গল্প : পরগাছার আশ্রয়
চেয়ারে বসবার আগে মুছে নেয়। কয়েকদিনের জমে থাকা ধূলোর পাতলা আস্তরণ মুছে বসে। জমে থাকা কাজগুলি শেষ করার জন্যে গুছিয়ে বসে। টেবিলের পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে সংগঠন নেতা। টেবিলের উপর হাত বাড়িয়ে বলে—
- হ্যালো কমরেড, কেমন আছ এখন ?
—ভাল। তবে শরীরটা বড় দুর্বল।
—একটু ভাল মন্দ খাও। বিশ্রাম নাও ; সব ঠিক হয়ে যাবে। আরো কিছু কথা বলে নেতা। অফিসের হালচাল বলে, সংগঠনের হাল চাল বলে।
চাকরির প্রথম থেকেই বড় মেঝো নেতাদের সাথে ওঠা-বসা গায়ে দুর্বল মানুষটির। অনেকের বদলি হলেও তার বদলির কথা ওঠেনি দ্বিতীয় বার। হয়তো সংগঠনকে ভালবাসার মূল্য এটা। চাকরি জীবনের অর্ধেক সময়ে কেটেছে সংগঠনের কাছাকাছি থেকে। ছোট সংগঠনেকে বড় হতে দেখেছে, একটা সংগঠন ভেঙ্গে একাধিক সংগঠন তৈরি হতে দেখেছে।
দরিদ্র পরিবারের মানুষ সে। বাবা ছিল দিনমজুর। সেই অনিশ্চিত আয়ের পয়সায় তাদের খাওয়া চলত, তার পড়াশুনা চলত। প্রতিটা নাই-এর সমাধানে অনেক ‘নাই’ এর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। ধর্ম যখন আফিম, সংসদ যখন শুয়োরের খোঁয়াড়—সত্তরের দশকের সেই ঢেউ একদিন পৌঁছে যায় তাদের স্কুলে। কিছু ছাত্র নেতার ব্যস্ত ঘোরা-ফেরা, ছোট ছোট মিটিং, সমাজ বদলের ডাক। যাঁরা অনেক উঁচুতে তাদের টেনে মাটির কাছাকাছি আনা, যাঁরা ধূলোয় গড়াচ্ছে তাদের টেনে তোলা। কৃষক শ্রমিকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। সাম্য প্রতিষ্ঠা। রক্তের জোয়ার শিরায় শিরায়। প্রাণে প্রাণে শিহরণ!
স্কুল রাজনীতির ঘেরাটোপে বসে আজকের গায়ে দুর্বল মানুষটি বড় একটি স্বপ্ন দেখেছিল। তার মজুর বাবার সুখের স্বপ্ন। যারা তাদের হেয় করে, আর্থিক দৈন্যতার জন্যে, সামাজিক দৈন্যতার জন্যে, তাদের সাথে সমান হবার স্বপ্ন। বামপন্থী ভাবধারায় সাথে সে আত্মীক নৈকট্য অনুভব করে সেই সময় থেকে। আর্থিক-সামাজিক সাম্যতার সে স্বপ্ন তার কাছে বিদ্যুৎ চমকানোর মত মনে হয়। সেই চমক বাস্তবে ধরা দেয়নি, কিন্তু ঝলসে দিয়ে গেছে মনটাকে। ঝলসানো মনে উত্তাপ অনুভব করে সে। বিশ্বাস করে যা হঠাৎ আসতে পারেনি, তা একদিন আসবে ধীরে ধীরে। সমাজ উত্তরণের সেই স্বপ্ন সে দেখে। সেই আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার জন্যে যত ক্ষুদ্রই হোক, তার কাজটুকু সে করতে চেষ্টা করে আন্তরিক ভাবে। সবার সঙ্গে, আবার কখনো একা।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ। কয়েক মাইল রাস্তা হেঁটে যাওয়া, হেঁটে ফেরা। 'নাই'- '–তো নিত্য সঙ্গী। তবু কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে সে, অনেকের মধ্যে কয়েকজনের দলে থেকে। তারপরে আর সম্ভব হয়নি। সংসারটা ততদিনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে একেবারে। কোমর ব্যথায় বাবা একদম উঠতে পারে না। সারাজীবন বহন ক্ষমতার বেশি চাপিয়েছে নিজের কাঁধে। স্বাভাবিক ভাবে কোমর হারিয়েছে বহন ক্ষমতা। ভেঙ্গে পড়া সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ তার ছোঁয়া হয়নি।
দিনে খেটে রাত জেগে পড়ে একটা চাকরি পায় গায়ে দুর্বল মানুষটি। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সামান্য বেতন। তবু বাঁচার স্বপ্নে হাসি ফোটে সংসারের মুখে। শুরুতেই যেতে হয় বাড়ি থেকে দূর অজ-গাঁয়ে। সেখানেই থাকতে হয় । মানুষের সাথে মেশে। আশে পাশের পাঁচ-সাতটা গ্রাম ঘুরে দেখে। মানুষের সুখের কথা শোনে। মানুষের দুখের কথা শোনে ।
চাষ নির্ভর মানুষজন। অশিক্ষার ভার বড় বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বেশ কিছু। এতগুলি গ্রাম ঘিরে একটা মাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কলেজ এখান থেকে বহু যোজন দূর। মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছে দম হারিয়ে ফেলে বেশির ভাগ মানুষ। কলেজ থেকেও অনেক নিকট প্রতিবেশী—পৈতৃক পেশা তাদের টানে। দু'চারজন সমর্থ মানুষ ছাড়া বাকিরা জড়িয়ে থাকে সামাজিক সংস্কার-কুসংস্কারের আবর্তে।
গ্রামে মন্দির আছে কয়েকটা। বাজারের মধ্যেরটা আকারে বড়। বিগ্রহ আছে নানা দেবতার। মূল মন্দিরের আশে-পাশে অন্য দেবদেবীদের পুজাস্থল। পাশের গ্রামে একটি পূরনো গির্জা আছে। একদিকের দেওয়াল ভাঙ্গা। যদিও গ্রামে কোন খ্রীষ্টান নেই। অধিকাংশ বাসিন্দা আদিবাসী সমাজভুক্ত। তাদের কেউ গির্জায় প্রার্থনা করতে আসে না। বড়দিনের কোন উৎসব হয় না। কেবল মাঝে মধ্যে কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালায়। কোন বিপদ যখন ঘিরে ধরে—বিপদ মুক্তির আশায় মোড়লদের দুয়ারে যেমন যায়, তেমনি মন্দির, গির্জা, দরগা—সবখানে যায়। এদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। গ্রামে পাকা মসজিদ নেই একটাও। মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনির মসজিদ আছে একটা। সকাল সন্ধ্যে আযানের সুর ভেসে আসে সেখান থেকে। সহজ সরল প্রকৃতির বাসিন্দাদের কাছে ঢাকের আওয়াজ, ঘন্টার ধ্বনি বা আযানের সুর আলাদা কোন অর্থ বহন করে আনে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা এদেশের ধর্ম। সে ধর্মের আঁচ পাওয়া যায় এই অজ পাড়া গাঁয়ে। মানুষ চলে আপন গতিতে, ধর্ম চলে তার সাথে। মানুষের প্রয়োজনটাই মুখ্য। কিন্তু শান্ত জীবন ধারা কখনো কখনো শান্ত থাকে না। বাইরের ঢেউ এসে লাগে সেখানেও। সারা দেশে, শহুরে দেশে, ধর্ম যখন উত্তাল ঢেউ তোলে, ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পড়ে তা।
চাপকান পরা, মুখে দাড়ি, সুরমা লাগানো চোখে এক সহকর্মী বদলি হয়ে আসে একদিন। কিছুদিনের মধ্যেই সমজাতীয় স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ ঘটে। নিজের গরজেই যোগাযোগ ঘটায়। অফিসের বাইরে বেশির ভাগ সময় কাটে সেই সব মানুষের সাথে। চাপা আলোচনা চলে। চাপকান পরা বন্ধুটির মধ্যে গোপনীয়তার গন্ধ পায়। শহর থেকে পত্রিকা নিয়ে আসে। বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিলি করে। এদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক বিশেষ অংশের প্রবক্তা সে কাগজ। মানুষ পড়ে, উত্তেজিত হয়। বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জটলা বাড়ে। ভয় আর অবিশ্বাসের ছায়া তাদের চোখে। চাপকান পরা বন্ধুটি আসবার পর মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা এই বিশেষ পরিবর্তন চোখে পড়ে গায়ে দুর্বল মানুষটির। অস্বস্তি বোধ করে সে।
আপিসে সিন্দুকের উপর সিদ্ধিদাতা গণেশের অধিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে একদিন। প্রশ্ন তোলে চোখে সুরমা বন্ধুটি। গণেশ পূজা যদি আপিসে চলতে পারে, তার যুক্তি—সে কেন নামাজ পড়তে সুনির্দিষ্ট জায়গা পাবে না? এক জুম্মাবারে আপিসের মধ্যে নামাজ পড়তে চায় সে। সে প্রস্তাবে প্রতিবাদ আসে অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে। অকাট্য, অবেগময় যুক্তি খুঁজে পায় সবাই—যেখানে পূজো— সেখানে নামাজ? চলতে পারে না। চুপচাপ থাকা সংখ্যাধিক্য মানুষগুলি নড়ে চড়ে বসে। সরকারি এই আপিসটাই যেন তাদের কাছে মন্দির হয়ে যায়। অযোধ্যা আর অযোধ্যায় থাকে না। তৎপর হয়ে ওঠেন চাপকান পরা বন্ধুটি। মুসলমান পাড়ায় যাতায়াত বাড়ে তার। উত্তেজনা বাড়ে ধীরে।
মহরম আসে । ইতিপূর্বে যা কখনো হয়নি, এবার তাই হয়। মহরমের তাজ এসে জড় হয় আপিসের সামনে। সারাদিন ধরে মহরমের শোক উৎসব চলে আপিস তথা বাজার তথা মন্দিরের সামনে। জয়ের আস্বাদে মাতোয়ার হয়ে ওঠে চাপকান পরা বন্ধুটি। সমস্ত ব্যবস্থাপনা অতি উৎসাহে করে সে।
সাধারণ মানুষ দেখে। প্রতিবারই দেখে। কিন্তু এবার যেন একটু অন্যরকম লাগে তাদের কাছে। তাজিয়া নিয়ে কাজিয়ার মধ্যে বাড়াবাড়ি দেখে তারা। ফিস্ ফাস চলতে থাকে। সে ফিস্-ফাস্ চাপা গর্জনের দিকে এগোতে থাকে দ্রুত।
শান্ত গ্রামের অশনি সংকেত, থমথমে ভাব উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয় ছেলেটির মধ্যে। ভারতবর্ষের অন্যপ্রান্তের মন্দির প্রসঙ্গ অতিদ্রুত জায়গা করে নেয় বাংলার এক অজ গ্রামে। আতঙ্কিত মনে সে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে কথা বলে। কথা বলে আর মানুষের মনের গহনে জমে থাকা হিংসার তাপ পায়। ঘটনার অভাবনীয় অবনতি দেখে সে হতচকিত হয়। এতদিনে যে সমস্যা ছিল সার্বিক ভাবে গ্রামের মানুষের সমস্যা, এখন সেই সমস্যাই হয়েছে সম্প্রদায়গত সমস্যা। সার্বিক শব্দটা কেমন অচল হয়ে গেছে। সমাধানের রাস্তা খুঁজে পায় না সে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ উদ্বিগ্ন করে তাকে। উপায়ন্তর না দেখে কেন্দ্রীয় আপিসে যোগাযোগ করে। তাদের বিস্তারিত জানায়। সমাধানের রাস্তা খুঁজতে বলে। কেন্দ্রীয় অফিস থেকে লোক আসে। সব দেখে, শোনে। গণেশের মূর্তির কাছে মাথা নত করে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। চাপকানের সাথে কথা বলে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াবার জন্যে তাকে দোষারোপ করা হয়। ভয় দেখান হয়।
কেন্দ্রীয় আপিস ব্যবস্থা গ্রহণ করে অতি দ্রুত। কয়েকদিনের মধ্যেই বদলি করা হয় চাপকান পরা বন্ধুটিকে। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির সমস্ত দায় তার উপর চাপানো হয়। থমকে যায় গ্রামের পরিস্থিতি। এক আসন্ন লড়াইয়ের উত্তেজনা স্নায়ুতন্ত্রকে যেমন সজীব করে তুলেছিল ভাটা পড়ে সেখানে। হালহীন নৌকার মত পাক খেতে খেতে দিশা হারায় গ্রামের গুমরে ওঠা পরিস্থিতি। মানুষ আবার কাছাকছি আসে পরস্পরের। যদিও সময় লাগে। মোরগগুলি আবার ডাকতে থাকে তারস্বরে। শুয়োরগুলো ভোস ভোস্ করে ঘুমিয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। সেই সব মানুষের ভিড় হয় একদিন খেয়াঘাটে। অনেকের চোখের জলে, কান্নাভেজা স্বরে বিদায় নেয় গায়ে দুর্বল মানুষটি।
মানুষটির বদলির পর আপিসের অন্য কর্মীরা আবিষ্কার করে গণেশের মূর্তি নেই। সে মূর্ত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না কোথাও।
তারপর থেকেই কেন্দ্রীয় আপিসে আছে সে। আপিসের বামপন্থী সংগঠনের সদস্য। নেতাদের সঙ্গে ওঠে বসে। নেতাদের কথায় ওঠে, বসে। তারা যে দায়িত্ব যখন দেয় পালন করে। প্রগতিপন্থী আন্দোলনের শরীক সে, নীরবে। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে সংগঠন। কর্মীদের সম্মানজনক উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। বাধা এসেছে নানাভাবে। সংঘশক্তির প্রকৃত উদাহরণ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে নেতৃত্ব। কর্মীদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছে, অন্যের প্রয়োজনে, দুর্গত মানুষের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেদের ভূমিকা পালন করেছে।
সুরমা চোখে চাপদাড়ি বন্ধুটির সাথে দেখা হয় মাঝে মধ্যে। কথা বলে কম । নিজের কাজ করে চলে যায়। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত মনে হয়। ভিতরের জমে থাকা লাভার হদিশ সহজে পাওয়া যায় না। সুযোগ পেলে আত্মপ্রকাশ করে। কয়েক বছরের মধ্যে ফের একবার ঘটনা হয়ে উঠেছিল সে। বিধর্মী এক বিধবা রমণীর সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল সেই গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের মানুষও। তখনও সামাল দিতে হয় কেন্দ্রীয় আপিসকে।
ইতিমধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে থাকে দেশে। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি একজোট হয়। দেশ বিদেশের সাম্প্রদায়িক দলগুলির মধ্যে মিত্র খুঁজে পায়। বিচিত্র মানুষের এই দেশে চিন্তান্বিত হয়ে ওঠে প্রগতিপন্থীরা। মিত্র খোঁজে তারাও। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একেজোট হতে থাকে অসম্প্রদায়িক শক্তি। বৃহত্তর স্বার্থে আদর্শগত পার্থক্য সযত্নে পাশে সরিয়ে রাখার কথা ঘোষণা করে বামপন্থী অতিবামপন্থীরা।
আপাত নিস্তরঙ্গ আপিস জীবনের তরঙ্গ ওঠে ধীরে। একটা সাধারণ বিষয় অসাধারণ হয়ে ওঠে মানুষটার কাছে । সিঁদুরে মেঘ দেখে ঘরপোড়া গরু। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে সে। ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থার এক ছোট সংস্করণ যেন তার আপিসও। এদেশের জনসংখ্যার আনুপাতিক হার থেকে অনেক বেশি কর্মচারী বিশেষ একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের। তাদের ইচ্ছার প্রাধান্য অন্যদের ছাপিয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। সেই প্রবণতার প্রকাশ ঘটে ধীরে। একজন কর্মী তার নির্দিষ্ট যন্ত্রটি নিয়ে কাজ শুরুর আগে ধূপ জ্বালায় নিয়ত। বছরে একদিন, বিশ্বকর্মা পূজার দিন, সেই যন্ত্রটাকে ঝেড়ে পুছে বিশেষ যত্নে রাখে সেই কর্মী। নিজের মত করে ফুল বেলপাতা দেয়। কয়েক বছরের মধ্যে বিশেষ প্রাধান্য পায় বিষয়টি। দেশে ধর্মীয় রাজনীতি বৃদ্ধির সাথে সাথে আপিসের মধ্যে প্রকাশ্যে বিশ্বকর্মা পুজা শুরু হয়। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যারা—তারা থাকে আড়ালে। মানুষের অবচেতন মনে নাড়া দিতে থাকে সন্তর্পণে। ধর্মীয় চেতনা-বোধ জাগায়, সাম্প্রদায়িক মানবিকতার ভিত তৈরী করে। পুজার বদলে উৎসবের চেহারা দিতে চায় তারা, যেন এক আনন্দ-যজ্ঞ। কিন্তু বিষয়টি মেনে নিতে পারে না গায়ে দুর্বল মানুষটি। সরকারি সম্পত্তিকে ঘিরে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের এই আনুষ্ঠানিক উৎসব সে মেনে নেয় না। নেতাদের জানায়। কিন্তু কোন গুরুত্ব দেয় না নেতৃত্ব। বরং অতি তুচ্ছ ব্যাপারে তারাও অংশ নেয় সক্রিয়ভাবে। অবশেষে প্রতিবাদ করে সে, নিজের মত করে। সে প্রতিবাদে কাজ হয় না। কতৃপক্ষকে জানায়, উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু দিন শেষে উৎসবের প্রসাদ কপালে ছুঁয়ে গলাধঃকরণ করে। আবার প্রতিবাদ করে সে। নিজে একা হতে থাকে। বাড়তে থাকে পুজার হিতৈষী।
ভয় হয় গায়ে দুর্বল মানুষটির। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হতে থাকে—বিপদের ডাক আসবার সম্ভাবনাও থাকে। সব ধর্মের মানুষ যদি আপন ধর্মের আচারস্থল করতে চায় আপিসকে। সে মিলন যজ্ঞে সবাই সামিল হবে? সবাই সমান কদর পাবে? বিদ্বেষ বাড়বে। বিভেদ বাড়বে। প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে শাখা-প্রশাখায়। ছড়িয়ে পড়বে কর্মীদের মধ্যে, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে। ছোঁয়াচে রোগের থেকেও ভয়াবহ আকার নেবে সাম্প্রদায়িকতা। এইসব নানা মূলক-অমূলক ভাবনার আবর্তে পরের বারের পূজোর আগেই সক্রিয় হয়ে ওঠে সে। বিভিন্নজনের সাথে আলোচনা করে। সংগঠনের নেতৃত্বের সাথে আরো আলোচনা করে। একমসয় তারা একমত হয় তার সাথে। কিন্তু ধর্মের মত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কেউ এগুতে চায় না। বড় ভয়—সমর্থন হারাবার ভয়। মুখে সে সব স্বীকার করতে পারে না—তাই নানা কারণ দেখায়। ঘন্টা বাঁধার কাজ কেউ নিতে চায় না। সরব প্রতিবাদে আরো একা একঘরে হয়ে যায় মানুষটি। মৌলসত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে সব প্রগতিবাদীরা—তাদের থেকে আলাদা হতে থাকে সে।
নির্দিষ্ট দিনে পূজো হয় আবার। কাজের সময়ে কাজের টেবিল ফাঁকা রেখে জড় হয় সবাই। সবার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে প্রগতিপন্থী নেতা কোমর থেকে পৈতা আনে প্রকাশ্যে। পুরোহিতের ভূমিকা যথাযথ পালন করেন তিনি। মন্ত্র আরো জোরে উচ্চারিত হয়। টেবিলে টেবিলে প্রসাদ খাওয়ার মহোৎসব - হতে থাকে। আপন মনে কাজ করতে থাকা মানুষটির কানে তির্যক উক্তি ভেসে আসতে থাকে এ টেবিল-সে টেবিল থেকে। পরাজিত মানুষের মত, অসহায় মানুষের মত ক্ষরণ হতে থাকে তার। নিঃস্ব হতে থাকে। একাকিত্ব অনুভব করে সে—বাইরে, অন্তরে।
বিমর্ষ, একাকি মানুষটার সামনে আসে চাপকান পরা, সুরমা চোখে, চাপদাড়ি লোকটি। একটি সিগারেট মনে দুর্বল মানুষটার হাতে গুঁজে দেয়, নিজের মুখে নেয় একটি। আগুন ধরাবার জন্যে দেশলাই কাঠি বের করে সন্তর্পণে।
***
লেখার সময় : ১৯৯৮ সাল।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন