শনিবার, ১১ জুন, ২০২২

বর্ণাশ্রম ও রবীন্দ্রনাথ

বর্ণাশ্রম ও রবীন্দ্রনাথ: 


রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "অতি অল্প বয়স থেকেই স্বভাবতই আমার লেখার ধারা আমার জীবনের ধারার সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছিন্ন এগিয়ে চলেছে। চারিদিকের অবস্থা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে এবং অভিজ্ঞতার নূতন আমদানি ও বৈচিত্র‍্যে রচনার পরিণতি নানা বাঁক নিয়েছে ও রূপ নিয়েছে।"

আমি ছোটবেলায় ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলাম। হ‍্যাচড়া, কালী, চড়ক, দূর্গা, সরস্বতী- তেত্রিশ কোটি দেবতায় ছিল অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বাস করতাম যীশু এবং আল্লাহ কে। কিন্তু বড় বেলায় নানা প্রশ্ন মনে আসতে থাকে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কবে যেন উবে যায় ধর্ম বিশ্বাস।

রবীন্দ্রনাথও পাল্টেছেন সময়ের সাথে সাথে, সত‍্যসন্ধানের মধ্যে। তাই ছোটবেলার বিশ্বাস, সংস্কারের মধ্যে ডুবে থাকেননি। নিরন্তর বদলেছেন নিজেকে।

হিন্দু সমাজ এবং তার শাখা প্রশাখা জাতপাতের নিগঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। ব্রাহ্ম হলেও রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার তার থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি বড় হয়েছেন উপনিষদের শ্লোক কন্ঠস্থ করে।

আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনা, ' ব্রাহ্ম ' রবীন্দ্রনাথ থেকে ' মানুষের ধর্ম'-এর রবীন্দ্রনাথে উওরণ। এ আলোচনা এক অতিসামান‍্য পাঠকের প্রতিক্রিয়া মাত্র।
সময়ের সাথে সাথে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরণ ঘটেছে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আদি ব্রাহ্ম সমাজের আবহে বড় হওয়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল বর্ণাশ্রমপ্রিয়তা। 'গীতাঞ্জলি' প্রকাশের আগে পর্যন্ত এর প্রতিফলন তাঁর লেখায় বিদ‍্যমান।

বর্ণাশ্রমকে সমাজজীবনের আদর্শ মনে করেন তিনি। কিন্তু সমাজের দুরাবস্থা দেখে দ্বন্দ দেখা দেয় তার মধ্যে। ১৮৮৫ সালে এক প্রবন্ধে তিনি লেখেন :
"সমাজসমুদ্রের মধ্যে তরঙ্গের উঁচু-নিচু অবশ্যই ছিল, কিন্তু তেল-জলের মতো একটা পদার্থ ছিল না। পরস্পরের মধ্যে যে বিভিন্নতা ছিল তাহার ভিতরেও জাতীয় ভাবের একটি ঐক্য ছিল, সুতরাং এরূপ সমাজে জটিলতার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সে সমাজ সবল ছিল কি দুর্বল ছিল সে কথা হইতেছে না, কিন্তু তাহার সর্বাঙ্গীন স্বাস্থ্য ছিল, অর্থাৎ তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল। কিন্তু এখন সেই সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া গেছে। "

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিধাগ্রস্ততার অন‍্যতম কারণ আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শিক্ষক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ‍্যায়ের রক্ষনশীঋতা। এদের প্রভাবে তাঁর বর্ণাশ্রমপ্রিয়তার আধিক্য দেখা দেয়।

ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ছিল পূর্ব বাংলায়। জমিদারীর দেখভালের দায়িত্ব পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপর। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে  তিনি শাস্ত্রীয় বিধানের অযৌক্তিকতা অনুধাবন করেন। বাস্তবতা তাঁর বর্ণাশ্রমপ্রিয়তা থেকে বর্ণাশ্রমবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করে। ১৮৯১ সালে তিনি লেখেন :
" প্রথমত আমরা সকলেই যে বিশেষরূপে পবিত্রতার চর্চা করে থাকি তা নয়, অথচ অধিকাংশ মানবজাতিকে অপবিত্র জ্ঞান করে একটা সম্পূর্ণ অন‍্যায় বিচার, অমূলক অহংকার, পরস্পরের মধ্যে অনর্থক ব‍্যবধান সৃষ্টি করা হয়। এই পবিত্রতার দোহাই দিয়ে এই বিজাতীয় মানবঘৃনা আমাদের চরিত্রের মধ্যে যে কীটের ন‍্যায় কার্য করে তা অনেকেঅস্বীকার করে থাকেন। তাঁরা অম্লানমুখে বলেন, কই, আমরা ঘৃণা কই ক‍রি ! আমাদের শাস্ত্রেই যে আছে বসুধৈব কুটুম্বকম। শাস্ত্রে কী আছে এবং বুদ্ধিমানের ব‍্যাখ‍্যায় কী দাঁড়ায় তা বিচার্য নয়, কিন্তু আচরণে কী প্রকাশ পায় এবং সে আচরণের আদিম কারণ যাই থাক্ তার থেকে সাধারণের চিত্তে স্বভাবতই মানবঘৃনার উৎপত্তি হয় কিনা, এবং কোনো-একটি জাতির আপামর সাধারণে অপর সমস্ত জাতিকে নির্বিচারে ঘৃণা করবার অধিকা্রী কি না, তাই বিবেচনা করে দেখতে হবে ।  "

অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজের একটি লোকাচার যাকে তিনি " মানবঘৃনা " বলে অভিহিত করেন। তিনি লেখেন : 
" শ্রুতিতে আছে - অতিথিদেবো ভব। কিন্তু কালক্রমে লোকাচার এমন অনুদার।এবং বিকৃত হইয়া আসিয়াছে যে, কোনো বিদেশীয় বিজাতীয় সাধুব‍্যক্তি যদি আমাদের দেশে উপস্থিত হইয়া প্রীতিপূর্বক আমাদের মধ্যে অবস্থান করিতে ইচ্ছা করেন, তবে কোন হিন্দুগৃহ তাঁহাকে সমাদ‍রের সহিত অসংকোচে স্থান দেয় না, তাঁহাকে দ্বারস্থ কুক্কুরের ন‍্যায় মনে মনে দূরস্থ করিতে ইচ্ছা করে ; এই অমানুষিক মানবঘৃনাইকি আমাদের পক্ষে অক্ষয় কলঙ্কের কারন নহে। "

১৮৯৫ সালে লেখেন "বিদ‍্যাসাগর চরিত "। বিদ‍্যাসাগরের সহজ সরল স্বাভাবিক জীবন তাকে আকর্ষণ করে। নিম্মবর্গীয় মানুষকে নিজের হাতে সেবা যত্ন করা রবীন্দ্রনাথের বর্ণাশ্রমবিরোধী মন পোক্ত ক‍রে। তিনি লেখেন : 
 " তাঁহার দয়ার মধ্য হইতে যে একটি নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব প‍রিস্ফুট হইয়া উঠে তাহা দেখিয়া আমাদের এই নীচজাতির প্রতি চিরাভ‍্যস্ত ঘৃণাপ্রবণ মনও আপন নিগূঢ় মানবধর্ম - বশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না। "

এতৎসত্বেও মনের অন্দরে বাসা বাধা বর্ণাশ্রম প্রথা থেকে মুক্ত হতে পারেন না। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন ' বোর্ডিং বিদ‍্যালয় '। সেটা পরিবর্তন হয় ' ব্রহ্মচর্যাশ্রম'-এ। বর্ণাশ্রমের সব নিয়ম প্রচলিত হয় সেখানে। একদা সেখানে অ ব্রাহ্মণ শিক্ষককে ব্রাহ্মণ ছাত্ররা প্রণাম করবে কি না সেপ্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ লেখেন :

 "প্রণাম সম্মন্ধে আপনার মনে যে দ্বিধা উপস্থিত হইয়াছে তাহা উড়াইয়া দিবার নহে। যাহা কিছু হিন্দু সমাজ বিরোধী তাহাকে এ বিদ‍্যালয়ে স্থান দেয়া চলিবে না, সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে ছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ অধ‍্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্বক প্রণাম ও অন‍্যান‍্য অধ‍্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে  এই নিয়ম প্রচলিত করাই বিধেয়।"

১৯০৬ সালে ' খেয়া ' কাব‍্যের একটি কবিতায় পরোক্ষভাবে বর্ণাশ্রমবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পায়। তিনি লেখেন :

"আমার ঘরে
যার খুশী সেই আয়রে তোরা 
যার খুশী সেই আয়রে। "

১৯১০ সালে 'গীতাঞ্জলি'র ১০৮ সংখ্যক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ প্রত‍্যক্ষভাবে বর্ণাশ্রম বিরোধী। তিনি তীক্ষ্ণ এবং আক্রমণাত্বক। কবিতার প্রথম স্তবক :

"হে মোর দুর্ভাগা দেশ , যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
                মানুষের অধিকারে
                বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ।
...................................................................

১৯২৮ সালে ধর্মের সমালোচনা করে লিখলেন : 

"আমাদের দেশে ধর্মই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে। আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেছি, স্ত্রীলোককে হত‍্যা করেছি, শিশুকে জলে ফেলেছি, বিধবাকে নিতান্ত অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেছি, নিরীহ পশুদের বলিদান করেছি।....মানুষের স্পর্শকে বীভৎস জন্তুর চেয়ে বেশী ঘৃণা করি।"

বর্ণাশ্রমের কুফলতা অস্পৃশ্যতা। তিনি মনে করেন, দেশের অধিকাংশ মানুষকে স্পর্শের অযোগ্য বিবেচনা করার অর্থ হলো, নিজ বাসভূমে নিজেদেরই পরবাসী করে তোলা। ১৯৩১ সালে তিনি হা-হুতাশ করে  বলেন :

" আমাদের দেশে আমরা পরবাসী, অর্থাৎ আমাদের জাতের অধিকাংশের দেশ আমাদের নয়।সে দেশ আমাদের অদৃশ্য, অস্পৃশ্য।যখন দেশকে মা বলে আমরা গলা ছেড়ে ডাকি তখন মুখে যাই বলি মনে মনে জানি, সে মা গুটিকয়েক আদুরে ছেলের মা। এই করেই কি আমরা বাঁচব। "

১৯৩২ সালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অস্পষ্টতাবিরোধী বক্তব্য অত্যন্ত জোরালো এবং দ্ব‍্যর্থহীন :

"....উচ্চবর্ণের মানুষ যেসব দুষ্কৃতি করে থাকে, তার দ্বারা তাদের চরিত্র কলুষিত হলেও দেবমন্দিরে তাদের অবাধ প্রবেশ... দেহ বা চরিত্র যার কলুষিত, ঘৃণা করে সেই সকল ব‍্যক্তবিশেষকে দূরে বর্জন করলে দোষ দিতে পারিনে, কিন্তু কোন সমগ্র জাতকে অবজ্ঞা করার স্পর্ধা দেবতা ক্ষমা করেন না,... কোনো জাতির হীনতা জন্মগত ও নিত‍্য, এ কথা মনে করাকে আমি অমার্জনীয় অধর্ম জ্ঞান করি।খৃষ্টান শাস্ত্রে চিরনরকবাসের কল্পনা যেমন গর্হিত, কোনো জাতিকে সমাজে চিরনারকী করে রাখাও তেমনি নিষ্ঠুর অন‍্যায়।"

১৯৩৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মানুষের ধর্ম ' বিষয়ক বক্তৃতা দেন। ততদিনে তিনি প্রচলিত ধর্ম ভাবনার নিয়তিনির্ভর ভাবনা মুক্ত। তাঁর ধর্ম মানবতাবাদী। মানবপ্রেমময় সে ভাবনায় ঈশ্বরের গুরুত্ব নাম মাত্র। তাঁর ঈশ্বরের কোন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নেই। সেই ধর্ম জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, জাত-পাত যাবতীয় মানববিভেদ কার্য-কারণকে কঠোরভাবে অস্বীকার করে। 

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বর্ণাশ্রম তথা অস্পৃশ‍্যতা বিষয়ক আলোচনায় আরো দুইজন মানুষের নাম উঠে আসে। একজন মোহন দাস করমচা়ঁদ গান্ধী আরেকজন ভীমরাও আম্বেদকর। গান্ধী চেয়েছিলেন বর্ণাশ্রম থাকবে কিন্তু অস্পৃশ‍্যতা থাকবে না। সে এক কষ্টকল্পিত সোনার পাথরবাটি। আম্বেদকর চেয়েছিলেন বর্ণাশ্রম তথা মনুবাদের বিলোপ। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, কোন রাজনৈতিক বা ধর্মনৈতিক কাজের মাধ্যমে বর্ণাশ্রম তথা অস্পৃশ‍্যতা দূর করা সম্ভব নয়। একমাত্র মানুষের ধর্ম তথা খাঁটি মানবতাবাদী দৃষ্টিতে অস্পৃশ‍্যতা সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব। মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে মানুষের ধর্ম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বর্ণাশ্রমপ্রিয়তা থেকে মানুষের ধর্মে উপনীত হতে দীর্ঘজীবন সময় নিয়েছেন, কোন পুথি বা মতবাদকে সাদা মনে গ্রহণ করেন নি, যাচাই করে আপন সিদ্ধান্তে স্থির হয়েছেন।

# অনুসরণ :
    *রবীন্দ্র রচনাবলী- ১ম খন্ড
    *অস্পৃশ‍্যতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ -স্বরোচিষ 
      সরকার।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

হে মহাজীবন

মাঝরাতে হৃদয় খুব উথাল পাথাল করছিল। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে হৃদয় বসন্তের ডাক শুনতে পায়না, পরপারের ডাক শোনে। আর সে ডাক শুনতে ভয় করে, এই সু...