধমকে ওঠে লেঠেলখুড়োর ব্যাটা—থাম্ তুই, আমি আছি কি অত্তি।
বউকে সম্মতি দেয় না ঠিকই, কিন্তু চিন্তার পোকা ঢোকে মাথার মধ্যে। আপন মনে ভাবনাটাকে ওলট-পালট করতে থাকে।

কয়েকদিন এদিক ওদিক যায়। বউকে পরিষ্কার করে কিছু বলে না। স্যাঁতসেঁতে ঘরে শুয়ে বউয়ের কানা চোখটায় হাত বোলায় কখনো, ঠোঁট ছোঁয়ায়, বলে— লক্ষ্মী বউ আমার।

একদিন মিচমিচে কালো পুরনো একটা চশমা জোগাড় করে আনে। বউয়ের চোখে পরিয়ে দিতে দিতে বলে—'এটা তোর নয়, আমার।'
হেঁয়ালি কিনা বুঝে উঠতে পারে না বউ। কিন্তু কথা শুনে অজানা আশংকায় শিউরে ওঠে। বউয়ের কাঁধে হাত রেখে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানায়, আমি কানা হব, গান গাব, ভিক্ষে করব। এতে কোন লাইসেন্স লাগবে না। 
- কিন্তুক তোমারে তো মেলা মানষি চেনে। ধরা পড়লি মার খাবা, কি হবে তহন? 
বিপদের গন্ধ পায় বউ। সে তার আপনার মানুষটাকে আগলাতে চায়।
-  সেই জন্যিই তো কয়দিন ঘোরলাম। সাহস যোগায় সে, এহানে আর আমরা থাকব না।

দু'জনের কথা হয়। ভাল কথা, আশংকার কথা। কথার জাল বুনে বুনে বাবুই পাখির মত একটা বাসার কথা ভাবে তারা। যেখানে বাবুই পাখির মত সন্তানের জন্ম দেবে, জোনাকির আলো জ্বালবে।

একদিন কানির হাত ধরে চশমা চোখে ঘর ছাড়ে লেঠেল খুড়োর ব্যাটা। অনেক দূরের নতুন আস্তানায় হাজির হয়। পূর্বরেল ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব রেল। আগের লাইনের পরিচিত মানুষের চলাচল নেই এখানে। একেবারে নতুন পরিবেশ। শুরু থেকেই সতর্ক সে। অজান্তেও চোখ থেকে চশমা খোলে না। অন্ধ পরিচয়েই শুরু হয় জীবিকা। জীবিকায় একটুও ফাঁকি দেয় না। কয়েকটা দিন প্লাটফর্মে কাটায়। অবশেষে নিজের সামান্য সঞ্চয় দিয়ে রেলধারের এক ঘরের বাসিন্দা হয়ে যায়।

বউয়ের বেসুরো চিকন গলায় সুর মেলায় সে। 'সাধের ময়নারে.....'  দিয়েই শুরু। যথার্থ পেশাদারি হওয়ায় মনোযোগ দেয়। চশমাহীন অবস্থায় যাতে ধরা না পড়ে সে জন্যে চোখ উল্টানো অভ্যেস করে। সাধুবাবার হাতের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ঘাড় বাঁকানো লোকটার কথা। অভ্যাসে সবই সম্ভব। চোখের মনিটাকে আড়াল করে চোখ উল্টিয়ে কানা হয়। দিনের পর দিন অভ্যেস করে অস্বাভাবিক বিষয়টিকে সম্ভব করে তোলে। বাড়তি সতর্কতা হিসাবে চোখে চশমা থাকলেও কাজের সময়ে চোখ বন্ধ করে থাকাটাই পছন্দ করে। অন্ধের যষ্ঠি তার আধকানা বউতো সঙ্গে থাকেই। প্রথম দিকের অসুবিধাগুলি স্বাভাবিক হতে থাকে।

অতি কষ্ট করে যেটুকু লেখা-পড়া সে শিখেছিল তার চর্চা আর হয়ে ওঠে না। দিনের বেলা তো পড়ার চেষ্টা করতেই পারে না। প্রথমে দু'চারদিন রাতের বেলা ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে পুরনো কাগজের সংবাদ পড়তে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঝাঁপ দিতে হয় মনের দরজায়। তার পড়ার তৃষ্ণা হেরে যায় জীবনের কাছে। সুস্থভাবে, ভালভাবে বাঁচার তাগিদে তাকে ত্যাগ করতে হয় সেই লেখাপড়া। যদি কেউ দেখে ফেলে? যদি কেউ জেনে যায়? এই ভয় তাড়া করে অহরহ। যে জীবিকায় দু'মুঠো খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে তাদের, সেটাকে সে হারাতে চায় না। সে তো আর একা নেই। কানি আছে, কানির সঙ্গে আরো একজন আছে। দুইজনের আশা, দুইজনের স্বপ্ন। সেই অনাগতকে আলোর পথে নিয়ে যাবার দায় তো তার। সেই দায় তাড়া করে।

অবশেষে আলোর রোশনাইকে বিদায় জানাতে হয়। আলোর রেশ থাকতে চোখের কালো চশমা খুলতে পারে না, খোলে না। ঘরের বাতি নিভিয়ে যখন বউয়ের চোখের সামনে নিজের চোখটা আনে তখন চারিদিকে অন্ধকার, বউয়ের মুখটাও অন্ধকার। জমাট বাঁধা অন্ধকারে কানি লেঠেল খুড়োর ব্যাটার হাত ধরে। নিজের নাভির নিচে হাতটা নিয়ে চেপে ধরে। গরম নিঃশ্বাসে প্রহর গোনে ওরা।

1 টি মন্তব্য:

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...